৯ আগস্ট ২০১৭, বুধবার, ১০:১৬

খাদ্যপণ্যের উচ্চমূল্যে মানুষের দুর্ভোগ বাড়ছে

আবদুল লতিফ মন্ডল : সাবেক সচিব, কলাম লেখক

আমাদের প্রধান খাদ্য চালের আকাশছোঁয়া দাম যখন জনগণের জীবনযাত্রার ব্যয় অনেকটা বাড়িয়ে দিয়েছে, তখন গত কয়েক দিনে শাকসবজি, মাছ-মাংসসহ নিত্যপণ্যের উচ্চহারে দাম বৃদ্ধি মানুষের, বিশেষ করে হতদরিদ্র, দরিদ্র, নিম্নবিত্ত ও সীমিত আয়ের মানুষের জীবনে বয়ে এনেছে চরম দুর্ভোগ। চালসহ নিত্যপণ্যের উচ্চহারে মূল্যবৃদ্ধি কীভাবে এসব মানুষের খাদ্য নিরাপত্তাকে চ্যালেঞ্জের দিকে ঠেলে দেয় এবং তাদের জীবনকে নানাভাবে দুর্বিষহ করে তোলে তা আলোচনা করাই মূলত এ নিবন্ধের উদ্দেশ্য।


চাল আমাদের প্রধান খাদ্য এবং কমবেশি ৭০ শতাংশ মানুষ মোটা চালের ভাত খায়। গত কয়েক মাস ধরে সব ধরনের চালের দাম বাড়তে থাকলেও গত জুন মাসে মোটা চালের দাম অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করে ফেলে। এক কেজি মোটা চাল বিক্রি হয় ৫০ থেকে ৫২ টাকায়। অথচ সরকারি তথ্য মোতাবেক গত জানুয়ারির শেষদিকে মোটা চালের কেজিপ্রতি দাম ছিল ৩৬ থেকে ৪০ টাকা। এপ্রিলে এর দাম দাঁড়ায় কেজিপ্রতি ৪০ থেকে ৪৩ টাকা। মোটা চালের সঙ্গে বাড়তে থাকে মাঝারি ও সরু চালের দাম। ওই সময় কেজিপ্রতি মাঝারি ও সরু চালের দাম দাঁড়ায় ৪৮ টাকা থেকে ৫৪-৫৫ টাকা। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে মোটা চাল আমদানি শুরু হওয়ায় এর দাম সামান্য কমলেও তা এখনও দরিদ্র ও হতদরিদ্রদের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। ৭ আগস্ট যুগান্তরের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, সরকারিভাবে চালের দাম কমছে দাবি করা হলেও মোটা চালের দাম এখনও কেজিপ্রতি ৪৭-৪৮ টাকা। অন্যদিকে আরও বেড়েছে মাঝারি ও সরু চালের দাম। ৬ আগস্ট প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দু’দিন আগে মিল মালিকরা বস্তাপ্রতি সরু মিনিকেট চালের দাম বাড়িয়েছে ২৫ টাকা। আর মাঝারি চালের দাম কেজিতে বেড়েছে ১ টাকা। ব্যবসায়ীরা বলছেন, খুচরা বাজারে মিনিকেট চাল ৫৬ টাকার নিচে বিক্রি করা সম্ভব নয়। মাঝারি ও সরু চালের দাম বৃদ্ধির পেছনে ব্যবসায়ীদের যুক্তি, সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে মোটা চাল আমদানি হলেও সরু ও মাঝারি চাল আমদানি হচ্ছে না। ফলে বাড়ছে এসব শ্রেণীর চালের দাম।

