৭ আগস্ট ২০১৭, সোমবার, ১১:৩২

গুম খুনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বেওয়ারিশ লাশ

গুম খুনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রাজধানী ঢাকার রাস্তায় বাড়ছে অজ্ঞাত লাশের সংখ্যা। প্রতিদিনই পুলিশ ঢাকার বিভিন্নস্থান থেকে পরিচয়হীন মানুষের বেওয়ারিশ লাশ উদ্ধার করছে। এসব লাশের কোনটা মেডিকেলের মর্গ হয়ে আত্মীয় স্বজনের কাছে যাচ্ছে। আবার কোনটা যাচ্ছে বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে কোন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কাছে। পরিসংখ্যান বলছে, প্রতিমাসে দেড়শ’র মতো লাশ দাফন হচ্ছে বেওয়ারিশ হিসেবে। কেবল আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামের কাছে প্রতিদিন গড়ে ৪টি লাশ যাচ্ছে বেওয়ারিশ হিসেবে। 

মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয় দিয়ে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর অনেকেরই কোনও খোঁজ পাওয়া যায় না। তাদের বিচার বহির্ভূতভাবে হত্যা করা হয়। গুম খুনের সাথে পাল্লা দিয়ে গত কয়েক বছর ধরে বেওয়ারিশ লাশের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় মানবাধিকার সংগঠনের পাশাপাশি বিরোধীদলগুলোর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে তাদের নেতাকর্মীদের গুম করে মেরে ফেলা হচ্ছে। বছরের পর বছর সেসব নেতাকর্মীদের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।
মানবাধিকারসংগঠন অধিকারের প্রতিবেদন বলছে, ২০১৬ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত বিচার বহির্ভূতভাবে ১১৮ জনকে হত্যা করা হয়েছে। গুমের শিকার হয়েছেন ৮৪ জন। ক্রসফায়ারে মৃত্যু হয়েছে ১৩৭।
বেওয়ারিশ লাশের বিষয়ে বলা হচ্ছে, বেশিরভাগ সময়েই লাশগুলো থাকে গলিত বা অর্ধগলিত। অনেক সময় পুরো লাশটিও পাওয়া যায় না। পাওয়া যায় নানা অঙ্গ প্রতঙ্গ। নির্দিষ্ট সময় পর এগুলো বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে দাফন করছে আঞ্জুমান মফিদুল ইসলাম।
স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলোর মতে, কেবল রাজধানী ঢাকা থেকে প্রতিবছর গড়ে দেড় হাজার বেওয়ারিশ লাশ দাফন করা হয়। পুলিশ বলছে নিখোঁজদের বিষয়ে স্বজনরা তৎপর হলেই কমবে বেওয়ারিশ থেকে যাওয়া লাশের সংখ্যা।
আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, তাদের কাছে বিভিন্ন মেডিকেল এবং থানা বেওয়ারিশ লাশের তথ্য আসে। সেই তথ্য অনুযায়ী তারা নাম পরিচয়হীন লাশ দাফন কাফনের ব্যবস্থা করে থাকেন। সংস্থাটির দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানান, এবছর লাশের পাশাপাশি লাশের দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন অঙ্গ প্রতঙ্গ বেশি পেয়েছেন। এসংখ্যা গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে ২৩টি। আর মে মাসের ১৯টি পাওয়া গেছে।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজসহ কয়েকটি মর্গের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানান, দীর্ঘদিন অপেক্ষার পরও যখন স্বজনদের কোনও খোঁজ পাওয়া যায় না, তখন এসব লাশ আঞ্জুমানকে দিয়ে দাফনের ব্যবস্থা করা হয়। লাশ নিয়ে যদি আদালতের কোনও নির্দেশনা থাকে, কেবল সেসব লাশই সমাধান না হওয়া পর্যন্ত মর্গের হিমাগারে রেখে দেয়া হয়।
একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার হিসেব অনুযায়ী চলতি বছরের জুলাই মাসে অথাৎ জুলাই মাসেও রাজধানী ঢাকা থেকে ১১৪টি লাশ দাফন করা হয়েছে বেওয়ারিশ হিসেবে। ২০১৬/১৭ অর্থ বছরে ১ হাজার ৩০০ লাশ বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয়েছে।
এর মধ্যে জুলাই মাসে ১০৯টি, আগস্ট- ১১১টি, সেপ্টেম্বর-১১২টি, অক্টোবর -১২২টি, নবেম্বর-১০৯টি, ডিসেম্বর-১০৮টি, জানুয়ারি-১০১টি, ফেব্রুয়ারি-৬৮টি, মার্চ-১১১টি, এপ্রিল-১১৮, মে-১২৭, জুন -১০৪টি লাশ দাফন করা হয়। এর আগে ২০১৫/১৬ অর্থ বছরে মোট ১৩৫৭টি লাশ দাফন করা হয়।
পরিসংখ্যান বলছে, ২০০৬ সালে ২০৯৯ টি, ২০০৭ সালে ২২৫৯ টি, ২০০৮ সালে ১৮৬৭টি, ২০০৯ সালে ১৯৮১ টি, ২০১০ সালে ১২০৪ টি, ২০১১ সালে ১১৯২টি, ২০১২ সালে ১২৪৭ টি, ২০১৩ সালে ১৪৩৭, ২০১৪ সালে ১৪৯৫ টি, ২০১৫ সালে ১২৮৪ টি , ২০১৬ সালে ১৪৩০ টি লাশ বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয় আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামের পক্ষ থেকে।
এদিকে বেওয়ারিশ লাশগুলোর শনাক্তকরণ প্রক্রিয়া গতানুগতিক ও দায়সারা হওয়ায় বেওয়ারিশ লাশগুলোর পরিচয় নিরূপন করা সম্ভব হয় না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন প্রযুক্তির ব্যবহার করা গেলে অনেক লাশের পরিচয় নির্ণয় করা সম্ভব হতো। তবে প্রশাসনের দাবি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই লাশ বিকৃত থাকায় পরিচয় পাওয়া সম্ভব হয় না। আঞ্জুমানের তথ্যমতে রাজধানীতে প্রতিদিন গড়ে ৪ টি লাশ বেওয়ারিশ দাফন করা হয়।
অজ্ঞাত নারী-পুরুষের এসব লাশের নাম-পরিচয় আঞ্জুমানের কাছেও নেই। বিভিন্ন হাসপাতাল মর্গ ও থানা পুলিশের কাছ থেকে প্রতিষ্ঠানটি এসব লাশ গ্রহণ করে ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী কেবল দাফন করে। পঁচা ও গলিত লাশগুলো গ্রহণের সময় সংশ্লিষ্টরা আঞ্জুমানের হাতে কেবল পুলিশের সুরতহাল রিপোর্টটি তুলে দেন।
আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামের সহকারী পরিচালক (সার্ভিস) মাহমুদুল হাসান জানান, আঞ্জুমানের পক্ষ থেকে কোনও বেওয়ারিশ লাশের নমুনা ও ছবি সংরক্ষণ করা হয় না। পুলিশ ও মর্গ কর্তৃপক্ষ বেওয়ারিশ ঘোষণা করে তাদের কাছে হস্তান্তর করলে ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী তারা লাশ দাফন করে। পুলিশের কাছেই বেওয়ারিশ লাশের ছবি ও পোশাক সংরক্ষণ করে থাকে। বেওয়ারিশ লাশগুলো যখন তারা হাতে পান, তখন লাশগুলো থাকে বিকৃত, পঁচা ও গলিত। চেনার কোনও অবস্থা থাকে না।
ঢাকা মেডিকেল থেকে শুরু করে কোনও মেডিকেলেই বেওয়ারিশ লাশের তালিকা পাওয়া যায় না বলে জানিয়েছেন ঢামেক ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডা. সোহেল মাহমুদ।

http://www.dailysangram.com/post/295126-