৬ আগস্ট ২০১৭, রবিবার, ১১:০৯

ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের দখলে চার নদীর তীর

হাঁটার রাস্তার নির্মাণব্যয়ের তারতম্য নিয়ে পরিকল্পনা কমিশনের প্রশ্ন

ডেমরা ইটখোলা এলাকায় বালু নদী দখল করে কারখানা নির্মাণ করা হলেও সংশ্লিষ্টরা প্রভাবশালী ও ক্ষমতাধর হওয়ায় কেউ প্রতিবাদ করার সাহস পাচ্ছেন না : মোহাম্মদ শরীফ
ঢাকার চার পাশে যে চারটি নদী রয়েছে তার তীরগুলোর বিভিন্ন জায়গা আজ অবৈধ দখলদারদের কবলে রয়েছে। মোট তীরভূমির পরিমাণ হলো ২২০ কিলোমিটার। বেশির ভাগ ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি তাদের ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য নদীর তীরভূমি অবৈধভাবে দখল করে রেখেছেন। অনেক ক্ষেত্রে তারা ব্যবসা পরিচালনার জন্য স্থায়ী বা পাকা কাঠামো নির্মাণ করেছেন বলে বিআইডব্লিউটিএর প্রকৌশল বিভাগের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। নদীর তীরে তিন ধরনের হাঁটার রাস্তার ব্যয়ের তারতম্য নিয়ে পরিকল্পনা কমিশন থেকে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। এখানে ওয়াকওয়ে নির্মাণ প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় ধরা হয়েছে বাঁধের জন্য ৬ কোটি ২০ লাখ টাকা, সাধারণ ওয়াকওয়ে ২ কোটি ৭০ লাখ টাকা ও পাইলের বা কলামের ওপর ৯ কোটি ১০ লাখ টাকা বলে বিআইডব্লিউটিএর প্রকল্প প্রস্তাবনায় উল্লেখ করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় প্রকল্পের পটভূমিতে উল্লেখ করেছে, রাজধানী ঢাকা বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা ও বালু নদী দিয়ে বেষ্টিত। অভ্যন্তরীণ নৌপথে যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের জন্য এসব নদীর তীরে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও টঙ্গীতে তিনটি অভ্যন্তরীণ নদীবন্দর রয়েছে। কিন্তু নদীর তীরভূমির বিভিন্ন জায়গা অবৈধ দখলদারদের কবলে রয়েছে। বুড়িগঙ্গা ও তুরাগ মিলে প্রায় ৪২ কিলোমিটার তীরভূমি রয়েছে; যা সম্প্রসারিত হয়ে আশুলিয়া থেকে বিজি মাউথ পর্যন্ত বিস্তৃত। যেখানে বুড়িগঙ্গা ও ধলেশ্বরী মিলিত হয়েছে। শীতলক্ষ্যার তীরে অবস্থিত নারায়ণগঞ্জ পোর্ট লিমিট ২৭ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। আর টঙ্গীতে তুরাগের তীরে অবস্থিত নৌবন্দরটির পোর্ট লিমিট প্রায় ৩৮ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। অননুমোদিত ও অপরিকল্পিত স্থাপনা নির্মাণ পানির স্বাভাবিক প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করছে। বিভিন্ন সময় বিশেষ করে ২০০৭ সাল থেকে দফায় দফায় তীরভূমি উচ্ছেদ করা হয়েছে। কিন্তু তা আবার অবৈধ দখলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ঢাকা মহানগরীর চার দিকে নদীর তীরবর্তী স্থানগুলোর ওয়াকওয়ে বা হাঁটার রাস্তা নির্মাণের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে গত ২০১৪ সালের অক্টোবরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে একটি সিদ্ধান্ত প্রদান করা হয়েছে। আর সে আলোকে সাড়ে আট শ’ কোটি টাকা ব্যয়ে এই ওয়াকওয়ে নির্মাণ প্রকল্পটি। চার বছরে প্রকল্পটি শেষ করার জন্য প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে।
