৬ আগস্ট ২০১৭, রবিবার, ১১:০২

বিনামূল্যের ৩৫ কোটি বই নিয়ে চ্যালেঞ্জে এনসিটিবি

বিনামূল্যের ৩৫ কোটি বই নিয়ে চ্যালেঞ্জে পড়েছে সরকার। রীতি অনুযায়ী ১লা জানুয়ারি সারাদেশে বই উৎসব করা হয়। এবার সেই উৎসবে ভাটা পড়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এনসিটিবিতে দক্ষ লোকের অভাব, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের (ডিপিই) অসহযোগিতা, বিশ্বব্যাংকের ছাড়পত্র দিতে দেরি, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বই নিয়ে জটিলতা এবং মাধ্যমিকের বিজ্ঞানের ১২টি রঙিন বইয়ের পাণ্ডুলিপি না পাওয়াকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। সৃষ্ট সংকটের মধ্যে মুদ্রণ শিল্প সমিতি ও প্রকাশকরা আলাদা চিঠি দিয়ে বই দেরির জন্য তারা দায়ী থাকবেন না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন। একরকম শঙ্কার মধ্যেই গত ৩১শে জুলাই সোমবার এনসিটিবি কার্যালয়ে আকস্মিকভাবে পরিদর্শনে যান শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। এ সময় তিনি বইয়ের খোঁজখবর নেন। এনসিটিবির চেয়ারম্যানসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সময় মতো বই দেয়ার নিশ্চিয়তা দেন শিক্ষামন্ত্রীকে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এবার নির্বাচনী বছর হওয়ায় বিনামূল্যের বই নিয়ে সরকারের অতিরিক্ত আগ্রহ থাকবে। এই অবস্থায় বই নিয়ে যেকোনো ধরনের জটিলতার দায় নিতে রাজি হবে না মুদ্রণ শিল্পমালিকরা। 

এনসিটিবি ও মুদ্রণ শিল্প সমিতির দায়িত্বশীল সূত্র বলছেন, এবার প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক, মাধ্যমিক, দাখিল, ভোকেশনাল স্তরের জন্য ৩৫ কোটি ১৩ লাখ ৬৫ হাজার ৪১৫টি বই ছাপার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এরমধ্যে প্রত্যেক স্তরের বই নিয়ে আলাদা আলাদা জটিলতা তৈরি হয়েছে। প্রাইমারি ১০ কোটি ৩৫ লাখ ২৮ হাজার বইয়ের ৯৮টি লটের মধ্যে ৯৬টি লটের ছাড়পত্র দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়। দুটি লটের কাজে সর্বনিম্ন দরদাতাকে না দেয়ার ছাড়পত্র আটকে দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। ৯৬টি লটের ছাড়পত্র পাওয়ার পরও কাজ শুরু করতে পারছেন না প্রকাশকরা। এজন্য এনসিটিবি গাফিলতিকে দায়ী করছেন তারা। আর এনসিটিবি এজন্য দায়ী করছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরকে (ডিপিই)। এনসিটিবির কর্মকর্তারা বলছেন, প্রাথমিক স্তরের বই ছাপার মান নিয়ন্ত্রণ করার জন্য পরিদর্শন টিম নিয়োগ দেয়র কথা বলে ডিপিই। বারবার বলার পরেও তারা এখন পর্যন্ত এই পরিদর্শন টিম নিয়োগ দিতে পারেনি। এজন্য ঠিকাদাররা বই ছাপার কাজ শুরু করতে পারছেন না। প্রকাশকরা বলছেন, প্রায় এক মাস দেরিতে কাজের আনুষ্ঠানিক ছাড়পত্র দেয়া হলেও এখন কাগজ পরিদর্শন করার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজের টেন্ডারই দিতে পারেনি ডিপিই। সবচেয়ে বেশি বই ছাপা হয় প্রাইমারি পর্যায়ে। এই স্তরের বই পৌঁছাতে দেরি হলে তার দায় আমরা নেবো না।
