৮ আগস্ট ২০১৭, মঙ্গলবার, ৩:২৯

চাল নিয়ে খেলছে তিন সিন্ডিকেট

মিল মালিক, ব্যবসায়ী ও আমদানিকারকরা ইচ্ছামতো বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে

বছরের শুরুই হয়েছিল চালের দরের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দিয়ে। ধাপে ধাপে বাড়তে বাড়তে তা ক্রেতাদের বিশেষ করে নিম্ন আয়ের মানুষের নাগালের বাইরে চলে যায়। কেজিপ্রতি মোটা চালের দর গিয়ে ঠেকে প্রায় পঞ্চাশ টাকার ঘরে। দেশের বাজারে এর আগে চালের দাম কখনো এতটা বাড়েনি। সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য মতে, সরকারের কাছে পর্যাপ্ত তথ্য না থাকায়, সরকারি গুদামে মজুদ কমে যাওয়ায় এবং বাজার নিয়ন্ত্রণে সঠিক সময়ে যথাযথ সিদ্ধান্ত নিতে গড়িমসি করায় মিল মালিক ও ব্যবসায়ীরা কারসাজি করে বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি করে। পরে সরকার ব্যবসায়ীদের নানা সুবিধা দিলেও চালের দর এখনো সাধারণ ক্রেতাদের নাগালে আসেনি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, গত ফেব্রুয়ারিতে বিভিন্ন ধরনের চালের দাম কেজিপ্রতি বেড়েছিল তিন-চার টাকা করে। সে সময় পাইকারি বাজারে কেজিপ্রতি মোটা চাল বিক্রি হয় ৩৬ টাকায়। খুচরা বাজারে সেই চাল বিক্রি হয়েছে ৪০-৪২ টাকা করে। দাম বাড়ার আগে তা ছিল ৩৮ টাকা করে। দাম বাড়ানোর যুক্তি হিসেবে সে সময় মিলাররা বলেছিল মৌসুম শেষ হওয়ায় কৃষকের কাছ থেকে বেশি দামে ধান কিনতে হচ্ছে।
মার্চে একই যুক্তিতে মিলার ও ব্যবসায়ীরা মিলে আরেক দফা দাম বাড়ায়। তখন পাইকারি বাজারে মোটা চাল বিক্রি শুরু হয় কেজিপ্রতি ৪৪-৪৫ টাকায়। মার্চের শেষে আগাম বন্যায় হাওরাঞ্চলে ধান ডুবে যায়। ব্লাস্ট রোগেও বেশ কয়েকটি জেলায় ধানের ক্ষতি হয়। একই সময় সরকারি গুদামে চালের মজুদে ঘাটতির তথ্যও বেরিয়ে আসে। এ সুযোগে আরেক দফা দাম বাড়ায় মিলার ও ব্যবসায়ীরা। মোটা চালের দাম ওঠে কেজিপ্রতি ৪৮ টাকায়।
বাজারসংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বোরো মৌসুমের শুরু থেকেই বাজারে চালের দাম বাড়তে থাকে। বাজারে পর্যাপ্ত চাল থাকা সত্ত্বেও দাম বাড়তে থাকে। মিলাররা নানা অজুহাত খাড়া করে ধাপে ধাপে দাম বাড়িয়ে যায়। বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারি নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোও যথাযথ ভূমিকা পালন করেনি। বোরো ধান কাটার আগ মুহূর্তে হাওর ডুবে যায় আগাম বন্যায়। এতে হাওরাঞ্চলে প্রায় ছয় লাখ মেট্রিক টন বোরো ধান নষ্ট হয়। এ সুযোগে চালকল ব্যবসায়ীরা বাজার অস্থির করে তোলে। মূলত তাদের হাতেই নিয়ন্ত্রণ ছিল চালের বাজারের।
