৬ আগস্ট ২০১৭, রবিবার, ১১:০৫

অসদাচরণের প্রাথমিক তদন্ত

রাষ্ট্রপতির অনুমতি লাগবে না

সংবিধান বিশেষজ্ঞদের মধ্যে প্রায় ঐকমত্য দেখা যাচ্ছে যে, সুপ্রিম কোর্টের রায়ে পুনরুজ্জীবিত সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল শুধু সুপ্রিম কোর্টের জন্য নয়, নির্বাচন কমিশন, সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি), মহা হিসাব নিরীক্ষক, তথ্য কমিশন, মানবাধিকার কমিশন ও দুর্নীতি দমন কমিশনের ক্ষেত্রেও আগের মতোই প্রযোজ্য হবে। এবং সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের যে অভ্যন্তরীণ প্রাথমিক তদন্ত কমিটি হয়েছে, তার আওতায় শুধু বিচারকেরা নন, প্রথমবারের মতো রাষ্ট্রপতির অনুমোদন ছাড়াই সব সাংবিধানিক ও আধা সাংবিধানিক পদধারীরা একই কমিটির ও তদন্ত-প্রক্রিয়ার এখতিয়ারভুক্ত হবেন।
আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাষ্ট্রপতি অবশ্য নিজে থেকেই এসব ক্ষেত্রে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। মূলত প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শের ওপরই তাঁর সিদ্ধান্ত নির্ভরশীল।
ষোড়শ সংশোধনী মামলার অন্যতম অ্যামিকাস কিউরি এম আমীর-উল ইসলাম, সাবেক আইন ও বিচারমন্ত্রী শফিক আহমেদ ও বিশিষ্ট আইনজীবী শাহদীন মালিক এ বিষয়ে অভিন্ন মত দিয়েছেন। তাঁরা প্রথম আলোকে বলেন, কোনো একটি সাংবিধানিক হাতিয়ার সর্বোচ্চ আদালতে পুনরুজ্জীবিত হলে বিদ্যমান সংবিধান ও আইনের প্রাসঙ্গিক স্থানগুলোতে আপনাআপনি পরিবর্তন ঘটবে বলে ধরে নিতে হবে।
এম আমীর-উল ইসলাম বলেছেন, আগে যেভাবে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল সংশ্লিষ্ট সবার জন্য প্রয়োজ্য ছিল, পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ থেকে তা তাদের জন্য কার্যকর হয়ে গেছে। এখন এসব বিষয়ে যত আইন ছাপা হবে, সেগুলোর ক্ষেত্রে রায়ের আলোকে দরকারি পরিবর্তন আনার দায়িত্ব আইন ও বিচার মন্ত্রণালয়ের।
সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ বলেছেন, আচরণবিধিতে যে নতুন একটা ব্যবস্থা (প্রধান বিচারপতির দ্বারা তদন্ত) এসেছে, তার সুবিধা অন্যান্য সাংবিধানিক পদধারীরাও পাবেন। তা না হলে সেটা বৈষম্যমূলক হবে।
সাবেক বিচারপতি সৈয়দ আমিরুল ইসলাম অবশ্য নির্বাচন কমিশনসহ অন্যদের জন্য সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল প্রযোজ্য হিসেবে মত দিলেও প্রাথমিক অভিযোগ তদন্তের বিষয়টি শুধু বিচারপতিদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হবে। তিনি অভিমত দেন, বিষয়টি মূল রায়ের আদেশে নির্দিষ্টভাবে উল্লেখ থাকা উচিত ছিল। বিষয়টি ভবিষ্যতে রিভিউতে স্পষ্ট হতে পারে বলে তিনি উল্লেখ করেন। তবে এম আমীর-উল ইসলাম ও শফিক আহমেদ এ বিষয়ে কোনো রিভিউর প্রয়োজন আছে বলে মনে করেন না।
এদিকে রাষ্ট্রপতির পূর্ব অনুমোদন ছাড়াই প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে আপিল বিভাগের দুই জ্যেষ্ঠ বিচারপতির দ্বারা কোনো কথিত অসদাচরণের বিষয়ে প্রাথমিক তদন্ত ব্যবস্থার প্রবর্তনকে স্বাগত জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা। কিন্তু তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় সাংবিধানিক পদধারীদের অনেকে কিছুটা দ্বিধাও প্রকাশ করেছেন।
ষোড়শ সংবিধানের রায়ে বিচারকদের জন্য একটি প্রাথমিক তদন্ত ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়েছে। এর আগে কখনো এই বিধান ছিল না। যদিও বিচারক ছাড়া অন্যদের কারও বিষয়ে আলাদা কোনো আচরণবিধি নেই, কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট উদ্ভাবিত নতুন তদন্ত ব্যবস্থা বিচারকসহ সব সাংবিধানিক ও আধা সাংবিধানিক পদধারীদের জন্য প্রযোজ্য হবে বলে বিশেষজ্ঞরা মত দিয়েছেন।
সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল কারও বিষয়ে আনুষ্ঠানিক তদন্ত করতে চাইলে তাকে বৈঠকে বসার আগেই অনুমোদনের জন্য রাষ্ট্রপতির অনুমতির প্রয়োজন ছিল। কিন্তু ৩৯ দফা নতুন আচরণবিধি বলেছে, প্রধান বিচারপতিই একটি প্রাথমিক তদন্তের উদ্যোগ নেবেন এবং পরবর্তী দুই জ্যেষ্ঠ বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত তদন্ত কমিটি তা তদন্ত করবে। এতে যদি প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া যায়, তাহলে তিনি পূর্ণাঙ্গ তদন্তের জন্য তা রাষ্ট্রপতির কাছে প্রেরণ করবেন।
