৬ আগস্ট ২০১৭, রবিবার, ১১:০৬

বিএসএমএমইউতে ভর্তি অস্ত্রোপচার গ্রীনলাইফে!

নিউরোসার্জারি বিভাগের এক সহযোগী অধ্যাপক এক লাখ টাকার বিনিময়ে বাইরে অস্ত্রোপচার করিয়ে পুনরায় হাসপাতালে নিয়ে আসেন * প্রয়োজনীয় তদন্ত শেষে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে : উপ-উপাচার্য

ডায়াবেটিস ও মেরুদণ্ডের সমস্যা নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগে ভর্তি হন হুসাইন আহমেদ (৬৪)। ১৫ জুলাই ভর্তির পর মেরুদণ্ডে ব্যথার তীব্রতা দেখে রোগীকে নিউরোসার্জারি বিভাগে রেফার করা হয়। নিউরোসার্জারি বিভাগের একজন সহযোগী অধ্যাপক রোগীকে দেখে বলেন, যত দ্রুত সম্ভব তার মেরুদণ্ডে অস্ত্রোপচার করা প্রয়োজন।


চিকিৎসকের কাছ থেকে সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়ার নিশ্চয়তা পেয়ে রোগী অস্ত্রোপচার করতে চাইলে ওই চিকিৎসক তাকে হাসপাতালের নিউরোসার্জারি বিভাগে বদলি না করে গোপনে রাজধানীর গ্রীনলাইফ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। এক লাখ টাকা চুক্তিতে সেখানে অস্ত্রোপচার শেষে আবার বিএসএমএমইউতে ফেরত পাঠান।

এমন চাঞ্চল্যকর ঘটনার নানা তথ্য যুগান্তরের কাছে তুলে ধরেন ওই রোগীর স্ত্রী দীল আফরোজ। তার কাছ থেকে জানা গেছে, ১৫ জুলাই লক্ষ্মীপুর জেলার দক্ষিণ জয়পুর গ্রামের হুসাইন আহমেদ (৬৪) শারীরিক সমস্যা নিয়ে বিএসএমএমইউর বহির্বিভাগে যান। সেখানে রোগীর শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করে তাকে ডি-ব্লকের ১৬ তলায় মেডিসিন বিভাগের ১৬/এ ওয়ার্ডে ১১নং নন-পেইং বেডে ভর্তি করা হয়। ভর্তির পর চিকিৎসা শুরু হলে তার ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে এলেও মেরুদণ্ডের ব্যথা বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে তার দুই পা অবশ হয়ে আসে। এ সময় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা গেছে, তার মেরুদণ্ডের দ্বিতীয় ল্যাম্বার কশেরুকা ভাঙা দেখতে পাওয়া যায়। তখন মেডিসিন বিভাগ থেকে নিউরো সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. খায়রুন নবী খানের কাছে রোগী রেফার করা হয়।

