৭ আগস্ট ২০১৭, সোমবার, ১০:২৬

দেখা অদেখা

শুদ্ধাচারের কৌশল কেন বাক্সবন্দী

সালাহউদ্দিন বাবর

সম্প্রতি সিনিয়র সিটিজেন ও আমাদের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত তার জীবনের অভিজ্ঞতা ও অভিজ্ঞান থেকে কিছু কথা বলেছেন, যা সব মহলে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। তিনি বলেছেন, দুর্নীতি আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়েছে। দুর্নীতিতে আমরা সবাই নিমজ্জিত। সবাই যদি দুর্নীতিতে নিমজ্জিত না থাকত তাহলে দুর্নীতি হতো না। যাদের ক্ষমতা আছে তারাই বেশি দুর্নীতি করে। সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কার্যালয়ে এক অনুষ্ঠানে অর্থমন্ত্রী এ কথাগুলো বলেন। দেশে শুধু যে দুর্নীতির প্রসার ঘটেছে, তা নয়। রাষ্ট্রাচারে সমস্যা রয়েছে, জাতির শিক্ষাঙ্গনে দুরাচার, অসৎ ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্যে এখন সাধারণ মানুষের জীবন ওষ্ঠাগত। নারী ও শিশু নির্যাতন সব মাত্রা অতিক্রম করেছে। নকল-ভেজাল খাদ্য ও ওষুধে দেশ ছেয়ে গেছে। নানামুখী অবক্ষয় গ্রাস করতে চলেছে সব নীতিনৈতিকতা। কোনো কিছুই আর বাঁধ মানছে না। যারা এ অববস্থার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে, সেই প্রশাসনই নীরব। তারা সব কিছু দেখেও চোখ বুজে আছেন। এভাবে সব কিছু যদি বিনা প্রতিরোধে চলতে থাকে, তাহলে আমাদের সব অর্জন শেষ হয়ে যাবে। তাই এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে।
তাই এখন সময় এসেছে জাতীয় শুদ্ধাচারের আন্দোলন গড়ে তোলার। এ জন্য একটি জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশলপত্র তৈরি হয় ২০১২ সালের অক্টোবর মাসে। এই কৌশলপত্রে শুদ্ধাচার বলতে বোঝানো হয়েছে নৈতিকতা ও সততা দিয়ে প্রভাবিত আচারণগত উৎকর্ষ। সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত এ সম্পর্কিত একটি নিবন্ধে আলোচনা করা হয়েছে। ব্যক্তিপর্যায়ে এর অর্থ হলো কর্তব্যনিষ্ঠা ও সততা তথা চারিত্রিক নিষ্ঠা। সার্বিক বিচারে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাহী বিভাগ ও জনপ্রশাসন, জাতীয় সংসদ, বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন, অ্যাটর্নি জেনারেল, সরকারি কর্মকৌশল, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়, ন্যায়পাল, দুর্নীতি দমন কমিশন ও স্থানীয় সরকার এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে রাজনৈতিক দল, বেসরকারি খাতের শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, এনজিও ও সুশীলসমাজ, পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও গণমাধ্যমকে শুদ্ধাচার বাস্তবায়নের জন্য যে শুদ্ধাচার কৌশলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল সাম্প্রতিক এক জরিপে বলেছে, কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের