৬ আগস্ট ২০১৭, রবিবার, ১১:১০

সিন্ডিকেট না সরকার শক্তিশালী?

সিন্ডিকেটের কবলে আবারও চালের বাজার। বাজার নিয়ন্ত্রণে শুল্ক কমিয়ে চাল আমদানি করলেও ইতিবাচক প্রভাব নেই। উল্টো চালের দাম বাড়ছে। ভিয়েতনাম থেকে শুল্কমুক্ত সুবিধায় দুইমাসে দেড় লাখ টন চাল আমদানি এবং ভারত, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার ও নতুন করে যুক্ত হওয়া কম্বোডিয়া থেকে লাখ লাখ টন চাল আমদানির চুক্তির কোনো প্রভাব পড়েনি বাজারে। আমদানির ফলে মোটা চালের দাম কিছুটা কমলেও বেড়েই চলছে সরু চালের দাম। এতে করে বিপাকে পড়েছে মধ্য আয়ের মানুষরা। এখন জনমনে প্রশ্ন সরকার না সিন্ডিকেট শক্তিশালী?
তিন মাস আগে পাইকারি পর্যায়ে মোটা চাল বিক্রি হয়েছিল ৩২ থেকে ৩৪ টাকা কেজি। মাঝখানে লাফিয়ে লাফিয়ে ৪৮ থেকে ৪৯ টাকায় উঠে, এখন বিক্রি হচ্ছে ৪৪ থেকে ৪৫ টাকায়। আর খুচরা পর্যায়ে বিক্রি হচ্ছে ৪৭ থেকে ৪৯ টাকায়। এই হিসাবে পাইকারি পর্যায়ে চালের দাম কেজিতে কমেছে ৪ টাকা আর খুচরা পর্যায়ে কমেছে ৩ থেকে ৪ টাকা।
বাজারের এই চিত্র সহজেই বলে দিচ্ছে শুল্কমুক্ত চাল আমদানির সুযোগ হঠাৎ লাফিয়ে ওঠা চালের বাজারে খুব একটা প্রভাব ফেলতে পারেনি। সরেজমিনে চালের বাজার ঘুরে আড়ৎদার ও মিল মালিকদের সঙ্গে আলাপ করে দামের এই চিত্র পাওয়া গেছে।
জানা গেছে, আমদানির খবরে মোটা চালের দাম কেজিতে ৪ টাকা কমলেও গত সপ্তাহে আবার বস্তা (৫০ কেজি) বেড়েছে ১৫০ টাকা। অর্থাৎ কেজিতে আবার বেড়েছে ৩ টাকা। আবারও আগের বাড়তি দামে বিক্রি হচ্ছে মোটা। আর সরু চালের দাম একে বারেই কমেনি। উল্টো কেজি প্রতি আরও বেড়েছে ২/৩ টাকা। তাহলে শুল্ক মুক্ত আমদানি করে জনগনের কি লাভ হলো।
চালের দাম বাড়ার জন্য সম্পূর্ণ খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তাদের দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। চালের বাজারের দাম বাড়ার প্রকৃত কারণ না খুঁজে তারা সরকারকে ভুল বার্তা দিয়েছে। আর বর্তমানে যে পরিমাণ আমদানির হাঁকডাক শোনা যাচ্ছে, আসলে সেই পরিমাণ চাল আমদানি হচ্ছে না।
বাংলাদেশ অটো মেজর এন্ড হাসকিং মিল ওনার্স এসোসিয়েশনের উপদেষ্টা মাহমুদ হাসান রাজু বলেন, দাম বৃদ্ধির জন্য সম্পূর্ণভাবে দায়ী খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তারা। দেশে যখন প্রচুর পরিমাণে হাইব্রিড ধান উৎপাদন হয়েছে, তখন তারা বলছেন, মানুষের রুচি পরিবর্তন হয়েছে। এই ধান আর উৎপাদন দরকার নাই। এখন থেকে চিকন চালের ধান উৎপাদন বাড়াতে হবে। এরপর কৃষকরা প্রতি একরে ৮০ থেকে ১০০ মন উৎপাদন হওয়া হাইব্রিড ধান চাষ থেকে সরে এসেছে। কিন্তু চিকুন চালের ধান প্রতি একরে উৎপাদন হয় মাত্র ৪০ থেকে ৫০ মণ। এ কারণে এই ঘাটতি দেখা দিয়েছে। কারণ শহরের তুলনায় গ্রাম পর্যায়ে মোটা চালের ব্যাপক চাহিদার খবর কর্মকর্তারা রাখেন না।
খাদ্য কর্মকর্তারা সরকারকে খাদ্যের সঠিক ধারণা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। ভুল বার্তা দেয়ায় খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়া দেশ এখন ঘাটতিতে পড়েছে- যোগ করেন তিনি।
রাজধানীর কারওয়ান বাজার, হাতিরপুল ও কাঁঠালবাগানসহ কয়েকটি মার্কেটে সরেজমিনে দেখা গেছে, সাধারণত নিম্নবিত্তরা যে চাল খেয়ে জীবন ধারণ করে সেই মোটা চাল পাইকারি প্রতিকেজি ৪৪ থেকে ৪৫ টাকা আর খুচরা পর্যায়ে বিক্রি হচ্ছে ৪৭ থেকে ৪৯ টাকায়। আর মিনিকেট পাইকারি বিক্রি হচ্ছে ৫৩ থেকে ৫৪ টাকা, খুচরায় বিক্রি হচ্ছে ৫৮ থেকে ৬০ টাকা। আটাশ চাল (ইরি জাতীয় চাল) পাইকারি ৪৯ থেকে ৫১ টাকা আর খুচরায় বিক্রি হচ্ছে ৫৩ থেকে ৫৪ টাকা।