তবে বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিল অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক লায়েক আলী কালের কণ্ঠকে বলেন, সরকারি হিসাবে অনেক ভুল রয়েছে। বন্যা ও ব্লাস্ট রোগের কারণে প্রায় ২৫ লাখ মেট্রিক টন কম চাল উৎপাদন হয়েছে। আবার সরকারের কাছেও তো চালের মজুদ নেই। সংকট থাকলে তো দাম বাড়বেই। এখানে নিয়ন্ত্রণের কোনো বিষয় নেই।
বন্যায় ও ব্লাস্ট রোগে ধানের যে ক্ষতি হয়েছে তাতে সর্বোচ্চ ১৫ লাখ টন চালের উৎপাদন কম হতে পারে। সরকারি নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোই এ তথ্য জানিয়েছে। মে-জুনে মোটা চালের দাম উঠে যায় ৪৮ থেকে ৫০ টাকা পর্যন্ত। সে সময় খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম মিলারদের সঙ্গে বৈঠক শেষ করে সংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, ‘হাওর অঞ্চলে যে পরিমাণ ধানের ক্ষতি হয়েছে তাতে সারা দেশে চালের দামে কোনো প্রভাব পড়বে না। কারণ প্রতিবছর সারা দেশে চালের উৎপাদন হয় সোয়া তিন কোটি থেকে সাড়ে তিন কোটি মেট্রিক টন। আর আমাদের প্রয়োজন পড়ে পৌনে তিন কোটি মেট্রিক টন। সুতরাং বন্যার ক্ষতিতে চালের দামে কোনো প্রভাব পড়বে না। বোরো ধান কাটা শুরু হলেই দাম কমে আসবে। চালের কোনো সংকট নেই। দুর্যোগের সুযোগ নিয়ে চালের দাম বৃদ্ধি করে যাচ্ছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। ’
তবে দিনাজপুরের চালকল মালিক গ্রুপের সাবেক সভাপতি এবং চাল আমদানিকারক হুমায়ূন রেজা ফারুক চৌধুরী শামিম বলেন, চালের দাম বাড়লেই মিল মালিকদের দোষারোপ করা হয়। মার্চ-এপ্রিলে সংকট যখন তৈরি হয়েছে তখন আমদানি শুল্ক কমিয়ে দিলেই তো আর এই সমস্যাটা তৈরি হতো না। এখন তো সংকট আছে বলেই দাম বাড়তি। আবার আমদানি করা চালের দামও বেশি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হাওরে বন্যা, বিভিন্ন জেলায় ব্লাস্ট রোগে উৎপাদনে ঘাটতির আশঙ্কার মধ্যেই সরকারি গুদামে চালের মজুদ নেমে যায় দুই লাখ টনের নিচে। সম্প্রতি আমদানি করা চালে সরকারি গুদামে মজুদ বেড়ে দুই লাখ ৪০ হাজার মেট্রিক টনে পৌঁছেছে। তবে তাতে বাজারে প্রভাব পড়েনি। তাই বোরো মৌসুমের ধান কৃষকের ঘরে ওঠার পরও চালের দাম সেভাবে কমেনি। তখন ব্যবসায়ীরা চালের আমদানি শুল্ক কমানোর দাবি তোলে। বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার জুনে চালের আমদানি শুল্ক ২৮ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করে। সরকার আশা করেছিল বেসরকারি পর্যায়ে চালের আমদানি বাড়লে বাজার নিয়ন্ত্রণে আসবে।