নাম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আসছে। মাদকের বিস্তৃতি যখন শহর থেকে গ্রামে পৌঁছেছে। সন্ত্রাসী সন্তানের পিতা এখন বুক ফুলিয়ে হাটে, শিক্ষক ছাত্রদের হাতে নিগৃহীত হন, নারী নির্যাতন অপ্রতিরোধ্য ও অর্থবিত্ত এখন ক্ষমতার উৎস হয়ে দাঁড়ায়, নীতিনৈতিকতা সমাজ থেকে হারিয়ে গেছে। বৃদ্ধ বয়সে পিতামাতা এখন অপাঙ্ক্তেয়। এই পর্যায়ে শুদ্ধাচার আন্দোলনকে জোরদার করা ও সমাজে ছড়িয়ে দেয়া একান্ত কর্তব্য। সরকারের তৈরি শুদ্ধাচার কৌশলপত্র এখন বাক্সবন্দী। প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে আর এসব কৌশলপত্র প্রণয়নের যৌক্তিকতা কী, সমাজ তো যাচ্ছে রসাতলে।
সুশাসন ও শুদ্ধাচারের আন্দোলন প্রথমে সরকারকেই শুরু করতে হবে। সুশাসন ও আইনের শাসন ছাড়া শুদ্ধাচারের সূচনা করা সম্ভব নয়। তাই সুশাসন আইনের শাসন এবং শুদ্ধাচারকে একসাথে অগ্রসর হতে হবে। শুদ্ধাচারের সূচনা হোক সরকারের প্রশাসন থেকে। এ ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য বিশেষ করে পুলিশ বাহিনীকে প্রথমে শুদ্ধাচারের আদর্শ ও কৌশলের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। তাদের অনিয়ম করার বহু অভিযোগ রয়েছে। শুদ্ধাচারের আন্দোলনে সরকার যেসব হাতিয়ার ব্যবহার করবে, তার মধ্যে এই বাহিনীকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে। তারা যদি এই নীতির বিষয়গুলো ভালো করে রপ্ত করতে ও অনুশীলন করতে সক্ষম না হয়, তাহলে সরকারের আরো যত সংস্থা রয়েছে সবাই এই সময়ে বিজয়ী হতে প্রথমে নিজেদের যোগ্য করে নিতে হবে। রাষ্ট্রে বহু ক্ষেত্রেই শুদ্ধাচারের বিচারে মানোত্তীর্ণ নয়। এ নিয়ে বিবেচনায় আনার বহু বিষয় রয়েছে। তার সংক্ষিপ্ত কয়েকটি বিষয় নিয়ে কথা বলা যেতে পারে।
দেশে আজ অসাধু ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য এতটা বেড়েছে যে, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা মারাত্মকভাবে কমে যাচ্ছে। কারণে-অকারণে যেকোনো অজুহাতে খাদ্যদ্রব্যের দাম বাড়িয়ে অতিরিক্ত মুনাফা করছে। এটা সব সময় লক্ষ করা গেছে, এসব অসাধু ব্যবসায়ী খাদ্যদ্রব্যসহ বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী মজুদ করছে। বাজারে কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করে পণ্যের দাম বাড়িয়ে বিপুল অর্থ তুলে নিচ্ছে। কৃত্রিম মজুদের ব্যাপারে দেশে আইনকানুন রয়েছে বটে, কিন্তু এর যথাযথ প্রয়োগ নেই। প্রশাসন এখানে এসব সমাজশত্রুদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে অক্ষম। আর এর শিকার হচ্ছে দেশের সাধারণ মানুষ। এসব অসাধু বণিক এতটা শক্তিশালী যে, তাদের বিরুদ্ধে যারা ব্যবস্থা নেবে সেই প্রশাসনকেই তারা হাত করে নেয়। বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দিলে এসব সমাজশত্রুরা মানুষের দুর্ভোগকে পুঁজি করে তৎপর হয়ে ওঠে। এরা রাষ্ট্রযন্ত্রকে