চালের আড়ৎদাররা বলছে, সরকারি উদ্যোগে চাল কল স্থাপন করলে সিন্ডিকেট থাকবে না। কেজি প্রতি ব্যবসায়ীরা নির্ধারিত একটা মুনাফা করে থাকে। সেটা দাম বাড়লেও হবে, কমলেও হবে। কিন্তু চাল নিয়ে আসলে কোথায় চালবাজি হচ্ছে তা খুঁজে বরে করতে হবে সরকারকে। ভেতরের সমস্যা বের না করে যতই আমদানি করুক খুব বেশি কাজে আসবে না। এছাড়া সরকারি উদ্যোগে চালের পাইকারি ও মিল পর্যায়ে দাম নির্ধারণ করে দেয়ার দাবিও জানান তারা।
এবার বোরো মৌসুমে আগাম বন্যায় সরকারি হিসাবেই হাওরে ছয় লাখ টনের মতো ধান নষ্ট হওয়ায় এবং খাদ্যবান্ধব কর্মসূচিতে (১০ টাকা কেজি দরের চাল) সাড়ে সাত লাখ টন চাল বিতরণ করায় সরকারি মজুদ তলানিতে নেমে আসে।
সংকট দেখা দেয়ায় চালের দামের লাগাম টেনে ধরতে ২৮ শতাংশ আমদানি শুল্ক থেকে ১৮ শতাংশ কমিয়ে ১০ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়। এরপর বিনা জামানতে ও বাকিতে চাল কেনার সুযোগ দেয় সরকার। বিদেশ থেকে কয়েক লাখ টন চাল আনার চুক্তি করা হয়। এর মধ্যে গত বৃহস্পতিবার কম্বোডিয়া থেকে এক বছরে ১০ লাখ টন চাল আমদানির চুক্তিপত্র করা হয়।
আমদানির পরও চালের দাম কমছে না কেন জানতে চাইলে কারওয়ান বাজারের হাজি ইসমাইল এন্ড সন্সের মাঈন উদ্দিন বলেন, এই প্রশ্নের জবাব ব্যবসয়ীরাও খোঁজে। আমদানি হচ্ছে সবাই জানে। কিন্তু যে পরিমাণ আমদানি হওয়ার কথা, সত্যিকারে তা আসছে কি-না খতিয়ে দেখা উচিত। কারণ উল্লেখযোগ্য হারে চাল আমদানি হচ্ছে। এখানে শুভঙ্করের ফাঁকি দেয়া হচ্ছে বলে মনে হয়।
আমদানির চুক্তি বেশি কাজে আসবেনা উল্লেখ করে ঠাকুরগাঁয়ের ন্যাশনাল রাইস মিলের মালিক মাহমুদ হাসান রাজু বলেন, সরকার শুল্ক কমিয়েছে। কিন্তু রপ্তানিকারক দেশগুলো দাম বাড়িয়েছে। ফলে আগের চেয়ে বেশি দামে কিনতে হয়। যে কারণে উল্লেখযোগ্যভাবে দেশের বাজারে দাম কমছে না।
কৃষকের ন্যায্য দাম নিশ্চিত করার জন্য চাল আমদানি নিরুৎসাহিত করতে ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে শুল্কহার ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২৫ শতাংশ করে সরকার। এর সঙ্গে রেগুলেটরি ডিউটি তিন শতাংশ যোগ হওয়ায় ব্যবসায়ীদের ২৮ শতাংশ শুল্ক গুণতে হয়। ফলে গত দেড় বছর ধরে বেসরকারি পর্যায়েও চাল আমদানি প্রায় বন্ধ ছিল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত জুন-জুলাই এই দুই মাসে চাল দুই হাজারেরও বেশি কোটি টাকার চাল আমদানির এলসি খোলা হয়। এলসি নিষ্পত্তির পর দুই মাসে দেশে প্রায় দেড় লাখ টন চাল এসেছে। আমদানি পর্যায়ে রয়েছে আরো অনেক চাল।
অনুসন্ধানে জানা যায়, দেশে প্রতি বছর গড়ে চালের চাহিদা প্রায় তিন কোটি ৫০ লাখ মেট্রিক টন। সে হিসেবে প্রতিদিন গড়ে চাল ব্যবহৃত হয় প্রায় ৯৬ হাজার টন। এ চালের এক-তৃতীয়াংশও যদি বাজার থেকে কিনে খাওয়া হয় তাতে দৈনিক চাল বিক্রি হয় ৩২ হাজার টনের মতো।