৬ আগস্ট ২০১৭, রবিবার, ১১:০০

চাল কিনতেই নাভিশ্বাস

আমদানির চাল গেল কোথায়?

ধানের দেশে চালের অভাব! খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশ। বাজারে চালের আমদানিও প্রচুর। সরকার স্বল্প সময়ের মধ্যে বিদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ চাল আমদানি করেছে। তারপরও চালের দাম কমছে না। সীমিত আয়ের মানুষকে ৩০ টাকার মোটা চাল কিনতে হচ্ছে ৪৫ থেকে ৫০ টাকা দরে। চাল কিনতে গিয়ে নিম্নবিত্ত ও সীমিত আয়ের মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। সিন্ডিকেটের মাধ্যমে চালের মূল্য বৃদ্ধির অভিযোগ চালকল মালিকদের বিরুদ্ধে। বিদেশ থেকে চাল আমদানির পাশাপাশি সরকার প্রায় ১৬ হাজার চালকল কালো তালিকাভুক্ত করেছে। তারপরও চালের দাম কমছে না। প্রখ্যাত আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক চালের মূল্য বৃদ্ধিতে আমজনতার অবস্থা তুলে ধরে বলেছেন, ‘যে রিকশাচালককে ৩০ টাকার মোটা চাল ৫০ টাকায় কিনে খেতে হচ্ছে সে বোঝে চালের যন্ত্রণা কি জিনিস।’
হাওড় অঞ্চলে বন্যা, ব্লাস্ট রোগ এবং সরকারের পর্যাপ্ত মজুদ না থাকায় এ বছর ধান উৎপাদন কিছুটা কম ছিল। আর এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে একটি অসাধু চক্র চালের দাম বাড়িয়ে দেয় রেকর্ড পরিমাণ। অব্যাহতভাবে চালের মূল্য বৃদ্ধিতে বাজার সহনীয় রাখতে আমদানিতে শুল্ক কমায় সরকার। পাশাপাশি শূন্য মার্জিনে চাল আমদানিরও সুযোগ দেয়া হয় ব্যবসায়ীদের। সুযোগ পেয়ে গত দুই মাসেই চাল আমদানিতে ঋণপত্র (এলসি) খোলা হয়েছে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকার। এসব ঋণপত্রের বিপরীতে দেড় লাখ টন চাল দেশেও এসেছে। বাকি চাল আমদানি পর্যায়ে থাকলেও এর প্রভাব নেই বাজারে। নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষদের নাগালের বাইরেই রয়ে গেছে। দুই সপ্তাহ আগের দামেই বিক্রি হচ্ছে সব ধরনের চাল। অথচ চাল আমদানি বাড়লে দাম ক্রমান্বয়ে কমে আসবে বলে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল। এক মাস থেকে বাজারে চালের দাম স্থিতিশীল রয়েছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
এদিকে চালের দাম বাড়ার জন্য সম্পূর্ণ খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তাদের দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। চালের বাজারে দাম বাড়ার প্রকৃত কারণ না খুঁজে তারা সরকারকে ভুল বার্তা দিয়েছে। আর বর্তমানে যে পরিমাণ আমদানির হাঁকডাক শোনা যাচ্ছে, আসলে সেই পরিমাণ চাল আমদানি হচ্ছে না। এছাড়া আমদানি ব্যয় বেশি পড়ায় স্থানীয় বাজারেও বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে বলে জানান ব্যবসায়ীরা।