এখানে প্রকল্পের আওতায় ওয়াকওয়ে বা হাঁটার পথ নির্মাণ ব্যয় নিয়ে খোদ পরিকল্পনা কমিশন থেকে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। তিনটি স্তরে ওয়াকওয়ে নির্মাণে প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় ব্যবধান অনেক বেশি। সাধারণ হাঁটার পথ নির্মাণ করা হবে ৩৫.৫১ কিলোমিটার; যার জন্য ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে ৯৫ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। এখানে প্রতি কিলোমিটার ব্যয় হবে ২ কোটি ৭০ লাখ টাকা। আর বাঁধের ওপর ১০.২৭ কিলোমিটার হাঁটার রাস্তা করা হবে। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৬৩ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। ফলে এখানে প্রতি কিলোমিটারে খরচ হবে ৬ কোটি ২০ লাখ টাকা। অন্য দিকে পাইলের বা কলামের ওপর ৫.৯২ কিলোমিটার হাঁটার রাস্তা করতে ব্যয় হবে ৫৩ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। এখানে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় হবে ৯ কোটি ১০ লাখ টাকা। কমিশন বলছে, প্রকল্পের কাজ করবে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ বা বিআইডব্লিউটিএ। প্রকল্পের মাটি কাটাসহ সব কাজ ঠিকাদার কর্তৃক সম্পাদন করা হবে। অথচ ২১ কোটি টাকা ব্যয়ে ছয়টি এক্সকেভেটর ক্রয়ের প্রস্তাব করা হয়েছে। এটি কোনোভাবেই যৌক্তিক নয়। এটিকে বাদ দিতে কমিশন পরামর্শ দিয়েছে বলে সূত্রে জানা গেছে।
আর বিআইডব্লিউটিএর প্রকৌশল বিভাগ বলছে, পাইলের ওপর ওয়াকওয়ে নির্মাণে প্রতি মিটারে ব্যয় হবে ৯১ হাজার টাকা, নদীর তীরে ওয়াকওয়ে নির্মাণে প্রতি মিটারে ২৭ হাজার টাকা এবং প্রতিটি আরসিটি সিঁড়ি নির্মাণে ব্যয় হবে ৩১ লাখ ১৮ হাজার টাকা। প্রতি মিটার সীমানা প্রাচীর নির্মাণে খরচ ১০ হাজার টাকা, কি ওয়ালে এক লাখ ৪৬ হাজার টাকা, তীর রক্ষায় প্রতি মিটারে ৪৪ হাজার টাকা। তবে তাদের প্রতিবেদন অনুযায়ী ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও টঙ্গী নদীবন্দর অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্পের একই খাতের ব্যয়ের চেয়ে এটিতে বেশি ধরা হয়েছে।
এ দিকে বিআইডব্লিউটিএ সূত্র বলছে, বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের মধ্যে সরকারি সম্পত্তি দখলের একটা প্রবণতা রয়েছে। সংস্থাটি বিভিন্ন সময়ে অবৈধভাবে দখলকৃত তীরভূমি উদ্ধার করলেও সমস্যা হলো পরে দখলদারদের হাত থেকে সংরক্ষণ করা। সংস্থাটির কোনো নিজস্ব নিরাপত্তা বাহিনী নেই। এমনকি বিশাল তীরভূমি পাহারা দিয়ে রাখার মতো পর্যাপ্ত জনবলও নেই। ফলে বিআইডব্লিউটিএ বারবার উচ্ছেদ কার্যক্রম পরিচালনা করেও সংরক্ষণে হিমশিম খাচ্ছে। এতে প্রচুর অর্থও ব্যয় হচ্ছে। জাতীয় অর্থনীতিও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ পর্যন্ত ২২০ কিলোমিটার তীরভূমির মধ্যে মাত্র ২০ কিলোমিটার হাঁটার পথ করা হয়েছে। এ প্রকল্পের মধ্যে ৫২ কিলোমিটার হাঁটার পথ নির্মাণ করা হবে। এখানে ১০ হাজার ৮২০টি পিলার নির্মাণ করতে হবে।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/241769