একাধিক কারণে চালের দাম বৃদ্ধি সাধারণ মানুষের জন্য ভীতিকর হয়ে দাঁড়ায়। এক. বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হাউজহোল্ড ইনকাম অ্যান্ড এক্সপেন্ডিচার সার্ভে (এইচআইইএস) ২০১০ মোতাবেক জাতীয় পর্যায়ে একটি পরিবারের মাসিক মোট ব্যয়ের ৫৪ দশমিক ৮১ শতাংশ খরচ হয় খাদ্যে। আবার মাসিক মোট খরচের ৩৫ দশমিক ৯৬ শতাংশ ব্যয় হয় চাল কেনায়। তাই চালের দামে ওঠানামার সঙ্গে জনগণের দুর্ভোগের হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে। চালের দামে ঊর্ধ্বগতি স্বাভাবিকভাবে তাদের আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। দুই. চালের বিশেষ করে মোটা চালের দাম বৃদ্ধির ক্ষতিকর প্রভাব ওই চালের সব শ্রেণীর ভোক্তার ওপর পড়লেও সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় দরিদ্র ও হতদরিদ্র পরিবারগুলো। সরকারি হিসাব মতে, দেশে এখনও ৪ কোটির বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি অংশ হতদরিদ্র। বিআইডিএসের এক গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী খাদ্য-মূল্যস্ফীতি বাড়লে ৭৩ দশমিক ৮ শতাংশ হতদরিদ্র পরিবারই তখন চালের ভোগ কমিয়ে দেয়। দরিদ্র পরিবারের বেলায় এ হার ৬৬ শতাংশ। তাই মোটা চালের দাম উচ্চহারে বৃদ্ধি পেলে তাদের খাদ্য নিরাপত্তা চরম হুমকির মুখে পড়ে। তিন. শুধু দরিদ্র ও হতদরিদ্ররা নয়, চালের দাম বৃদ্ধিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তরাও, বিশেষ করে যাদের আয় নির্দিষ্ট। চালের দামে ঊর্ধ্বগতির কারণে মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তদের মাছ, মাংস, ডিম, দুধ অর্থাৎ আমিষ জাতীয় খাবার কেনা অনেকটা কমিয়ে দিতে হয়। এতে তাদের পরিবারে, বিশেষ করে শিশু ও মহিলাদের পুষ্টির অভাব ঘটে। এতে অবনতি ঘটে তাদের স্বাস্থ্যের। তাছাড়া এসব পরিবারকে কমিয়ে দিতে হয় শিক্ষা খাতে ব্যয়। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় শিক্ষার্থীরা। সংকুচিত করতে হয় তাদের পরিবারের স্বাস্থ্য খাতের ব্যয়, যা স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ।

শুধু চাল নয়, বাড়ছে শাকসবজি, মাছ-মাংসসহ অন্যসব নিত্যপণ্যের দাম। ৫ আগস্ট যুগান্তরের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, সস্তার সবজি হিসেবে পরিচিত আলু রাজধানীর বাজারে বিক্রি হচ্ছে ২৫ টাকা কেজি দরে। আগের সপ্তাহে এর দাম ছিল ২০ টাকা। এক সপ্তাহের ব্যবধানে প্রতি কেজি পেঁপের দাম বেড়ে ৪০ টাকা হয়েছে। কেজিতে ২০ টাকা বেড়ে এক লাফে বেগুনের দাম উঠেছে ৭০ টাকায়। ৫০ টাকা কেজি দরের করলা বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৮০ টাকায়। ৪৫ টাকার পটোল প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৫৫ টাকায়। এক সপ্তাহে প্রতি কেজি শসার দাম ১৫ টাকা বেড়ে হয়েছে ৬০ টাকা। গাজর, বরবটি, ঝিঙা, কচুরমুখীর দাম এক সপ্তাহে কেজিপ্রতি ১০ টাকা থেকে ২০ টাকা বেড়েছে। সপ্তাহের ব্যবধানে কাঁচা মরিচের দাম বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। গত সপ্তাহে যেখানে কাঁচামরিচের দাম ছিল কেজিপ্রতি ১০০ টাকা, সেখানে চলতি সপ্তাহের শুরুতেই তা বেড়ে হয়েছে ১৮০-২০০ টাকা। সপ্তাহের ব্যবধানে এভাবেই বেড়েছে সব ধরনের সবজির দাম। সবজির দাম হঠাৎ বেড়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন নিম্ন আয়ের ক্রেতারা।

সবজির পাশাপাশি কয়েকদিন ধরেই বাড়ছে পেঁয়াজের দাম। গত দু’সপ্তাহে দেশি-বিদেশি পেঁয়াজের দাম কেজিপ্রতি ১০ টাকা বেড়েছে। গরিবের মাংস বলে পরিচিত মুগ ডাল গরিবের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। এককেজি মুগ ডালের দাম ১২০ থেকে ১৩০ টাকা। মসুর এক কেজি ১২৫ টাকা। বেড়েছে তেল, লবণ ও চিনির দাম। বাড়ছে বিভিন্ন ধরনের মাছের দাম। এক সপ্তাহে গরু ও খাসির মাংসের দাম বেড়েছে। এক কেজি গরুর মাংসের দাম ৪৮০ টাকা থেকে বেড়ে ৫০০ টাকা এবং খাসির মাংসের দাম ৭০০ টাকা থেকে বেড়ে ৭৫০ টাকা হয়েছে।