চালের আড়তদাররা বলছেন, সরকারি উদ্যোগে চালকল স্থাপন করলে সিন্ডিকেট থাকবে না। কেজিপ্রতি ব্যবসায়ীরা নির্ধারিত একটা মুনাফা করে থাকে। সেটা দাম বাড়লেও হবে, কমলেও হবে। কিন্তু চাল নিয়ে আসলে কোথায় চালবাজি হচ্ছে তা খুঁজে বের করতে হবে সরকারকে। ভেতরের সমস্যা বের না করে যতই আমদানি করুক খুব বেশি কাজে আসবে না। এছাড়া সরকারি উদ্যোগে চালের পাইকারি ও মিল পর্যায়ে দাম নির্ধারণ করে দেয়ার দাবিও জানান তারা।
সূত্র মতে, ভিয়েতনাম থেকে শুল্কমুক্ত সুবিধায় দুই মাসে দেড় লাখ টন চাল আমদানি এবং ভারত, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার ও নতুন করে যুক্ত হওয়া কম্বোডিয়া থেকে লাখ লাখ টন চাল আমদানির চুক্তির কোনো প্রভাব নেই। তিন মাসের ব্যবধানে দেশে চালের দাম ১২ থেকে ১৩ টাকা বেড়ে গিয়েছিল। সেই বাড়তি দাম থেকে কমেছে মাত্র ৪ টাকা। সরেজমিন আড়তদার ও মিল মালিকদের সঙ্গে আলাপ করে দামের এই চিত্র পাওয়া গেছে।
বাজার ঘুরে দেখা যায়, এক মাস আগে প্রতি কেজি মোটা চাল বিক্রি হয় ৪৬-৪৮ টাকায়। চিকন চালের দাম ওঠে প্রতি কেজি ৫৫-৬০ টাকায়। আমদানি শুল্ক হ্রাস ও শূন্য মার্জিনে চাল আমদানির ঘোষণার পর এক সপ্তাহের মধ্যে পণ্যটির দাম কেজিতে ৩-৫ টাকা পর্যন্ত কমে। যদিও ওই সময় আমদানি ছিল সীমিত। এরপর ব্যাপক পরিসরে চাল আমদানি হলেও এর প্রভাব নেই দামে। দুই সপ্তাহ আগের দামেই বিক্রি হচ্ছে এখনো। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবির) হিসাবে, গত শনিবারও প্রতি কেজি মোটা চাল বিক্রি হয়েছে ৪২-৪৫ ও চিকন চাল ৫৫-৫৮ টাকায়। রাজধানীর কারওয়ান বাজার, হাতিরপুল ও কাঁঠালবাগানসহ কয়েকটি মার্কেটে সরেজমিন দেখা গেছে, সাধারণত নিম্নবিত্তরা যে চাল খেয়ে জীবন ধারণ করে সেই মোটা চাল পাইকারি প্রতি কেজি ৪৪ থেকে ৪৫ টাকা আর খুচরা পর্যায়ে বিক্রি হচ্ছে ৪৭ থেকে ৪৯ টাকায়। আর মিনিকেট পাইকারি বিক্রি হচ্ছে ৫৩ থেকে ৫৪ টাকা; খুচরায় বিক্রি হচ্ছে ৫৮ থেকে ৬০ টাকা। আটাশ চাল (ইরি জাতীয় চাল) পাইকারি ৪৯ থেকে ৫১ টাকা আর খুচরায় বিক্রি হচ্ছে ৫৩ থেকে ৫৪ টাকা।
তিন মাস আগে পাইকারি পর্যায়ে মোটা চাল বিক্রি হয়েছিল ৩২ থেকে ৩৪ টাকা। মাঝখানে লাফিয়ে লাফিয়ে ৪৮ থেকে ৪৯ টাকায় উঠে, এখন বিক্রি হচ্ছে ৪৪ থেকে ৪৫ টাকায়। আর খুচরা পর্যায়ে বিক্রি হচ্ছে ৪৭ থেকে ৪৯ টাকায়। এই হিসাবে পাইকারি পর্যায়ে চালের দাম কমেছে ৪ টাকা আর খুচরা পর্যায়ে কমেছে ৩ থেকে ৪ টাকা। আর তাই বাজারের এই চিত্র সহজেই বলে দিচ্ছে শুল্কমুক্ত চাল আমদানির সুযোগ হঠাৎ লাফিয়ে ওঠা চালের বাজারে খুব একটা প্রভাব ফেলতে পারেনি।
বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের উপদেষ্টা মাহমুদ হাসান রাজু বলেন, দাম বৃদ্ধির জন্য সম্পূর্ণভাবে দায়ী খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তারা। দেশে যখন প্রচুর পরিমাণে হাইব্রিড ধান উৎপাদন হয়েছে, তখন তারা বলছেন, মানুষের রুচি পরিবর্তন হয়েছে। এই ধান আর উৎপাদন দরকার নেই। এখন থেকে চিকন চালের ধান উৎপাদন বাড়াতে হবে। এরপর কৃষকরা