৮ আগস্ট ২০১৭, মঙ্গলবার, ৫:০৪

ফের বন্যার বড় ঝুঁকি

পশ্চিমবঙ্গ আসামসহ উত্তর-পূর্ব ভারতে অতিভারী বর্ষণে দুর্যোগের ‘রেড এলার্ট’ : উজানের অববাহিকায় বন্যার ঢল ধেয়ে আসতে পারে ভাটিতে : বাংলাদেশের প্রধান নদ-নদী ফুঁসে ওঠার আশঙ্কাবাংলাদেশের লাগোয়া উজানভাগে ভারতে ভারী থেকে অত্যধিক ভারী বর্ষণ অব্যাহত রয়েছে। উজানের মূল অববাহিকায় (ক্যাচমেন্ট এরিয়া) নদ-নদীসমূহে পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চল নতুন করে ভয়াবহ বন্যা কবলিত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। সাব-হিমালয়ান অঞ্চল, গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গ এবং আসাম, অরুণাচল, মেঘালয়, ত্রিপুরা, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড, মণিপুর, সিকিম প্রদেশ পর্যন্ত সমগ্র উত্তর-পূর্ব ভারতে অবিরাম অতিভারী বৃষ্টিপাতের কারণে বন্যাজনিত দুর্যোগের সতর্কতা জারি করা হয়েছে। গতকাল (সোমবার) সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত ও পূর্বাভাস অনুযায়ী, আজ (মঙ্গলবার) ওইসব অঞ্চলে সম্ভাব্য দুর্যোগের পূর্ব-প্রস্তুতি সতর্কতা (অরেঞ্জ অ্যালার্ট) জারি করা হয়েছে। আর আগামীকাল (বুধবার) থেকে শুক্রবার (৯, ১০ ও ১১ আগস্ট) এসব অঞ্চলে জারি করা হয়েছে চূড়ান্ত সতর্কতার লক্ষ্যে ‘রেড এলার্ট’। ইতোমধ্যে ভারী থেকে অতিভারী বর্ষণে ও 

