৮ আগস্ট ২০১৭, মঙ্গলবার, ৫:১৯

খুনীদের বেলায় রাষ্ট্রের হাত আলগা হলে পেশাদার অপরাধীরা তো উৎসাহ পাবেই

যে পুলিশ ২০১২-১৩ সালের আন্দোলন দমনে অজ¯্র গুলী ছুঁড়েছিল, সেই পুলিশের হাত হত্যাকারীদের সামনে পাথর হয়ে গিয়েছিল কেন?
প্রকাশ্য লাঠি ছোড়া দিয়ে নির্মমভাবে আঘাতের পর আঘাতে হত্যা করা হলো বিশ্বজিতকে। বাঁচার তাগিদে চেয়েছিল একটু আশ্রয়। পাশে দাঁড়ায়নি কেউ। ২০ দলীয় জোটের আন্দোলন সংগ্রামে তখন রাজপথ ছিল উত্তাল। বিভিন্ন স্থানে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা সশ্রস্ত্র মহড়া দিয়েছে। তাদেরই হাতে প্রাণ হারায় বিশ্বজিত। সাংবাদিক ছিল; যাঁদের ভিডিওর কারণে বিশ্বজিতের খুনীদের মুখ আমরা চিনেছিলাম। কিন্তু আসলে কোথাও কেউ ছিল না। থেকেও তারা না থাকার মতো নিশ্চল শরীরে ভয়ংকর সেই হত্যাদৃশ্য চেয়ে চেয়ে দেখেছে বা পালিয়ে বেঁচেছে।
দৈনিক প্রথম আলোর ফারুক ওয়াসিফ এর নিবন্ধে বলা হয়, হত্যার এক বছরের মধ্যে ২০১৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর দ্রুত বিচার আইনে ২১ আসামির মধ্যে আটজনকে মৃত্যুদণ্ড ও ১৩ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এখন তাঁদের দুজন খালাস, চারজনের মৃত্যুদণ্ড বদলে যাবজ্জীবন করা হয়েছে। অচিরে কোনো এক শুভক্ষণে তাঁরা রাষ্ট্রপতির ক্ষমা পেয়ে গেলে কিছুই করার থাকবে না। ক’দিন আগেই সাজাভোগের মাঝপথে শীর্ষসন্ত্রাসী জোসেফসহ ৫২ সন্ত্রাসীর সাজা মওকুফের প্রস্তাব করা হয়েছে। খুনীদের বেলায় রাষ্ট্রের হাত এত আলগা হলে পেশাদার অপরাধীরা তো উৎসাহ পাবেই। তনুর খুনীরা যে পথে হারিয়ে গেছে, বিচারহীনতার তেমন কত পথ আমরা রচনা করে রেখেছি! এতে আরো বলা হয়, যে পুলিশ ২০১২-১৩ সালের আন্দোলন দমনে অজস্র গুলী ছুঁড়েছিল, সেই পুলিশের হাত হত্যাকারীদের সামনে পাথর হয়ে গিয়েছিল কেন?
আদালতের বিচার আদালত করেছেন, আট মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তর মধ্যে দুজনকে খালাস আর চারজনকে যাবজ্জীবন দিয়েছেন। কিন্তু সেদিন কেউ যে নিরীহ ছেলেটিকে বাঁচাতে একটা চিৎকারও করল না তার কী হবে? আইনের আদালতে না হোক, হৃদয়ের আদালতে, মানবতার আদালতে আমরা কীভাবে খালাস পাব? কোন ভয় কোন ক্ষমতার কালো জাদুতে সবাই অবশ হয়ে গিয়েছিল?
যে ভয়ের রাজত্ব দেশে কায়েম হয়েছে, সেখানে কিছু মানুষকে পিঁপড়ার মতো পিষে ফেলা যায়। পিঁপড়াদের সারিতে কয়েকটা পিঁপড়াকে মারলে অন্য পিঁপড়ারা লাইন বদলিয়ে আবার হাঁটা দেয়; থামে না। বাংলাদেশে জনগণের আচরণ পিঁপড়াদের মতো হয়ে গেছে! কোনো হত্যা-অপরাধের সামনে পড়লে পিঁপড়ার মতো রাস্তা বদলে নিজের পথে হাঁটা দিই। আমরাই আবার গোল হয়ে গণপিটুনিতে মাতি, নারী নির্যাতন দেখি; কোথাও লাশ পড়লে দূরদূরান্ত থেকে ছুটে আসি দেখতে।
সাংবাদিকতার কথাও বলা যাক। পেশাদারি মানে কি দর্শক থেকে যাওয়া? যখন আপনার হস্তক্ষেপে হয়তো কারও প্রাণ বাঁচতে পারে, তখন আপনি কি ছবি তুলবেন, নাকি হস্তক্ষেপটা করবেন? উত্তরে সাংবাদিকদের তরফে বলা হবে, যে দেশে সাংবাদিকদের হত্যা-জেল-নির্যাতন নিয়মিত ঘটনা, সে দেশে তাঁদের সুপারম্যান হতে বলা বেশি নয় কি? কারুকে নৈতিকভাবে বিচার করার অধিকার এই লেখক রাখেন না। আমার শুধু মনে পড়ে দক্ষিণ আফ্রিকার জগদ্বিখ্যাত সেই সাংবাদিকের কথা। তাঁর নাম কেভিন কার্টার। দুর্ভিক্ষপীড়িত এক সুদানি শিশু ও তার দিকে এগিয়ে আসতে থাকা এক বিশাল শকুনের ছবি তুলে তিনি পুলিৎজার পুরস্কার পান। এর এক বছর পর ১৯৯৪ সালে তিনি আত্মহত্যা করেন। তাঁর আত্মহত্যা-চিঠিতে লেখা ছিল, ‘আমি সত্যি, সত্যিই দুঃখিত।...হত্যা ও লাশের স্পষ্ট স্মৃতি এবং রাগ ও বেদনা...অথবা ক্ষুধার্ত কিংবা আহত শিশুদের দৃশ্য আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়।’
