৮ আগস্ট ২০১৭, মঙ্গলবার, ৩:২৭

রেলের জমি দখলে বেপরোয়া পাঁচ আওয়ামী লীগ নেতা

বগুড়া রেলস্টেশন থেকে পূর্ব দিকে এগোলে করতোয়া রেলব্রিজ পর্যন্ত রেললাইনের দুই ধারে অসংখ্য দোকানপাট। লোকজন বলে থাকে ‘হঠাত্ মার্কেট’। রেলের জায়গায় ত্রিপল টানিয়ে ব্যবসা চলছে। জানতে চাইলে রাশেদ নামের এক দোকানদার বলেন, ‘এ তো খালি দোকান। রেলের জায়গা খেয়ে বড় বড় মার্কেট করিচ্চে তা দখবার পারছেন না!’ স্থানীয় আরেক বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, রেলের জমি ও দোকান বরাদ্দ দিচ্ছেন কয়েকজন নেতা। আট বছর ধরেই চলছে।
গত এক সপ্তাহে বগুড়া শহরে অনুসন্ধান চালিয়ে জানা গেছে, এখানে সরকার ও ক্ষমতার পালাবদলের সঙ্গে পাল্টেছে দখলের চিত্রও। রেলওয়ের শত শত বিঘা জমি দখল হয়েছে এরই মধ্যে। হচ্ছে শত কোটি টাকার বাণিজ্য। দখলের শীর্ষে আছেন সরকারদলীয় অঙ্গসংগঠনের পাঁচ নেতা। সব দখলের সঙ্গে উচ্চারিত হয় জেলা শ্রমিক লীগের সভাপতি ও প্যানেল মেয়র সামসুদ্দিন শেখ হেলালের নাম।
বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মমতাজ উদ্দিন এক প্রশ্নের জবাবে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিএনপির আমলেই
এসব অপকর্মের শুরু। তারাই দেখিয়েছে। আমাদের দলের যাদের নাম আসছে তাদের বিরুদ্ধে আমরা সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিই। ’
অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্য মতে, বগুড়া শহরে রেলের প্রায় ২০ একর জমি অবৈধ দখলদারদের কবজায় রয়েছে। এসব জমির মূল্য হবে ১০০ কোটি টাকারও বেশি। রেলস্টেশেনের পূর্ব পাশ থেকে চেলোপাড়া রেলব্রিজ পর্যন্ত প্রায় দুই কিলোমিটার এলাকায় তিন নেতা গড়ে তুলেছেন বিশাল মার্কেট। গত পাঁচ বছরে সেখানে প্রায় দুই হাজার দোকান তৈরি করে সেগুলো এরই মধ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। দখল করা দোকানগুলো বরাদ্দে জন্য তিন থেকে সাত লাখ টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয়েছে। এতে বাণিজ্য হয়েছে কমপক্ষে ৬০ কোটি টাকা। এই দখল বাণিজ্য করেছেন জেলা শ্রমিক লীগ সাধারণ সম্পাদক সামসুদ্দিন শেখ হেলাল, ধর্ষণে অভিযুক্ত তুফানের ভাই মতিন ও আওয়ামী লীগ নেতা আজিজুর রহমান লিটন।
সরেজমিনে গিয়ে বাদুড়তলা এলাকায় রদখা যায়, ১ নম্বর রেলগেটে শাপলা মার্কেটের কাছে উত্তর পাশ ঘেঁষে রেললাইনের (ডেঞ্জার জোন) কয়েক শ দোকান নির্মাণ করা হয়েছে। আব্দুল কাদের নামের এক ব্যবসায়ী জানান, চার থেকে সাত লাখ টাকায় এসব দোকান হস্তান্তর করা হয়েছে। অনেকে দোকান বরাদ্দ পেতে তদবিরও করে।
আজিজুল হক কলেজের রোকেয়া হোস্টেলের সামনে জলাধার দখল করে মাছ চাষ করছেন শেখ হেলাল। কলেজের প্রবেশপথে দেড় বছর আগে মার্কেটও করেন তিনি। লেকপাড়ের অন্তত ২০টি দোকানের মার্কেটের নাম শেখ মার্কেট। এরই পাশে রেলওয়ের জলাশয় ভরাট করে দোকানঘর নির্মাণ করছেন ওই কলেজ শাখা ছাত্রলীগের আহ্বায়ক আবু জাফর মাহমুদুন্নবী। তবে আবু জাফর কালের কণ্ঠকে বলেছেন, এই জায়গা ইজারা নেওয়া আছে।
সরেজমিনে জানা গেছে, সূত্রাপুর এলাকায় স্টেশন সড়কের এডওয়ার্ড পার্কে একসময় রেল কলোনি ছিল। সেখানে পুকুরও ছিল। সাড়ে চার একরের (১৩ বিঘার বেশি) এই জায়গায় মাটি ভরাট করে মার্কেট তৈরির তোড়জোড় চলছে। শ্রমিক লীগ নেতা ও কাউন্সিলর সামসুুদ্দিন শেখ হেলাল, শহর আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল মান্নান এবং আবদুল মতিন সরকার সেখানে মার্কেট নির্মাণ করছেন।
এ ব্যাপারে আবদুল মান্নান কালের কণ্ঠকে বলেন, জমিটি রেলওয়ে কল্যাণ ট্রাস্ট থেকে ইজারা নিয়েছে বগুড়া ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সমিতি। এই সমিতি দোকান নির্মাণের জন্য তাদের সঙ্গে চুক্তি করে। মার্কেট হলে রেল বেশি রাজস্ব পাবে।