প্রভাবিত করতে চাপ ও অর্থ ব্যবহার করে থাকে। রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন সিদ্ধান্তও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়ার উদ্যোগ হলে তাকে প্রভাবিত করার যথেষ্ট শক্তি এরা অর্জন করে আছে। শক্তিধর কিছু ব্যবসায়ী সমাজে নানা অপকর্ম অপরাধের সাথে জড়িত। অর্থের দাপটে নানাভাবে সমাজে প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠা করে আছে। ব্যবসায় নীতিবোধ জাগ্রত করার উদ্যোগ থাকা চাই।
এক শ্রেণীর মানুষ তথা অসৎ ব্যবসায়ী মানুষের জীবন পণবন্দী করে রাখে। এরা খাদ্যে ভেজাল মিশিয়ে তা বাজারজাত করে। এসব ভেজাল পণ্য খেয়ে মানুষ হাজারো রোগশোকে ভোগে। এসব ভেজাল পণ্য বাজারজাত করে অসাধু ব্যবসায়ীরা বিপুল অর্থের মালিক হয়ে ওঠে। বাজারে এই ভেজাল ও নি¤œমানের দ্রব্য ব্যাপক ছড়িয়ে আছে। এদের বিরুদ্ধে সরকারি অভিযান নগণ্য। এই সমস্যা মারাত্মক ক্ষতি করছে মানুষকে, কিন্তু দুঃখ হচ্ছে এসব নি¤œমানের ও ভেজাল দ্রব্য প্রতিরোধের জন্য বিধিবিধানের কমতি নেই বটে, কিন্তু তার সুষ্ঠু প্রয়োগ নেই। এর বিরুদ্ধে জনসচেতনতা সৃষ্টির প্রয়াস লক্ষ করা যায় না। একই সাথে বাজারে আছে নকল-ভেজাল ও নি¤œমানের ওষুধ। ওষুধ মানুষের প্রাণ রক্ষার জন্যই তৈরি, কিন্তু নকল-ভেজাল নি¤œমানের ওষুধ সেবন করে মানবদেহের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। বহু ক্ষেত্রে মানুষের জীবনকেও বিপন্ন করে। এসব খেলে রোগ কমে না, বরং তা আরো মারাত্মক আকার ধারণ করে। মানুষের নৈতিক অবস্থার এতটা বিপর্যয় হয়েছে যে, এরা জনগণের জীবন-মৃত্যু নিয়ে ব্যবসায় ফেঁদে বসেছে। যারা এ বিষয় দেখবেন এবং ব্যবস্থা নেবেন তাদের নির্লিপ্ততা এতটা যে, তারা মানুষের দায়দায়িত্ব ভুলে বসে আছেন। এগুলো মানবতা তলিয়ে যাওয়ার লক্ষণ।
ইসলামের অশুদ্ধ শিক্ষা ও মনগড়া ব্যাখ্যা নিয়ে গোটা বিশ্বসহ বাংলাদেশে ইসলামের নামে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড শুরু হয়েছে। ফলে পৃথিবীব্যাপী ইসলামের অনুসারী মুসলিম জনগোষ্ঠী মারাত্মক বিপাকের মুখে। বাংলাদেশে বেশ কিছু তরুণ ইসলামের অশুদ্ধ শিক্ষা ও ভুল ব্যাখ্যায় বিভ্রান্ত হয়ে সন্ত্রাসী কার্যক্রম শুরু করেছে। এদের তৎপরতা কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এলেও দেশে বিভিন্ন স্থান থেকে এখনো বিভ্রান্ত সন্ত্রাসী কাজে সম্পৃক্ত তরুণদের আটক করা হচ্ছে। এসব বিভ্রান্ত যুবক অবস্থাসম্পন্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্য। জানা গেছে, এসব তরুণ ইসলামের নামে জিহাদে অংশ নেয়ার কথা বলে। তবে এসব তরুণ সত্যিকারের ইসলাম ও জিহাদের তাৎপর্য বোঝে না। তাদের শিক্ষার কোনো স্তরেই তারা শিক্ষালয় থেকে বা পরিবার থেকে ইসলামের সত্যিকার স্বরূপ শেখেনি। আমাদের শিক্ষায় ধর্মীয় সুনীতি নৈতিক শিক্ষার কোনো ব্যবস্থা নেই। মানুষের শুদ্ধাচার অনুশীলনে নৈতিকতার মূল্য সমধিক। কিন্তু আমরা তা চর্চা করি না। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীদের ধর্ম ও নৈতিকতার অনুশীলন নেই। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র শুদ্ধ হয় সূচিতা লাভ করে, কিন্তু দেশে শিক্ষা ব্যবসায় প্রণয়ন করেন তাদের মধ্যে এ বিষয়টি জাগ্রত হয় না। ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে যারা শিক্ষাকার্যক্রম শেষ করে সমাজে প্রবেশ করে তারা বৈষয়িক ও বস্তুবাদই নিয়ে আসে। ন্যায়-অন্যায়, ভালো-মন্দ এই বিবেচনা তাদের মধ্যে জাগ্রত হয় না। এরাই সমাজ ও রাষ্ট্রের কর্ণধার হয়। তাদের কাছ থেকে সুনীতি-সূচিতার আশা করা বাতুলতা মাত্র। বিশ্বাসী মানুষ যারা তাদের এই আস্থা রয়েছে যে, এই পৃথিবীর জীবন একমাত্র জীবন নয়। স্রষ্টা মানুষের সুকর্ম ও দুষ্কর্মের হিসাব নেবেন। চূড়ান্ত বিবেচনায় সেই হিসাবের ফলাফলের ওপরই নির্ভর করবে মানুষের সার্বিক সাফল্য ও ব্যর্থতা। তা ছাড়া জীবন একটাই, নিজেকে শুধরানোর জন্য আর ফিরে আসার কোনো অবকাশ নেই। নিয়ত দুর্নীতি ও অন্যায়ের দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাত চলছে। এ দু’টি থেকে সঠিক পথ বেছে নেয়ার পরীক্ষায় তারাই সাফল্য অর্জন করবেন, যারা নিজের বিবেককে পরিশুদ্ধ করে রাখবেন।
আমাদের বড় গলদ হচ্ছে শিক্ষাব্যবস্থায়। এখানে নীতিনৈতিকতার কোনো বালাই নেই। প্রতিটি ধর্ম সুন্দর পরিশুদ্ধ জীবন যাপনের শিক্ষা দিয়ে থাকে। উন্নত নৈতিক চরিত্র গঠনের সোপান গড়ে তোলে। কিন্তু আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় এসব অনুশীলন নেই। তাই দেখা যায় শিক্ষায় নৈতিক চরিত্র গঠনের দেউলিয়াত্ব। শিক্ষাকেন্দ্র থেকে সুনাগরিক ও দায়িত্বশীল মানুষ গঠনের কোনো প্রয়াস নেই। শিশুদের জন্য আদর্শ মানুষ অনুসরণের কোনো ব্যবস্থা নেই। যার মাধ্যমে শিশুরা অনুপ্রাণিত হতে পারে। উচ্চ ক্ষেত্রে চলছে চরম সঙ্কট। সেখানে সুনীতি, সৎ নাগরিক ও আদর্শ মানুষ হওয়ার শিক্ষার পরিবর্তে চর্চা হচ্ছে অস্ত্রের খেলা ও উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্রদের অস্ত্র নিয়ে মহড়া এখন নিত্যদিনের ব্যাপার। ছাত্রসংগঠনগুলো নিজেদের মধ্যে অন্য সংগঠনের অস্ত্র নিয়ে পরস্পরকে আক্রমণ-প্রতি আক্রমণ করছে। এতে হতাহত হচ্ছে বহু ছাত্র। ছাত্ররাজনীতিতে ছাত্রদের সঙ্কট সমস্যা নিয়ে কোনো কর্মসূচি না থাকলেও চলছে দেশের রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে নেই শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ। যেখান থেকে দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নেতৃত্বে যোগ্য প্রজন্ম তৈরি হবে। তার উদ্দেশ্য এখন ব্যাহত হচ্ছে। এতে জাতির ভবিষ্যৎ হয়ে উঠছে অন্ধকারাচ্ছন্ন। শিক্ষাব্যবস্থায় একটা নতুন বিষয় হালে দেখা দিয়েছে। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকেরা পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস করে দিচ্ছেন অর্থের বিনিময়ে। শিক্ষার মহান চেতনা যেন শেষ হয়ে যাচ্ছে।
