৬ আগস্ট ২০১৭, রবিবার, ১০:৫৩

কোরবানির হাট এবারও ক্ষমতাসীনদের দখলে

রাজধানীতে কোরবানির পশুর হাটের দরপত্র ডাকার পর আফতাবনগর হাটের বিপরীতে মাত্র তিনটি দরপত্র জমা পড়ে। সাধারণ ইজারাদারদের দরপত্র কিনতে বাধা দিয়ে একটি প্রভাবশালী চক্র পছন্দমতো দরে ইজারাও পেয়ে যায়। কাগজ-কলমে এবার হাটটি পেয়েছেন বাড্ডার আনন্দনগরের আবদুল আউয়ালের ছেলে আবদুর রহমান রুবেল। তিনি আগে বাড্ডা ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। বর্তমানে যুবলীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত। মূলত ফারুকই কয়েক বছর ধরে আফতাবনগর হাটটির নিয়ন্ত্রক। তাদের বাইরে দু'জন অতীতে হাটটি ইজারা নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। দু'জনই খুন হয়েছেন। এ হাটের সঙ্গে সম্পৃক্তদের সবাই ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী ও অনুসারী। অবশ্য 'ভাগ্নে ফারুক'খ্যাত সেই ফারুকের দাবি, তিনি হাটের সঙ্গে নেই। রুবেল হাটটি নিয়েছে।

স্থানীয়রা আরও জানান, রাজধানীর সবচেয়ে বড় এই হাটটি এক সময় জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকায় ইজারা দেওয়া হতো। উত্তর সিটি করপোরেশনে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর গতবার অল্প টাকায় দিতে মেয়র আনিসুল হক রাজি না হওয়ায় সর্বশেষ অনেক চাপের মুখে ১ কোটি ১ লাখ টাকায় ইজারা দেওয়া হয়। এবার দেওয়া হয়েছে ১ কোটি ৯ লাখ ৫৫ হাজার টাকায়। বাস্তবে এই হাট থেকে আদায় হয় ১৫ থেকে ২০ কোটি টাকা। ইজারাদার আবদুর রহমান রুবেল বলেন, হাটটি

তার নামে নেওয়া হলেও এর সঙ্গে বাড্ডা থানা আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, শ্রমিক লীগসহ সবাই আছে। মিলেমিশে লাভের অংশ ভাগ করে দেন। তার দাবি, হাট থেকে অত টাকা লাভ হয় না। আর খুনের বিষয়টিও হাটকেন্দ্রিক নয়।

কেবল আফতাবনগর হাটটিই নয়, আসন্ন ঈদুল আজহা উপলক্ষে রাজধানীতে বসতে যাওয়া ২২টি পশুরহাটের প্রায় সবই দখলে নিয়েছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা। একাধিক ইজারাদার বলেন, হাট ইজারা দেওয়ার ক্ষেত্রে নূ্যনতম তিনটি দরপত্র জমা পড়তে হয়। সাধারণ ইজরাদাররা দরপত্রই কিনতে পারেননি। দু-একজন কিনলেও ভয়ে জমা দেননি বা দিতে পারেননি। ফলে প্রভাবশালী চক্র পছন্দমতো দর দিয়ে হাটগুলো ইজারা নিয়েছে। আবার কয়েকটি হাটের ক্ষেত্রে কোনো দরপত্রই জমা পড়েনি। সেগুলো অতীতের মতো ঈদের আগমুহূর্তে দলীয় লোকদের দিয়ে পরিচালনা করা হতে পারে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা। কয়েকটি স্থানে হাট বসানোর পরিকল্পনাই বাদ দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। সাধারণ ইজারাদাররা মনে করেন, এসব স্থানেও একই ঘটনা ঘটতে পারে।

হাটগুলো কেবল দলীয় নেতা-কর্মীরাই কীভাবে পেল_ এ প্রসঙ্গে ইজারার সঙ্গে সম্পৃক্ত ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম সমকালকে বলেন, পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে দরপত্র আহ্বান করা হয়। জমা পড়া দরপত্রের কাগজপত্র ঠিক থাকলে শীর্ষ দরদাতাকে ইজারা দেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে কে কোনো দল করে, তা বিবেচ্য বিষয় না। অবশ্য বিগত বছরের চেয়ে কম দর হলে পুনঃদরপত্র আহ্বান করা হয়। এবার নয়টি হাটের তিনটিতে কোনো দরপত্রই জমা পড়েনি বলেও জানান তিনি।