তারপর প্রায় দেড় মাস পার হলেও এখনো চালের বাজারে অস্থিরতা কমেনি। জানা যায়, শুল্ক কমানোর পর ভারত থেকে স্থলপথে চাল আসতে শুরু করলেও তত দিনে বাংলাদেশের বাজারের অস্থিরতার খবর ভারতের ব্যবসায়ীরা জেনে যায়। ভারতে হঠাৎ প্রতি মেট্রিক টনে দাম বেড়ে যায় ৩০-৪০ ডলার। টনপ্রতি যে চাল ছিল ৩৯০ ডলার, তা হয়ে যায় ৪২০-৪৩০ ডলার। ফলে আমদানিকারকরা দেশে চাল আনলেও বাজারে দামে প্রভাব পড়েনি। ব্যবসায়ীরা আমদানি মূল্য বেশি দেখিয়ে দাম কমায়নি। বলে, খরচ বেশি পড়েছে। আমদানি চাল বাজারে আসার পরপর নামমাত্র দাম কমলেও সপ্তাহখানেক ধরে আবার চালের দাম বাড়তে শুরু করেছে।
ভারতের টাইমস অব ইন্ডিয়া পত্রিকার তথ্য মতে, ভারতের বাজারে বর্তমানে ৫ শতাংশ ভাঙা অর্ধসিদ্ধ চাল টনপ্রতি বিক্রি হচ্ছে ৪০৬-৪০৯ ডলার। থাইল্যান্ডে বেঞ্চমার্ক ৫ শতাংশ ভাঙা চালের দাম টনপ্রতি ৩৯০-৩৯২ ডলারে বিক্রি হচ্ছে। এক সপ্তাহ আগেও এ চালের দাম ছিল ৩৯৫-৪০৮ ডলার। ভিয়েতনামে ৫ শতাংশ ভাঙা চাল বিক্রি হচ্ছে টনপ্রতি ৪০০-৪০৫ ডলারে।
জানা গেছে, প্রথম ধাপে চালকল মালিকদের হাতে বাজারের নিয়ন্ত্রণ ছিল। এবার যুক্ত হয়েছে আমদানিকারকরা। তারা বেশি দামে চাল আমদানির যুক্তি দেখিয়ে বাজারে চালের দাম কমাচ্ছে না। গত জুনের শেষ দিকে আমদানি করা মোটা চালের দাম ৪৮ টাকা থেকে কমে ৪৫-৪৬ টাকায় বিক্রি শুরু হয়। কিন্তু চিকন চাল আগের মতোই ৫৫-৬০ টাকাতেই বিক্রি হতে থাকে। এই ধাপে দাম কমলেও সপ্তাহখানেক ধরে কোনো ধরনের যুক্তি ছাড়াই বস্তাপ্রতি চালের দাম বেড়েছে ৫০-১০০ টাকা করে।
বাড্ডা রাইস এজেন্সির পাইকারি বিক্রেতা আমিনুল হক খোকন জানান, মোটা ও চিকন সব ধরনের চাল বস্তাপ্রতি ৫০-১০০ বা কেজিপ্রতি ৫০ পয়সা থেকে এক টাকা পর্যন্ত দাম বেড়েছে। মোটা চাল স্বর্ণা বস্তাপ্রতি বিক্রি হচ্ছে দুই হাজার ৬০ থেকে দুই হাজার ৮০ টাকায়। যা গত বছরের একই সময়ে ছিল এক হাজার ৩৫০ থেকে এক হাজার ৪০০ টাকা। সরু চাল বিক্রি হচ্ছে বস্তাপ্রতি দুই হাজার ৫০০ থেকে দুই হাজার ৯০০ টাকা পর্যন্ত। গত বছর একই সময়ে সরু চালের বস্তাপ্রতি দাম ছিল দুই হাজার থেকে দুই হাজার ১০০ টাকার মধ্যে।
খুচরা বাজারের সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, আমদানির আগে বাজারে যে মোটা চাল ৪৮ টাকায় বিক্রি হয়েছে সেটা এখন ৪৫-৪৬ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তবে মোটা চালের মধ্যে আবার পাইজাম বিক্রি হচ্ছে ৪৭-৪৮ টাকায়। কোনো কোনো দোকানে কেজিপ্রতি ৫০ টাকায়ও বিক্রি করতে দেখা গেছে। নাজিরশাইল বা মিনিকেটসহ বিভিন্ন মানের চাল বিক্রি হচ্ছে ৫৫ থেকে ৬২ টাকা পর্যন্ত দামে।