আরেকটি সমস্যা সমাজকে বিশেষ করে তরুণসমাজকে ধ্বংসের দুয়ারে নিয়ে চলেছে। আর সেটা হলো মাদকের ভয়াবহ বিস্তার। দেশের তরুণসমাজের একটি অংশ মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছে। দেশের বিভিন্ন সীমান্তবর্তী এলাকা দিয়ে বিপুল পরিমাণ মাদকদ্রব্য বিভিন্ন পথে ঢুকছে। এসব মাদক ব্যবসার সাথে সমাজের শক্তিশালী অংশ জড়িত। প্রায় প্রতিদিন বিভিন্ন অঞ্চলে মাদক ধরা পড়ছে বটে, কিন্তু বিষাক্ত এসব মাদক স্রোতের মতো দেশে প্রবেশ করছে। দেশের পশ্চিম সীমান্ত দিয়ে আসছে ফেনসিডিল আর দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করছে ইয়াবা। দেশের এই অবক্ষয়ের পরিপ্রেক্ষিতে সমাজবিজ্ঞানীরা চিন্তিত হলেও সরকারের প্রশাসন একে অতিরিক্ত গুরুত্ব দিয়ে প্রতিরোধের ব্যবস্থা নিচ্ছে না। মাদক প্রতিরোধে আইন আছে, কিন্তু তার প্রয়োগ যথাযথভাবে হচ্ছে না। মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা আদালতে পেশ করে তাতে যথেষ্ট ফাঁকফোকর থাকে। ফলে এদের শাস্তির বিধান করা কঠিন হয়ে পড়ে। এটাও মাদক প্রতিরোধের ক্ষেত্রে একটি অন্তরায়। মাদকের বিরুদ্ধে প্রচার তথা তরুণদের সতর্ক করার ব্যাপারে সম্মিলিত উদ্যোগের অভাব রয়েছে। বহু তরুণ মাদকের জালে আটকা পড়েছে এর ক্ষতিকর প্রভাব না জানার জন্য। মাদকাসক্তদের নিরাময়ের যে সরকারি উদ্যোগ তা খুবই সীমিত। মাদকের প্রচারের ক্ষেত্রে অভিভাবক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের এ নিয়ে সতর্ক করার বিশেষ কোনো আয়োজন নেই। মাদকের বিরুদ্ধে একটি আন্দোলন গড়ে তোলায় সরকারকে উপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে। সব ধর্মে নেশার বিরুদ্ধে অবস্থান রয়েছে। তাই সব ধর্মীয় বিশ্বাসের নেতাদের মাদকের বিরুদ্ধে দাঁড় করানোর ব্যবস্থা নিতে হবে। ধর্মীয় নেতারা মাদকের বিপক্ষে কথা বললে তা কাজে আসবে। দেশের চিকিৎসক সমাজ এ ক্ষেত্রে বিরাট দায়িত্ব পালন করতে পারে। তারা এ নিয়ে বিশেষজ্ঞের মতামত দিয়ে সাধারণ মানুষকে সতর্ক করে তুলতে পারে। ছাত্রদের পাঠ্যক্রমে মাদকের ব্যবহার নিরুৎসাহিত করার সূচি রাখা আবশ্যক। গণমাধ্যমগুলোর এই প্রচারকাজে বিরাট ভূমিকা রাখতে সক্ষম। সরকারকে এসব নিয়ে ভাবতে হবে।
সমাজে নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা যে ভয়াবহ রূপ নিয়েছে, তা দেশের মানুষকে আতঙ্কিত করে তুলেছে। পত্রিকার পাতা খুললেই নারী, কিশোরী ও শিশু ধর্ষণের ভয়াবহ চিত্র পাওয়া যাচ্ছে। সমাজের এক শ্রেণীর দুর্বৃত্ত এ কর্মে এতটা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে যে, শঙ্কিত না হয়ে উপায় নেই। একটি মানবাধিকার রিপোর্ট অনুসারে, গত জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ৩৭১ জন