রেলের প্রতিটি জমি দখলেই উঠে এসেছে শ্রমিক লীগ নেতা সামসুদ্দিন শেখ হেলালের নাম। ১৯৯৭ সালের পর রেল বিভাগ নতুন করে কোনো জমি ইজারা দিচ্ছে না। তাহলে আপনি ইজারা নিলেন—এমন প্রশ্ন করা হলে শেখ হেলাল কালের কণ্ঠকে বলেন, আগেই ইজারা নেওয়া হয়েছিল।
রেলওয়ে লালমনিরহাটের বিভাগীয় ভূসম্পত্তি কর্মকর্তা রেজানুল হক গতকাল বলেন, দখলের পরিপ্রেক্ষিতে অনেক মামলা হয়েছে। সেগুলো চলমান। দখলকৃত জমি উদ্ধারের ক্ষেত্রে মামলা নিষ্পত্তির দিকে তাকিয়ে থাকতে হচ্ছে।
নদীও গিলে খাওয়া : সরেজমিন অনুসন্ধানে দেখা যায়, ঠেঙ্গামারা থেকে শুরু করে শেরপুর পর্যন্ত করতোয়া নদীতে দখলদারি প্রতিষ্ঠা করেছে প্রভাবশালী মহল। স্থানীয় জেলা প্রশাসন গত বছর একটি জরিপ করেছে, যেখানে দখলদারের সংখ্যা ২৬ জন। তাদেরই একজন সঞ্জীব কুমার বিহানী বলেন, ‘এটা আমাদের কেনা জায়গা। ম্যাপ দেখে গুদাম করি। কিছু অংশ নদীতে ঢুকেছে। ’
পরিবেশ অধিদপ্তরের রাজশাহী বিভাগীয় কর্মকর্তা এ কে এম মাসুদুজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘করতোয়া নদী দখলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আমরা জেলা প্রশাসনকে চিঠি দিয়েছি। প্রয়োজনীয় সাপোর্টের অভাবে আমরা মোবাইল কোর্ট চালাতে পারছি না। ’
আরো দখলের পাঁয়তারা : অনুসন্ধানে জানা গেছে, বগুড়ায় ২০ বছর ধরে বেশ কিছু দখলের পাঁয়তারা চলছে। জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মমতাজ উদ্দিনের ছেলে ও শিল্প বণিক সমিতির সভাপতি মাছুদুর রহমান প্রভাব খাটিয়ে কিনে নেন প্রত্নসম্পদ ঘোষণা করা বগুড়ার ঐতিহ্যবাহী নওয়াববাড়ি। গত ফেব্রুয়ারি মাসে এই ওয়াক্ফ সম্পত্তি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয় সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়। প্রায় দুই মাস আগে শহরের আটাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠের সঙ্গে ১৬ শতাংশ জমি কিনে সেখানকার মাঠ দখলে নেওয়ার চেষ্টা করেন জেলা যুবলীগের সাবেক সহসভাপতি আলহাজ শেখ। তবে এলাকাবাসীর বাধার মুখে সে চেষ্টা সফল হয়নি।
শহরের লতিফপুর কলোনিতে বগুড়া মূক-বধির বিদ্যালয়ের ৬১ শতক জমি ইজারা দেয় পৌরসভা। দুই বছর আগে আদালতের স্থগিতাদেশের কারণে দখল থেকে বেঁচে আছে স্কুলটি। প্রধান শিক্ষক আতাউর রহমন বলেন, ‘প্রতিবন্ধী ১৯৩ শিশু এখানে পড়ছে। এমন স্থানেও দখলদারদের চোখ পড়েছে। বিষয়টি নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। ’
ছিল বিএনপি সিন্ডিকেট : বিএনপির আমলে বগুড়ার সব উন্নয়নকাজের দরপত্র নিয়ন্ত্রণ করেছিল টেন্ডারবাজ সিন্ডিকেট। সড়ক ও জনপথ বিভাগ, স্থানীয় সরকার বিভাগ, পানি উন্নয়ন বোর্ড, শিক্ষা-প্রকৌশল বিভাগ, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল, স্বাস্থ্য প্রকৌশল ও পৌরসভার সব ধরনের ঠিকাদারিকাজ ছিল তাদের দখলে। মূলত বিএনপির ওই সিন্ডিকেট হাওয়া ভবনের প্রভাবে প্রতিটি কাজ নিজেদের দখলে নিয়ে ভাট-ভাটোয়ারা করত। এই সিন্ডিকেটের টেন্ডারবাজির অনিয়ম ধরা পড়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর। তখন চাকরি হারান অভিযুক্ত নির্বাহী প্রকৌশলী। টেন্ডারবাজির সিন্ডিকেট বগুড়া পৌরসভার বিশেষ উন্নয়ন বরাদ্দের ৫২ কোটি টাকার কাজেও লুটপাট করেছে বলে অভিযোগ করছে এলাকাবাসী। সূত্র জানায়, বর্তমান সরকারের আমলে বগুড়ায় উন্নয়নকাজ কমে যাওয়ায় এবং ই-টেন্ডারিং চালু হওয়ায় সিন্ডিকেট নতুনভাবে গড়ে ওঠেনি। অভিযুক্তদের বেশির ভাগই এখন এলাকাছাড়া।

 

http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2017/08/08/529132