ডিএনসিসির ইজারা দেওয়া ছয়টি হাটের মধ্যে ইজারাদারদের অধিকাংশই ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে যুক্ত বলে জানা যায়। কয়েকজন পদধারী নেতাও আছেন। উত্তরা ১৫ নম্বর সেক্টরের ১ নম্বর গোলচত্বর সংলগ্ন খালি জায়গার হাটটি ইজারা পেয়েছেন দক্ষিণখান থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. শফিক। সম্প্রতি ডিএনসিসিতে অন্তর্ভুক্ত হওয়া দক্ষিণখানের একটি ওয়ার্ড থেকে আওয়ামী লীগ থেকে কাউন্সিলর নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন তিনি। ভাটারার হাট ইজারা পেয়েছেন ক-৮১ শাহজাদপুরের বাসিন্দা গুলশান থানা আওয়ামী লীগের নেতা মোজাফফর হোসেন। মোহাম্মদপুরের বসিলা পুলিশ লাইন্সের জায়গার হাট পেয়েছেন ঢাকা মহানগর উত্তর যুবলীগের সহসভাপতি মো. শাহ আলম। মিরপুর ৬ নম্বর সেকশনের ইস্টার্ন হাউজিংয়ের খালি জায়গার হাট পেয়েছেন কেন্দ্রীয় যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সালাহউদ্দিন মাহমুদ। মিরপুরের ডিওএইচএস সংলগ্ন উত্তর পাশের খালি জায়গা পেয়েছেন বিএনপি থেকে আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়া সাবেক এমপি এখলাস উদ্দিন মোল্লাহর ছেলে ইমরান উদ্দিন মোল্লাহ।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) অধীন হাটগুলোরও প্রায় একই অবস্থা। খিলগাঁওয়ের মেরাদিয়া বাজার পশুরহাটের ইজারা পেয়েছেন ৩ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ নেতা মো. শরীফ। উত্তর শাজাহানপুরের খিলগাঁও রেলগেট সংলগ্ন মৈত্রীসংঘের মাঠ পেয়েছেন ১১ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল লতিফ। গোপীবাগের হাটটি ইজারা পেয়েছেন সহিদ উদ্দিন। তিনি আওয়ামী লীগের সমর্থক। স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর ময়নুল হক মঞ্জু জানান, সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত নাসির ইতালি থেকে হাটটি নিয়ন্ত্রণ করেন। সে আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের কিছু নেতা-কর্মীর মাধ্যমে হাটটি নিয়েছেন। এতে দু'পক্ষেরই লাভ। কমলাপুর স্টেডিয়াম সংলগ্ন খালি জায়গার হাটটি পেয়েছেন ওয়ারীর ২নং শহীদ নজরুল ইসলাম সড়কের মো. আমের খান। তার সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায়নি। তবে ৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মমিনুল হক সাঈদ জানান, তিনি যে আমের খানকে চেনেন, সে হলে আওয়ামী লীগেরই হবে। হাজারীবাগ হাটের ইজারা পেয়েছেন থানা আওয়ামী লীগের নেতা অহিদুর রহমান ওয়াকিব। তিনি রাজধানীর এক আওয়ামী লীগদলীয় এমপির ঘনিষ্ঠ। রহমতগঞ্জ খেলার মাঠ পেয়েছেন মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের নেতা হাজি শফি মাহমুদ। কামরাঙ্গীরচর চেয়ারম্যান বাড়ির হাটিটি পেয়েছেন থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল হোসেন সরকার। আরমানিটোলা খেলার মাঠের ইজারা পেয়েছেন এসআই ফারিয়াদ। তিনিও মহানগর আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। এ ক্ষেত্রে হাটটির বাজারমূল্য নূ্যনতম ৪ কোটি ৮৬ লাখ ৩৬ হাজার ৬৭০ টাকা মূল্যায়ন করেছিল ডিএসসিসি কর্তৃপক্ষ। কিন্তু ফারিয়াদ সর্বোচ্চ দর দেন ১ কোটি ২৭ লাখ ৯৯ হাজার ৫৫৫ টাকা। পোস্তগোলা শ্মশানঘাটের পাশের হাটের ইজারা পেয়েছেন শ্যামপুর থানা আওয়ামী লীগ নেতা মইন উদ্দিন চিশতি। দনিয়া কলেজ মাঠ সংলগ্ন খালি জায়গার ইজারা পেয়েছেন আবুল কালাম আজাদ। শ্যামপুর বালুর মাঠ পেয়েছেন শেখ মাসুক রহমান। তারাও ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে যুক্ত বলে জানা যায়। এ ছাড়া ধোলাইখালের সাদেক হোসেন খোকা খেলার মাঠ সংলগ্ন জায়গাটির বিপরীতে কেউ দরপত্র জমা দেয়নি। পুলিশ ও ডিএসসিসির সম্পত্তি বিভাগের লোকজনদের হাত করে ৪২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা টেন্ডার ছাড়াই শেষ মুহূর্তে হাটটি বসিয়ে দেবেন বলে মনে করা হচ্ছে।

ডিএসসিসির প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা কামরুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, অনেকেই হাট নিয়ে কথা বলেন। কিন্তু কেউ অভিযোগ নিয়ে আসেন না। আসলে যারা কম দর দিয়ে হাট পান না, তারাই এসব কথা বলে। দরপত্র কিনতে বাধা, জমা দিতে না দেওয়া_ এসব অনিয়মের কথা অস্বীকার করে তিনি বলেন, নিয়মের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। নিয়ম মেনে যদি সব হাট আওয়ামী লীগের লোক পেয়ে যায়, তাহলেও কিছু করার নেই।

http://bangla.samakal.net/2017/08/06/314509