পাহাড়ি ঢলে আসাম, অরুণাচল, মেঘালয়সহ বিভিন্ন অঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে। ভাসছে নদ-নদী সংলগ্ন গ্রামের পর গ্রাম। ভারতের কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের পানিসম্পদ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় নদ-নদী ও পাহাড়ি অঞ্চলে দুর্যোগে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোতে বসবাসরতদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়ার এবং দুর্যোগ পরিস্থিতি মোকাবিলার লক্ষ্যে আগাম সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। বর্ষারোহী মৌসুমি বায়ু সক্রিয় থেকে আরও জোরদার হতে থাকায় উত্তর-পূর্ব ভারতে ও সংলগ্ন পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলে এ বছর অতিবর্ষণ হচ্ছে।
অন্যদিকে উত্তর-পূর্ব ভারত তথা উজানের অববাহিকায় বন্যার ঢল আগামী কিছুদিনের মধ্যেই ধেয়ে আসতে পারে ভাটিতে। এতে করে বাংলাদেশের প্রধান নদ-নদী আবারও ফুলে-ফুঁসে উঠার আশঙ্কা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ অবস্থায় দেশে ফের বড় ধরনের বন্যার ঝুঁকি দেখা দিয়েছে। গতকাল সর্বশেষ দেশের ৯০টি নদ-নদীর পানির সমতল পর্যবেক্ষণ পয়েন্টের মধ্যে ৩টি নদী ৪টি পয়েন্টে বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। পানি বৃদ্ধি পায় ৪১টি পয়েন্টে। গতকাল উত্তর জনপদের তিস্তা নদীর পানি ডালিয়া পয়েন্টে বৃদ্ধি পায়। যদিও বিপদসীমার নিচে রয়েছে। অবশ্য গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গ ও উত্তর-পূর্ব ভারতে গত প্রায় এক সপ্তাহে ভারী থেকে অতি ভারী বর্ষণের ঢল উজানের অববাহিকা হয়ে বাংলাদেশে আসতে আরও কিছুদিন সময় লাগবে। ওইসব অঞ্চলে অর্থাৎ হিমালয় পাদদেশীয় এলাকা, গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গ এবং উত্তর-পূর্ব ভারতে ব্যাপক ভারী বৃষ্টিপাতের ফলে নদ-নদীর মূল উৎস বা অববাহিকায় পানি অব্যাহতভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর প্রভাবে ভাটিতে বাংলাদেশের নদ-নদীতেও বাড়ছে পানি।
প্রসঙ্গত গত ২৬ জুলাই পানিসম্পদ মন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ঢাকায় জেলা প্রশাসকদের সম্মেলনে বলেন, আগস্ট মাসের তৃতীয় সপ্তাহে দেশে বড় ধরনের বন্যার আশঙ্কা রয়েছে। এরজন্য পানি উন্নয়ন বোর্ড ও জেলা প্রশাসনকে সতর্কাবস্থায় থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ এবং বন্যার আগে বাঁধগুলো মেরামতের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। মন্ত্রী বলেন, বড় বন্যা হয় যখন যমুনা, পদ্মা ও মেঘনার পানি একসঙ্গে বৃদ্ধি পায়। আর সেই সাথে যদি অমাবস্যা থাকে তখন বন্যার প্রকোপ বেড়ে যায়। ইতোমধ্যে দ্বিগুণ বৃষ্টি হয়েছে। আমরা সতর্ক করেছি যে একটা বন্যার আশঙ্কা আছে। আর এই বন্যাটা হয় আগস্টের তৃতীয় সপ্তাহে। এরজন্য প্রস্তুতি রাখতে পানি উন্নয়ন বোর্ডকে বিশেষভাবে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
পাউবোর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাও বলছেন, অতীতের দুর্যোগ অভিজ্ঞতায় আগস্টে বন্যার ঝুঁকি থাকে। তবে বন্যার দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাস পাউবো দেয় না। ৫ দিনের পূর্বাভাস এবং ১০ দিনের সীমিত ক্ষেত্রে পরীক্ষামূলক পূর্বাভাস দেয়া হয়। বিশেষজ্ঞ সূত্র জানায়, দেশের প্রধান নদ-নদীসমূহের উৎস কিংবা অববাহিকা মূলত ভারতে হলেও সেখানকার উজানের প্রবাহ সম্পর্কে পূর্বাভাস পাওয়া যায় না। কেননা ভারতের পক্ষ থেকে মাত্র ৩ থেকে ৪ দিন আগে এ সম্পর্কে তথ্য-উপাত্ত দেয়া হয়। ৪টি নদ-নদীর উজানের অববাহিকার মাত্র ৮টি পয়েন্টের তথ্য মিলে। সেগুলো হচ্ছে, এক. ব্রহ্মপুত্র-যমুনার উজানভাগের অববাহিকায় ৪টি পয়েন্ট, উত্তর-পূর্ব ভারতের আসামের গুয়াহাটি, পান্ডু গোয়ালপাড়া ও ডুবড়ি। দুই. গঙ্গা অববাহিকায় ২টি পয়েন্ট, উজানের ফারাক্কা এবং সাইফগঞ্জ (বিহার)। তিন. সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর উজানে বরাকের শিলচর। এবং চার. তিস্তার উজান ভাগের একটি পয়েন্টের। অথচ ভারতের পক্ষ থেকে উজানের অববাহিকার নদ-নদীর সমতল বা প্রবাহের বেশ আগাম পূর্বাভাস বাংলাদেশের জন্য পাওয়া জরুরি। তাহলেই কেবল আগাম সতর্কতা ও প্রস্তুতি গ্রহণ করা সম্ভব। বিশ্বে প্রতিবেশী দেশের মধ্যে বন্যার তথ্য-উপাত্ত বিনিময় ও দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাস আদান-প্রদানের ব্যবস্থা প্রচলিত আছে।
বিশেষজ্ঞ সূত্র জানায়, সাধারণত উজানের দেশ ভারতে বিশেষত উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অবিরাম ভারী বৃষ্টি এবং এ কারণে গঙ্গা-পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা, মেঘনা অববাহিকায় একযোগে পানি বৃদ্ধি পেলে বাংলাদেশে বড় আকারে বন্যা দেখা দেয়। প্রধান সবকটি নদ-নদীর উৎসস্থল ও মূল অববাহিকা (ক্যাচমেন্ট এরিয়া) হচ্ছে হিমালয়ান অঞ্চল চীন তিব্বত ভারতে। বাংলাদেশের প্রধান নদ-নদীসমূহের পানির ৮০ থেকে ৯০ ভাগ প্রবাহের উৎস হচ্ছে উপরোক্ত মূল অববাহিকায়। জুলাইয়ের বন্যা আগস্টেও বিলম্বিত হলে আশঙ্কা আরও বেড়ে যায়। চলতি বছরে এসব নেতিবাচক আলামত পরিলক্ষিত হচ্ছে। অতীতের ধারাবাহিকতায় ৭, ৮ কিংবা ১০ বছর পর পর এদেশে ব্যাপক ধরনের বন্যা সংঘটিত হয়েছে। বিগত ১৯৮৮, ১৯৯৮ ও ২০০৭ সালের ভয়াল বন্যা তার নিকটতর উদাহরণ। ২০০৭ সালের পর দেশে খুব বড় আকারের বন্যা হয়নি।
এদিকে সিলেটের প্রধান দুই নদী সুরমা-কুশিয়ারা বিপদসীমার উপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। গতকাল সুরমা নদী কানাইঘাটে বিপদসীমার ৬ সেমি উপর দিয়ে এবং কুশিয়ারা নদী অমলশীদে ১৩ ও শেওলা পয়েন্টে ২৬ সেমি উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ঝিকরগাছায় কপোতাক্ষ নদী বিপদসীমার ১১ সেমি উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। নদ-নদী পরিস্থিতি ও পূর্বাভাসে জানা গেছে, গঙ্গা-পদ্মা ও সুরমা-কুশিয়ারা নদ-নদীসমূহেরর পানির সমতল বৃদ্ধি পাচ্ছে। ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদের পানির সমতল হ্রাস পাচ্ছে। গঙ্গা-পদ্মা নদ-নদীর পানির সমতল বৃদ্ধি আগামী ২৪ ঘণ্টায় অব্যাহত থাকতে পারে।

 

https://www.dailyinqilab.com/article/90923/