এ প্রসঙ্গে রোগীর স্ত্রী দীল আফরোজ যুগান্তরকে বলেন, ডা. খায়রুন নবী খান একদিন এসে রোগী দেখে যান। এ সময় তিনি রোগীর স্বজনকে বলেন, একটি বিশেষ পদ্ধতিতে চিকিৎসা করলে রোগী দ্রুত সেরে উঠবে। এর জন্য দেড় লাখ টাকা দিতে হবে। পরে তিনি এক লাখ টাকায় চিকিৎসা করাতে রাজি হন। সব ঠিক হলে তিনি ২৫ জুলাই বিএসএমএমইউতে ভর্তি অবস্থায় রোগীকে নিয়ে গ্রীন রোডে অবস্থিত গ্রীনলাইফ হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলেন। সেখানে ওইদিন বিশেষ পদ্ধতিতে (পারকিউটেনাস ভার্টিব্রপ্লাস্টি) রোগীর ভাঙা হাড়ের চিকিৎসা করেন তিনি। ওইদিন রাতেই পুনরায় বিএসএমএমইউতে আনা হয় রোগীকে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএসএমএমইউর নিউরোসার্জারি বিভাগের একজন চিকিৎসক যুগান্তরকে বলেন, হাসপাতালে ভর্তি রেখে অন্যত্র প্রাইভেট হাসপাতালে গিয়ে রোগীর অস্ত্রোপচার করা এবং পরে ফেরত আনার বিষয়টি করা হয়েছে অত্যন্ত গোপনে। নিয়মানুযায়ী কোনো চিকিৎসক এ ধরনের কাজ করতে পারেন না। তিনি বলেন, ওই চিকিৎসকের উচিত ছিল, মেডিসিন বিভাগ থেকে রেফার করার পর রোগীকে তার বিভাগে তার তত্ত্বাবধানে নিয়ে আসা। তারপর নিয়মানুযায়ী চিকিৎসা করা। বিএসএমএমইউর কোনো চিকিৎসক এখানে ভর্তি এবং চিকিৎসাধীন কোনো রোগীকে প্রাইভেট হাসপাতালে যাওয়ার পরামর্শ দিতে পারেন না। সে ক্ষেত্রে ভর্তি রোগী নিয়ে অস্ত্রোপচার করানোর তো প্রশ্নই আসে না।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ডা. খায়রুন নবী খান যুগান্তরকে বলেন, ‘এটি কোনো অস্ত্রোপচার নয়। এটি এক ধরনের পরীক্ষা। আমরা এ ধরনের পরীক্ষা করাতে রোগীদের প্রাইভেট হাসপাতালে নিয়ে যাই। এ রোগীর ক্ষেত্রে তাই করা হয়েছে। এ বিষয়টাকে অন্যভাবে নেয়ার কিছু নেই।’ বিএসএমএমইউর নিউরোসার্জারি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, তিনি যে পদ্ধতিতে গ্রীনলাইফ হাসপাতালে রোগীর চিকিৎসা করেছেন মেডিকেল সায়েন্সের ভাষায় তা ‘পারকিউটেনাস ভার্টিব্রপ্লাস্টি’ হিসেবে পরিচিত। মূলত একটি বিশেষ পদ্ধতিতে রোগীর মেরুদণ্ডের ভাঙা বা ক্ষয় হয়ে যাওয়া হাড়ে ‘বোন সিমেন্ট’ দিয়ে প্রলেপ দেয়াকে ভার্টিব্রপ্লাস্টি বলা হয়। বিএসএমএমইউর নিউরোসার্জারি বিভাগে প্রায় ১০ বছর ধরে এ ধরনের চিকিৎসা দেয়া হয়। এর জন্য কোনো রোগীকে বাইরে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন নেই।

ভর্তি রোগীকে হাসপাতালের বাইরে নিয়ে অস্ত্রোপচার করানো যায় কিনা জানতে চাইলে বিএসএমএমইউর উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দিন আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, এভাবে রোগী নিয়ে যাওয়ার কোনো নিয়ম নেই। কোনো চিকিৎসক যদি এটি করে থাকেন, তাহলে তিনি অন্যায় করেছেন। বিষয়টি প্রমাণ হলে অবশ্যই তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে গ্রীনলাইফ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. মো. মইনুল আহসান যুগান্তরকে বলেন, এখানে কোনো রোগীর অস্ত্রোপচার করতে হলে অবশ্যই কোনো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের লিখিত সুপারিশ থাকতে হবে। তারপর রোগীকে ভর্তি হতে হবে। তার শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করে অস্ত্রোপচার করা হবে। অস্ত্রোপচারের পর অন্তত একদিন তাকে হাসপাতালে অবজারভেশনে থাকতে হবে। সরকারি হাসপাতালের ভর্তি রোগীকে এখানে এনে অস্ত্রোপচার করিয়ে নেয়া যাবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ ধরনের কোনো সুযোগ নেই। যদি কোনো চিকিৎসক এটা করে থাকে তাহলে অন্যায় করেছেন।

http://www.jugantor.com/last-page/2017/08/06/145673/