নারী-শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এই সময় যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে ১২৪ জন। যৌতুক সহিংসতায় আক্রান্ত হয়েছে ১২৮ জন। এসিড সহিংসতায় পড়েছে ৩০ জন। আক্রান্তরা বিচার চাইতে গিয়ে ভয়ভীতির মুখোমুখি হচ্ছে। কোথাও কোথাও এসব অপকর্মের সাথে জড়িত ক্ষমতাসীন কর্মী-সমর্থকেরা। একই সাথে নারী-পুরুষের পরকীয়ায় নারী-পুরুষ খুন হচ্ছে। বস্তুত দেশে এখন এসব দুর্যোগের মতো এসে উপস্থিত হয়েছে। কাজ দেয়ার কথা বলে বহু নারী ও মেয়েশিশু পাচার হয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। এসব নারীকে বিদেশে তো পাচার করছেই, সেই সাথে তাদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে পতিতালয়ে। নারীরা এখন নানাভাবে অত্যাচারের শিকার। ভারতের বিভিন্ন পতিতালয়ে পাচার হওয়া নারীদের স্থান হচ্ছে। নারীদের সুরক্ষার তেমন কোনো সরকারি উদ্যোগ দেখা যায় না।
এ ছাড়া আরো বহু স্থানে দুর্নীতি-অবক্ষয় বিস্তার লাভ করেছে। সম্প্রতি বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি ও অর্থ আত্মসাতের বহু ঘটনা ঘটছে। যারা এসব প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার তারাই আইনকানুন ভঙ্গ করে অন্যায়কে প্রশ্রয় দিচ্ছে। অর্থমন্ত্রী বলছেন, যারা ক্ষমতাধর তারাই দুর্নীতিতে নিমজ্জিত। এসব আর্থিক প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতির সাথে যারা জড়িত দেখা গেছে, তারা সবাই ওপর মহলের কর্মকর্তা। আর এসব উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা প্রতিষ্ঠানে নিযুক্তি পেয়েছেন রাজনৈতিক বিবেচনায়। যারা রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল তাদের এটা উপলব্ধি করা উচিত তাদের দায়িত্ব রাজনৈতিক অনুসারীদের মঙ্গল করতে গিয়ে দেশের ক্ষতি করা সমীচীন নয়, বরং অনুসারীদের নয়, দেশের মানুষের কল্যাণের জন্য তারা ক্ষমতায় আসীন হয়েছেন।
ক্ষমতাসীন রাজনীতিকেরা দেশ ও জাতির উন্নয়ন করে জনগণের জীবনমান উন্নত করবেন। অতি দ্রুত দেশকে একটি মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করার ওয়াদা তারা ব্যক্ত করেছেন। তাদের এই আশাবাদের সফলতা সবার কাম্য, কিন্তু এ পথে অগ্রসর হওয়ার ক্ষেত্রে যেসব প্রতিবন্ধকতা সেগুলো প্রথমে দূর করতে হবে। তার কর্মকৌশল তৈরি, যোগ্য কর্মী বাছাই, সুষ্ঠু পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং কর্ম উদ্যোগ নেয়া জরুরি। এসব করার সূচনায় প্রথমেই করতে হবে রাষ্ট্রাচারে শুদ্ধতার নীতি অবলম্বন করা। ২০১২ সালে শুদ্ধাচারের কর্মকৌশল প্রণীত হলেও তার বাস্তব অনুশীলন এখনো শুরু হয়নি। তাই এ কথা মনে করা কঠিন যে, সরকারের উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন কতটা বাস্তব হবে। সব প্রতিষ্ঠান থেকে অন্যায়-অনিয়মগুলো ঝেড়েমুছে ফেলতে হবে।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/241999