এই বিষয়ে মন্তব্য চাওয়া হলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা প্রথম আলোকে বলেন, ‘যদিও আমি এখনো পূর্ণাঙ্গ রায় পড়িনি, কিন্তু যেহেতু বিচারকদের জন্য যেরূপ পদ্ধতি অনুসরণ করা হবে, সেরূপটিই আমাদের জন্যও প্রযোজ্য হবে, তাই এটা বলতে পারি যে, এর ফলে আরেকটি নতুন রক্ষাকবচ তৈরি হবে। কারণ, সরাসরি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের প্রসিডিংস শুরুর চেয়ে একটি প্রাথমিক তদন্ত হলে তা উত্তম বলেই প্রতীয়মান হয়।’
ষোড়শ সংশোধনীর রায়ের কার্যকর অংশে দুটি বিষয়ে সাত বিচারকই সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। প্রথমত, ষোড়শ সংশোধনী বাতিল এবং সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ পুনরুজ্জীবন। দ্বিতীয়ত, বিচারকদের জন্য ৩৯ দফা আচরণবিধি। এই আদেশ কবে থেকে কার্যকর আইনের অংশ বলে গণ্য হবে, জানতে চাইলে শাহদীন মালিক প্রথম আলোকে বলেন, ‘যেদিন সংক্ষিপ্ত রায় ঘোষণা হয় সেদিন ৯৬ অনুচ্ছেদ বিষয়ে আদেশে কোনো নির্দিষ্ট নির্দেশনা ছিল না। এটা আমরা পেয়েছি ৩ জুলাই। তাই ৯৬ অনুচ্ছেদ এবং আচরণবিধি ৩ জুলাই থেকে কার্যকর হয়ে গেছে।’
সংবিধানের ১১৮(২) অনুচ্ছেদ বলেছে সুপ্রিম কোর্টের বিচারক যেরূপ পদ্ধতি ও কারণে অপসারিত হতে পারেন, সেরূপ পদ্ধতি ও কারণ ব্যতীত কোনো নির্বাচন কমিশনার অপসারিত হবেন না। বর্তমানে পাঁচজন নির্বাচন কমিশনার রয়েছেন এবং তাঁদের প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই রায়ের প্রত্যক্ষ প্রভাব রয়েছে।
একইভাবে সংবিধানের ১৩৯ (২) অনুচ্ছেদ বলেছে, কোনো বিচারক যেরূপ পদ্ধতি ও কারণে অপসারিত হতে পারেন, সেভাবে কোনো সরকারি কর্ম কমিশনের সভাপতি বা অন্য কোনো সদস্য অপসারিত হবেন। মোহাম্মদ সাদিকের নেতৃত্বে বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশনের বর্তমান সদস্যসংখ্যা সভাপতিসহ ১২ জন। মন্তব্য চাইলে মোহাম্মদ সাদিক গতকাল শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল সম্পর্কেও আমার কোনো স্পষ্ট ধারণা নেই। তাই এ সম্পর্কে বিস্তারিত না জেনে আমি কোনো মন্তব্য করতে চাই না।’
সংবিধানের ১২৯(২) অনুচ্ছেদ একইভাবে বলেছে, বিচারকদের মতোই ‘পদ্ধতি ও কারণ’ ছাড়া মহা হিসাব নিরীক্ষক অপসারিত হবেন না। চেষ্টা করেও তাঁর মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
প্রধান তথ্য কমিশনার অধ্যাপক মো. গোলাম রহমানের নেতৃত্বে বর্তমানে তিন সদস্যের একটি তথ্য কমিশন রয়েছে। যোগাযোগ করা হলে প্রধান তথ্য কমিশনার গোলাম রহমান প্রথম আলোকে বলেছেন, বিচারক অপসারণ বা সাংবিধানিক পদধারীদের অপসারণ প্রক্রিয়া নির্ধারণ করতে গিয়ে জাতীয় সংসদের নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের যোগ্যতার বিষয়টি যেভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে, সেভাবে কখনো কাউন্সিল সদস্যদের গুণমান নিয়েও সংশয় বা প্রশ্ন দেখা দিতে পারে। তাঁর কথায়, ‘আমার শঙ্কার কারণ হলো, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল যাদের যোগ্যতা ও সামর্থ্য সম্পর্কে তদন্ত করবে, তারাও উচ্চপর্যায়ের। সুতরাং তাঁদের বিষয়ে তারা কোনো প্রতিবেদন দিলে, তা মূল্যবান সিদ্ধান্ত হিসেবে গণ্য হবে। সুতরাং যাঁরা তদন্ত করবেন, তাঁদের বিষয়ে সাংবিধানিক পদধারীদের মনেও প্রশ্ন থাকতে পারে।’
মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘এ বিষয়ে ব্যক্তিগতভাবে আমার কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। যে প্রক্রিয়া স্থির হবে, সেটাই আমি মেনে নেব।’
সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল দুর্নীতি দমন কমিশনের জন্যও প্রযোজ্য। বর্তমানে তিন সদস্যের এই কমিশনের সভাপতি ইকবাল মাহমুদের কাছে তাঁর মতামত জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘আমাদের অপসারণ প্রক্রিয়া আইন দ্বারাই পরিচালিত হবে। আলাদা কোনো মন্তব্য নেই।’ 

http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/1278586/