এ জটিলতার কথা স্বীকার করে গতকাল এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র সাহা মানবজমিনকে বলেন, প্রাথমিক স্তরের বই ছাপার মান নিয়ন্ত্রণ করার জন্য পরিদর্শন টিম নিয়োগ দেয় ডিপিই। বারবার বলার পরেও তারা এখন পর্যন্ত নিয়োগ না দেয়ায় ঠিকাদাররা বই ছাপার কাজ শুরু করতে পারছেন না। এ কারণে বই ছাপায় বিলম্ব হলে দায় ডিপিইকে নিতে হবে। তিনি আরও বলেন, প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক শ্রেণির পাঁচটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মাতৃভাষার বইয়ের সঠিক সংখ্যা নির্ধারণ করে দিতে না পারায় টেন্ডার আহ্বান করা যাচ্ছে না।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, অন্যান্য বছর জুন মাস থেকে মাধ্যমিকের বই ছাপা শুরু হয়। এবার আগস্ট মাসেও এসেও সেই প্রত্রিুয়া শুরু করতে পারেনি এনসিটিবি। গত বছর প্রাইমারি ওয়ার্ক অর্ডার দেয়ার সময় মাধ্যমিকের ৬০% বই ছাপার কাজ শেষ করে প্রকাশকরা। এবার প্রাইমারি ও মাধ্যমিকের কাজ একসঙ্গে শুরু করতে হচ্ছে প্রকাশকদের। অক্টোবর মাস থেকে আবার নোট গাইড ছাপানোর কাজ শুরু করবে নোট গাইড ব্যবসায়ীরা। এ সময় এ সংশ্লিষ্ট কাজের লোক, কাগজ, আর্ট পেপারের মতো কাগজ পেতে বেগ পেতে হয় প্রকাশকদের।
একই অবস্থা মাধ্যমিকের বইয়ে। অন্যান্য বছর এই সময় মাধ্যমিকের প্রায় অর্ধেকের বেশি বই ছাপার কাজ শেষ হলেও এবার সেটি শুরু হয়েছে আড়াই মাস পর। মাধ্যমিকে বই ছাপার ওয়ার্ক অর্ডার পেয়েছে গত সপ্তাহে। শিক্ষাবিদদের পরামর্শে পাঠ্যবই শিক্ষার্থীদের জন্য সুখপাঠ্য করতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবার মাধ্যমিক পর্যায়ের নবম শ্রেণির (স্কুল, মাদরাসা ও কারিগরি) সাধারণ বিজ্ঞান, পদার্থ, রসায়ন ও জীববিজ্ঞান এই চারটি বিষয়ের ১২টি বইয়ের ভেতরে সব পাতা রঙিন করে ছাপানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এসব বইয়ের পাণ্ডুলিপি তৈরি করে দেবেন শিক্ষাবিদরা। কিন্তু তারা পাণ্ডুলিপি জমা না দেয়ায় বিশাল ভলিউমের এ ১২টি বই ছাপার কার্যক্রম আটকে আছে। এদিকে বইয়ের পাণ্ডুলিপি ছাড়াই গত ৩রা আগস্ট এসব বইয়ের দরপত্র আহ্বান করেছে এনসিটিবি। এ ব্যাপারে এনসিটিবির চেয়ারম্যান বলেন, মাধ্যমিক স্তরের কিছু বই ছাপার জন্য এনসিটিবির পক্ষ থেকে কাগজ কিনে দেয়া হয়েছে। এসব বই ছাপার মান নিয়ন্ত্রণ করার জন্য পরিদর্শন টিম নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