প্রতি একরে ৮০ থেকে ১০০ মণ উৎপাদন হওয়া হাইব্রিড ধান চাষ থেকে সরে এসেছে। কিন্তু চিকুন চালের ধান প্রতি একরে উৎপাদন হয় মাত্র ৪০ থেকে ৫০ মণ। এ কারণে এই ঘাটতি দেখা দিয়েছে। কারণ শহরের তুলনায় গ্রাম পর্যায়ে মোটা চালের ব্যাপক চাহিদার খবর কর্মকর্তারা রাখেন না। ‘খাদ্য কর্মকর্তারা সরকারকে খাদ্যের সঠিক ধারণা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। ভুল বার্তা দেয়ায় খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়া দেশ এখন ঘাটতিতে পড়েছে’- যোগ করেন তিনি।
এবার বোরো মৌসুমে আগাম বন্যায় সরকারি হিসাবেই হাওরে ছয় লাখ টনের মতো ধান নষ্ট হয় এবং সরকারি মজুদ তলানিতে নেমে আসে। আর তাই সঙ্কট দেখা দেয়ায় চালের দামের লাগাম টেনে ধরতে ২৮ শতাংশ আমদানি শুল্ক থেকে ১৮ শতাংশ কমিয়ে ১০ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়। এরপর বিনা জামানতে ও বাকিতে চাল কেনার সুযোগ দেয় সরকার। বিদেশ থেকে কয়েক লাখ টন চাল আনার চুক্তি করা হয়। এর মধ্যে গত বৃহস্পতিবার কম্বোডিয়া থেকে এক বছরে ১০ লাখ টন চাল আমদানির চুক্তিপত্র করা হয়।
আমদানির পরও চালের দাম কমছে না কেন জানতে চাইলে কারওয়ান বাজারের হাজি ইসমাইল অ্যান্ড সন্সের মাঈন উদ্দিন বলেন, এই প্রশ্নের জবাব ব্যবসয়ীরাও খোঁজেন। আমদানি হচ্ছে সবাই জানে। কিন্তু যে পরিমাণ আমদানি হওয়ার কথা, সত্যিকারে তা আসছে কি না খতিয়ে দেখা উচিত। কারণ উল্লেখযোগ্য হারে চাল আমদানি হচ্ছে। এখানে শুভঙ্করের ফাঁকি দেয়া হচ্ছে।
কারওয়ান বাজারের আরেক চাল ব্যবসায়ী রহমত আলী বলেন, আমদানির চাল বেশি দামে বিক্রি হওয়ায় দেশি চালের দামও কমছে না। সরকার যাদের চাল আমদানির অনুমোদন দিচ্ছে, বাজারে ওই চাল কত টাকায় বিক্রি হচ্ছে তা দেখার কেউ নেই। আমদানির চাল বিক্রিও সরকারের নিয়ন্ত্রণ করা উচিত।
আমদানির চুক্তি বেশি কাজে আসবে না উল্লেখ করে ঠাকুরগাঁয়ের ন্যাশনাল রাইস মিলের মালিক মাহমুদ হাসান রাজু বলেন, সরকার শুল্ক কমিয়েছে। কিন্তু রফতানিকারক দেশগুলো দাম বাড়িয়েছে। ফলে আগের চেয়ে বেশি দামে কিনতে হয়। যে কারণে উল্লেখযোগ্যভাবে দেশের বাজারে দাম কমছে না।
যশোরের নওয়াপাড়ার চাল আমদানিকারক আবদুল ওহাব বলেন, সরকারের সুযোগ-সুবিধার কারণে ভারত থেকে চাল আমদানির উদ্যোগ নেই। দেশটিতে চালের দাম বেশি থাকার পরও ঝুঁকি নিয়ে প্রায় পাঁচ হাজার টন চাল আমদানি করি। প্রতি কেজি চাল আমদানিতে এখন ব্যয় হচ্ছে প্রায় ৪০ টাকা। এর সঙ্গে ব্যাংক সুদ, বন্দর খরচসহ অন্যান্য ব্যয় যোগ করলে দাম আরো বেড়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, জুনের আগ পর্যন্ত কয়েক মাস ধরে প্রতি মাসে গড়ে ৬৫-৭৫ কোটি টাকার চাল আমদানি হতো দেশে। এরপর বাড়তে থাকে আমদানির পরিমাণ। জুনেই চাল আমদানির এলসি খোলা হয় ১ হাজার ৪৬৭ কোটি টাকার। গত ২২ জুলাই পর্যন্ত খোলা হয় ৮১৪ কোটি টাকার এলসি। তবে মাস