ক্রয়ক্ষমতার অভাবে বাংলাদেশে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী বিরাট জনগোষ্ঠী এমনিতেই পুষ্টিমানসম্পন্ন খাদ্য, মাছ, মাংস, ডিম, দুধ কিনতে পারে না। দাম বাড়ায় এখন তারা প্রয়োজনীয় শাকসবজিও কিনতে পারবে না। তাদের, বিশেষ করে শিশু ও নারীদের অপুষ্টির মাত্রা আরও বেড়ে যাবে। সার্বিক খাদ্যে পুষ্টিমানের অভাবের কারণে বৈশ্বিক খাদ্য নিরাপত্তা তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান এমনিতেই তলানিতে। এ অবস্থার আরও অবনতি ঘটবে। উল্লেখ্য, খাদ্য নিরাপত্তায় দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ।

সামাজিক ও নৈতিক দিক বিবেচনায় কোনো দেশের সমৃদ্ধি ফলদায়ক হয় না, যতক্ষণ না তার সব নাগরিক এর সুফল ভোগ করে। গত এক দশকের বেশি সময় আমাদের জাতীয় আয় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়লেও ন্যায়সঙ্গত বিতরণ পদ্ধতির (equitable distribution of income) অনুপস্থিতিতে দরিদ্র জনগোষ্ঠী এ থেকে কমই উপকৃত হয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সার্ভে এইচআইইএস ২০০৫ থেকে আমরা ধনী-গরিব খানার আয়ের বৈষম্যের চিত্র পাই। ২০১০ সালের এইচআইইএসে বলা হয়েছে, আয় কেন্দ্রীভূত হওয়া সামান্যই কমেছে। এ ধারা যে অব্যাহত রয়েছে, তা অনেকটা জোর দিয়ে বলা যায়। একজন অর্থনীতিবিদের ভাষায়, দারিদ্র্য কমেছে, এটা আমাদের জন্য গর্বের বিষয় হলেও সমাজে ধনী-গরিবের মধ্যে আয় বৈষম্য ক্রমেই বাড়ছে। এটা খুবই উদ্বেগের বিষয়। যার একটি ফ্ল্যাট ছিল, তার ১০টি ফ্ল্যাট হচ্ছে। অথচ গরিবরা ক্রমেই গরিব হচ্ছে। আয়কর ফাঁকি, প্রাকৃতিক সম্পদ দখল, ব্যাংক ঋণ পরিশোধ না করা ইত্যাদি অবৈধ কাজের মাধ্যমে বিত্তশালীরা সম্পদের পাহাড় গড়ছে। দারিদ্র্য নিয়ে ভাবতে হলে বৈষম্য কমার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে হবে।

সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সাধারণ মানুষের আয়, বিশেষ করে শ্রমিকদের মজুরি বেড়েছে। কিন্তু অনেক অর্থনীতিবিদ সরকারের এ বক্তব্যের সঙ্গে একমত নন। তারা বলছেন, এটা সত্য যে মজুরি বেড়েছে, তবে তা সিলেক্টিভ মানুষের জন্য। সার্বিকভাবে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের মজুরি বাড়েনি। নির্মাণ ও শিল্প শ্রমিকের মজুরি বাড়লেও কৃষি শ্রমিকের মজুরি তেমন বাড়েনি। তাছাড়া কৃষিতে কাজের সুযোগ মূলত কৃষি মৌসুমভিত্তিক হওয়ায় বছরের একটা বড় সময় কৃষিকাজ থাকে না অনেক এলাকায়। এক্ষেত্রে দেশের উত্তরাঞ্চলের উদাহরণ বিশেষভাবে প্রযোজ্য। এ অঞ্চলে ভাদ্র মাসের মাঝামাঝি থেকে কার্তিক মাস পর্যন্ত কৃষি শ্রমিকদের কাজ থাকে না বললেই চলে। তাই তাদের বাধ্য হয়ে বেকার থাকতে হয়। এতে তাদের জীবনে নেমে আসে অবর্ণনীয় কষ্ট। চাল সংকটের কারণে খাদ্য নিরাপত্তা উন্নয়নে লক্ষ্যমুখী একাধিক খাদ্য সহায়তা কর্মসূচি স্থগিত রাখা হয়েছে বলে মিডিয়ায় খবর প্রকাশিত হয়েছে। এতে দুস্থদের খাদ্য নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে।

খাদ্য মূল্যস্ফীতি সবসময় জনগণের জন্য ভীতিকর। তাই জনগণকে, বিশেষ করে হতদরিদ্র, দরিদ্র ও সীমিত আয়ের মানুষকে কিছুটা স্বস্তি দেয়ার জন্য সরকারের উচিত হবে খাদ্যপণ্যের মূল্যকে তাদের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে স্থিতিশীল রাখা।

latifm43@gmail.com

http://www.jugantor.com/window/2017/08/09/146588/