একই অবস্থা গত বছর থেকে চালু করা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বই নিয়েও। আমলতান্ত্রিক জটিলতার কারণে পাঁচটি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মাতৃভাষার প্রাক-প্রাথমিক ও প্রথম শ্রেণির প্রায় দুই লাখ ৮০ হাজার বিনামূল্যের বই ছাপা নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। এসব বই ছাপার জন্য এনসিটিবিকে নির্দেশনা দেয় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। তবে দেড় মাস পর এ নির্দেশনা দিয়েছে মন্ত্রণালয়। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ অনুযায়ী চলতি শিক্ষাবর্ষ থেকে প্রথমবারের মতো চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, গারো ও সাদ্রী- এ পাঁচটি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শিশুদের মাতৃভাষায় পাঠদানের জন্য বই দেয়া হয়। এসব বই সংশ্লিষ্ট ভাষার বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে পাণ্ডুলিপি তৈরি করা হয়। এদিকে সংসদীয় কমিটির নির্দেশনার পর এবারও সাঁওতাল সম্প্রদায়ের শিশুরা মাতৃভাষায় বই পাচ্ছে না। কারণ, এই সম্প্রদায়ের মধ্যে দুটি গ্রুপ তৈরি হয়েছে। একটি গ্রুপ চাচ্ছে রোমান হরফে আরেক গ্রুপ চাচ্ছে বাংলা হরফে বই ছাপা হোক। একটি গ্রুপের নেতৃত্বে রয়েছেন রাজশাহী অঞ্চলের সংসদ সদস্য ফজলে হোসেন বাদশা এবং অন্যটির আদি সাঁওতাল। এই দোলাচলে সর্বশেষ কোনো সিদ্ধান্তই নিতে পারেননি এনসিটিবি।
এনসিটিবির কর্মকর্তারা জানান, ২০১৮ শিক্ষাবর্ষের বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক ছাপানোর জন্য সময়াবদ্ধ পরিকল্পনা (টিএপি) গ্রহণ করা হয়। বই ছাপানোর প্রথম দিকের গুরুত্বপূর্ণ দুটি কাজ হলো, দরপত্র নির্দেশনা প্রণয়ন ও পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা। ২৩শে ফেব্রুয়ারির মধ্যে বইয়ের টেন্ডার আহ্বান করে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয়ার সময় নির্ধারিত ছিল। প্রাথমিকের বই প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর, মাধ্যমিক পর্যায়ের সকল বইয়ের চাহিদা দিতে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) এবং দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের বইয়ের চাহিদা সমাজ কল্যাণ অধিদপ্তরকে সময় বেঁধে দেয়া হয়। কয়েক দফা চিঠি দেয়া হলেও নির্ধারিত সময়ের অনেক পরে চাহিদা দেয়। কর্মকর্তারা আরও জানান, আগামী শিক্ষাবর্ষের প্রাথমিকের বই ছাপায় আন্তর্জাতিক টেন্ডারের জন্য বিশ্বব্যাংকের ছাড়পত্র ৮ই মার্চ দেয়ার কথা ছিল। এ ক্ষেত্রেও সময়ক্ষেপণ হয়েছে প্রায় দেড় মাস। দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য ব্রেইল বই ও পাঁচটি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মাতৃভাষার বইয়ের চাহিদা গতকাল পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।
মুদ্রণ শিল্প সমিতির সভাপতি তোফায়েল খান মানবজমিনকে বলেন, আমরা একাধিক চিঠি দিয়ে এনসিটিবিকে সর্তক করেছি। এবার বই নিয়ে ঝক্কি-ঝামেলার দায় এনসিটিবিকে নিতে হবে। কারণ, আমরা কাজ করতে সম্পূর্ণ প্রস্তুত। কোনো কাজের প্রত্রিুয়া শুরু করতে পারছে না প্রতিষ্ঠানটি। তিনি বলেন, এবার নির্বাচনী বছর। এবার বই ফেল করা মানে সরকার বেকায়দায় পড়া। এই বিষয়টিও আমরা এনসিটিবিকে বলেছি।

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=77380&cat=3/