এদিকে সরকার প্রায়ই তাদের মজুদ বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন দেশে যাচ্ছে। টার্গেট রয়েছে ১০-১৫ লাখ মেট্রিক টনের। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে যে দেশেই যাওয়া হচ্ছে সেখানেই চালের দাম বাড়তি। এ কারণে আমদানি করে মজুদ বৃদ্ধিও সরকারের জন্য খুব একটা সহজ হচ্ছে না। যদিও এর মধ্যে কয়েকটি দেশের সঙ্গে ছয় লাখ টনের চুক্তি সম্পন্ন হয়েছে বলে জানা গেছে।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষিতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক পরিমল কান্তি বিশ্বাস বলেন, বোরো মৌসুমে এক কোটি ৯০ লাখ টন চাল পাওয়া যায়। হাওরে বন্যার কারণে সাত থেকে ১০ লাখ টনের মতো চালের উৎপাদন নষ্ট হয়েছে। কিন্তু এর পরও বাজারে এর প্রভাব পড়ার কথা নয়। প্রভাব পড়ার কথা ছিল অক্টোবর-নভেম্বরে। কিন্তু যখন সরকারের কাছে চালের মজুদ নেই তখন আমদানিকারকরাও সুযোগ বুঝে বেশি দামে চাল বিক্রি করছে। বাজারে কোথাও চালের সংকট নেই। সব রয়েছে ব্যবসায়ীদের হাতে। তারা ইচ্ছামতো দাম হাঁকাচ্ছে। ব্যবসায়ীদের হাতে যে চালগুলো মজুদ রয়েছে সেটা বাজারে নিয়ে আসতে সরকারকেই ব্যবস্থা নিতে হবে। শুধু আমদানি করলেই এ সমস্যার সমাধান হবে না।
চালের বাজারের এই অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারাকে সরকারের ব্যর্থতাকেই দায়ী করছেন বাজার বিশ্লেষকরা। তাঁদের মতে, সরকার আসলে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ বলে ঘোষণা দেওয়ার পরই তাদের মধ্যে একধরনের রাজনৈতিক অহমিকা তৈরি হয়েছে। যে কারণে তারা বিপাকে পড়েও সংকটের কথা স্বীকার করতে চায় না। পাশাপাশি কোনো ধরনের মনিটরিংও নেই। যে কারণে সরকার সময়মতো সিদ্ধান্ত নিয়ে ব্যর্থ হয়েছে।
কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, সরকারের ঘোষণা মতে, ১৫ লাখ মেট্রিক টন চালের উৎপাদন ক্ষতি হয়েছে। সরকার এখন পর্যন্ত ছয় লাখ টনের চুক্তি করেছে। বেসরকারি পর্যায়ে দেড়-দুই লাখ টনের মতো চাল আমদানি হয়েছে। অর্থাৎ এখনো প্রচুর ঘাটতি রয়েছে। আর ব্যবসায়ীরা সরকারের এ দুর্বলতার কথা জেনে গেছে। যে কারণে তাদের স্বভাবমতোই তারা দেশের বাজারকে অস্থির করে রেখেছে। সরকারের গুদামে ৮-১০ লাখ টনের মতো চালের মজুদ না হওয়া পর্যন্ত অস্থিরতা কমার লক্ষণ নেই।
এ ধরনের সংকট থেকে বের হতে এত সময় লাগে কেন জানতে চাইলে গোলাম রহমান বলেন, সরকার আসলে স্বীকার করতে দ্বিধা করছে যে তারা সংকটে পড়েছে। আবার খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অদূরদর্শিতায় ব্যবস্থা নিতে অপারগতা দেখা গেছে। যেসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে সেগুলোও অনেক পরে। যে কারণে ভোগান্তিটা দীর্ঘ হচ্ছে।
চালের দাম বৃদ্ধি এবং বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে না পারার বিষয়ে গতকাল সোমবার রাতে কালের কণ্ঠ’র পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম বলেন, ‘চাল নিয়ে কোনো মন্তব্য করব না। ’

 

http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2017/08/08/529127