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সচিব বলেন, বোরো মওসুমে ধান উৎপাদন হওয়ার কথা ১ কোটি ৯৫ লাখ মেট্রিক টন। কিন্তু বন্যার কারণে এবার ধান নষ্ট হয়েছে ৩ লাখ টন। এতে খাদ্য সংকট হবে না বলে মনে করেন তিনি। তার এই বক্তব্যের সাথে কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। যদি এত ধান উৎপাদন হয়ে থাকে তাহলে তা গেলো কোথায়। জানা গেছে, হাওর অঞ্চলের কৃষকরা তেমন চাল বিক্রি করতে পারে না। তাদের উৎপাদিত চাল দিয়ে তাদের সংসার চলে মাত্র। মূল বাণিজ্যিকভাবে ধান উৎপাদন হয়ে থাকে রাজশাহী, নওগাঁ, নাটর, চাপাই নবাবগঞ্জ, দিনাজপুর, পাবনা এবং বরিশালের কিছু অংশ। এসব এলাকায় এখনও বন্যায় ফসল হানির কোনো খবর পাওয়া যায়নি। অথচ হাওর অঞ্চলের বন্যার অজুহাতে ইতোমধ্যেই চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে মিল মালিকরা।বাজার নিয়ে এখনও সরকারকে সঠিক তথ্য দিচ্ছে না খাদ্য মন্ত্রণালয়ের চাল সিন্ডিকেট। তারা বলছেন ইতোমধ্যে বিদেশ থেকে ১৫ লাখ টন চাল আমদানি করা হয়েছে। এতে করে চালের আর সংকট থাকার কথা নয়। কিন্তু কোনোভাবেই চালের বাজার সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেই।
চাল আমদানির পরে মোটা চালের দাম কিছুটা কমলেও তা বেড়ে আগের অবস্থা ফিরে গেছে। এখন আবার চাল ৪৬-৪৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর সরু চাল কেজি প্রতি ২ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৬০-৬২ টাকায়। সরকারের বাজার মনিটরিং কমিটির কোনো উদ্যোগ নেই। এমনকি তারা জানে না চালের দাম আবারও বেড়েছে। কি পরিমাণ চাল আমদানি হয়েছে আর কি পরিমাণ চালের চাহিদা রয়েছে। মোটা চালের চাহিদা কত আর সরু চালের চাহিদা কত। এসব তথ্য না জেনেই গড়ে মোটা চাল আমদানি করছে। আর এ কারণেই সরু চালের দাম বাড়ছে।
অভিযোগ রয়েছে, মিল মালিকরা চালের দাম বাড়ানোর ইচ্ছা করলেই চাল বিক্রি বন্ধ করে তা মজুদ রাখেন। এতে করে বাজার চাহিদা বেড়ে যায় এবং সরবরাহ কমে যায়। ফলে কোনো কারণ ছাড়াই চাল দাম বাড়িয়ে থাকেন পাইকারি আড়তদাররা। আর এর প্রভাব পড়তে থাকে খুচরা বাজারে।
এদিকে চালের দাম বাড়ার জন্য খুচরা, পাইকারি ও মিলাররা একে অপরকে দায়ী করছেন। খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, পাইকারি বাজারে চালের দাম বাড়ার কারণে তারাও বাড়াতে বাধ্য হয়েছেন। আবার পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, মিল মালিকরা চালের সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছেন, একই সঙ্গে দামও বাড়িয়েছেন। ফলে তাদের কাছ থেকে বেশি দামে চাল কেনার কারণে বাজারেও বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে।
মূলত চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে মাত্র ৮/১০ মিল মালিক। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে অটো মিল মালিক এসোসিয়েশনের নেতারা বললেও অদৃশ্য কারণে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। উল্টো নিরাপরাধ ১০ হাজার মিল মালিককে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। অথচ তারা জানেনা কোনো অপরাধে তাদের কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।
সরকার বলছে আরও চাল আমদানি করা হবে। বাজারে মোটা চালের দাম কিছুটা কমেছে। আবার কি কারণে চালের দাম বাড়ছে তার কারণ আমাদের খুঁজে বেড় করতে হবে। তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, পরিকল্পনা না করে যতই চাল আমদানি করুক না কেন চালের দাম কমবে না। আসলে কি পরিমাণ চালের সংকট রয়েছে। আর কি পরিমাণ চাল আমদানি করা হয়েছে তা আগে জানতে হবে। আসলেই ব্যবসায়ীরা সে পরিমাণ চাল আমদানি করেছে কি না। না কি আমদানির নামে শুভাঙ্করের ফাকি দিচ্ছে তা খতিয়ে দেখা উচিত।

 

http://www.dailysangram.com/post/294944-