বিশ্বজিতের হত্যাদৃশ্য আমাদেরও অপরাধী করে দেয়, তাড়িয়ে বেড়ায়। কিন্তু সেই সব পুলিশ, রাষ্ট্র যাদের জীবনরক্ষায় আইন ও বন্দুকে সুরক্ষিত করেছিল, যে পুলিশ ২০১২-১৩ সালের আন্দোলন দমনে অজস্র গুলী ছুড়েছিল, সেই পুলিশের হাত হত্যাকারীদের সামনে পাথর হয়ে গিয়েছিল কেন? মানুষ হলে তো বুকের মধ্যে কিছুটা রহম, কিছুটা দয়া থাকবার কথা। দয়ামায়াহীন পৃথিবী দুর্বলের জন্য ভয়ংকর।
বিশ্বজিতের মৃত্যুর মধ্যে সেদিন আমরা সামষ্টিক মৃত্যুর স্বাদ পেয়েছি। টেলিভিশনে সে দৃশ্য দেখে আমরাও যেন মরে গেছি। বিশ্বজিৎকে ওরা বন্য প্রাণী শিকারের মতো করে ধাওয়া করছিল। শিকার বধের পর আনন্দমিছিলও করেছিল। কোনো বিকার বা অনুশোচনা ছিল না। নিহত সন্তানের মা অনুশোচনাহীন সেই সব খুনিকে কীভাবে ক্ষমা করবেন? কল্পনা রানী দাস শোকের অনলজ্বালায় তাই বলতে বাধ্য হন, ‘তাদের ছবি দেশের পত্রিকা, টেলিভিশনে প্রকাশিত হলো। তারপরও তাদের মৃত্যুদণ্ড পরিবর্তন করা হলো? তাদের খালাস দিতে হলো?’
মানুষ সন্তানহারা মায়ের এই ফরিয়াদ সমর্থন করে। যার যায় তার সর্বস্বই যায়। নিহতের প্রাণ আর ফিরে আসে না। কিন্তু একটা সান্ত¡না, একটা সুবিচার হয়তো শূন্য হৃদয়ের হুতাশন কিছুটা কমাতে পারে। আমরা এখনো সেই সুবিচারের প্রত্যাশা রাখি।
বিশ্বজিৎ হত্যার ঠিক আগে আগে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর যুবলীগের প্রতি শিবির প্রতিরোধের আহ্বান জানিয়েছিলেন। হত্যার পর আওয়ামী লীগের তৎকালীন এবং বর্তমান যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বলেছিলেন, ‘বিশ্বজিৎ দাসের মৃত্যুর দায়দায়িত্ব আওয়ামী লীগের নয়।’ সে সময়ের আইন প্রতিমন্ত্রীও ‘বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ বলেছিলেন। ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবুবকর নিজ কক্ষে গুলী খেয়ে প্রাণ হারানোর পরও তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন বলেছিলেন, এটা ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’। বলেছিলেন, ‘এমন ঘটতেই পারে’। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র জুবায়ের হত্যার পরও এমন রোমহর্ষক কথাবার্তা সরকারের কর্তাব্যক্তিরা বলেছেন। ক্ষমতা কি মানুষের বোধশক্তি লোপ করে দেয়?
আসামিদের সবাই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের কর্মী ছিলেন। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদের তাঁরা জানিয়েছিলেন, ঘটনার আগের দিন ছাত্রলীগের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় বিএনপির অবরোধের পক্ষে কেউ মিছিল বের করলেই হামলা চালাতে হবে। তাঁরা জানান, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের নতুন কমিটির গ্রহণযোগ্যতা কেন্দ্রীয় কমিটির কাছে আরও বাড়াতে শক্তির মহড়া দেখিয়েছেন।
বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ড যে বছর হয়েছিল, সেই বছর সরকারপন্থী ও বিরোধীপন্থীদের সংঘাতে অনেক প্রাণ ঝরেছিল। সামনে আবার নির্বাচন, সামনে আবার আন্দোলন ও হানাহানির ভয়। বিরোধীদের বিপক্ষে শক্তির আরও আরও মহড়া অবশ্যই হবে। সেসব মহড়ায় আরও আরও রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ঠেকাতে কী প্রস্তুতি আমাদের আছে? রাষ্ট্র, সরকার, মন্ত্রিবর্গ এক অর্থে মানুষের জীবন-মৃত্যুর ম্যানেজার। উত্তরটা আশা করি তাঁরাই দেবেন।
মুদ্রার দুই পিঠ। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামীর সাজা লাঘব ও খালাসের ঘটনার একপিঠে রয়েছে কারও কারও পুনর্জীবনলাভ, অপরপিঠে রয়েছে বিশ্বজিতের দ্বিতীয় মৃত্যু। বিশ্বজিতের মা-বাবার শোক আবার ফেটে বেরুনোর মধ্যে ছেলের দ্বিতীয় মৃত্যুর জ্বলন্ত বেদনাই দেখা যায়।

 

http://www.dailysangram.com/post/295196-