শেষে তা হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে বলে জানান ব্যাংক-সংশ্লিষ্টরা। এই দুই মাসেই প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকার চাল আমাদনির এলসি খোলা হয়। এলসি নিষ্পত্তির পর দুই মাসে দেশে প্রবেশ করেছে প্রায় দেড় লাখ টন চাল। আমদানি পর্যায়ে রয়েছে আরো অনেক চাল। এদিকে আমদানি শুল্ক হ্রাস ও বাকিতে আমদানির সুযোগ দেয়ায় নতুন করে অনেকে চাল ব্যবসায় নাম লিখিয়েছেন। তাই চাল আমদানির পরিমাণও বেড়েছে।
চাল আমদানিতে ব্যবসায়ীদের এলসি খোলার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখছে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক। ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো: ওবায়েদ উল্লাহ্ আল্ মাসুদ বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক হিসেবে আমদানির মাধ্যমে সরকারের খাদ্য মজুদ শক্তিশালী করতে সচেষ্ট রয়েছে সোনালী ব্যাংক। তবে কেউ যাতে সুযোগের অপব্যবহার না করে, সে ব্যাপারেও সতর্ক রয়েছি আমরা।
সূত্র মতে, কৃষকের ন্যায্য দাম নিশ্চিত করার জন্য চাল আমদানি নিরুৎসাহিত করতে ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে শুল্কহার ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২৫ শতাংশ করে সরকার। এর সঙ্গে রেগুলেটরি ডিউটি তিন শতাংশ যোগ হওয়ায় ব্যবসায়ীদের ২৮ শতাংশ শুল্ক গুনতে হয়। ফলে গত দেড় বছর ধরে বেসরকারি পর্যায়েও চাল আমদানি প্রায় বন্ধ ছিল।
কিন্তু হাওড় অঞ্চলে বন্যা, বøাস্ট রোগ এ বছর চালের বাজারকে অস্থির করে তোলে। সামাল দিতে গত ১৯ জুন শূন্য মার্জিনে পণ্যটি আমদানির বিষয়ে একটি নির্দেশনা দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। তাতে বলা হয়, ব্যাংক হিসাবে টাকা না থাকলেও চাল আমদানির ঋণপত্র খোলা যাবে। ওই নির্দেশনায় চাল আমদানিতে ব্যাংকার-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে বিনা মার্জিনে ঋণপত্র খোলার পরামর্শ দেয়া হয়। এরপর গত ২১ জুলাই নতুন সার্কুলার জারি করে চাল আমদানির শর্ত আরো শিথিল করে বাংলাদেশ ব্যাংক। নতুন নির্দেশনা অনুযায়ী, বিদেশী ক্রেতা বা ব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে কিংবা বাকিতে চাল আমদানি করা যাবে। খাদ্যপণ্য হিসেবে চাল আমদানি সহজ করতেই এ উদ্যোগ বলে জানান বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র শুভঙ্কর সাহা। তিনি বলেন, বাকিতে আমদানিকৃত চালের ঋণের টাকা পরিশোধের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট বিধিবিধান রয়েছে। ব্যাংকগুলোকে তা মেনে চলতে হবে। এছাড়া প্রয়োজনীয় তথ্য যাচাই-বাছাই করে ব্যাংকগুলো যাতে চাল আমদানির এলসি খোলে, সে ব্যাপারেও পরামর্শ দেয়া হয়েছে। বিধিবিধান মেনে চাল আমদানি হলে ব্যাংকের ঋণ ঝুঁকিতে পড়বে না।

 

https://www.dailyinqilab.com/article/90679/