মিরপুরের রূপনগর খালের মাঝামাঝি অংশ দখল করে ঘরবাড়ি বানানো হয়েছে।
৫ আগস্ট ২০১৭, শনিবার, ১২:৩০

কৃত্রিম ৪৬ খাল বুকে ঢাকা এককালে তিলোত্তমা ছিল

‘আমরা বাপ-দাদার মুখে ঢাকার পাণ্ডু নদীর অনেক গল্প শুনেছি। তাঁরা এই নদীতে সাঁতার কাটতেন। মাছ ধরতেন। নৌকাবাইচের উৎসব করতেন। আমরাও ছোটবেলায় দেখেছি নদীটির চিহ্ন একেবারে নিঃশেষ হয়ে যায়নি। নদীর দুই তীরে আমরা ধান রোপণ করতাম, তখনো নদীতে বেশ পানি হতো। এলাকার জলাবদ্ধতা নিরসনে এ নদীর ভূমিকা ছিল অপরিসীম। বর্তমানে হাতিরঝিল প্রকল্পের ফলে হয়তো নদীর কিছু অংশ বেঁচে গেছে। কিন্তু পুরো নদী তো হারিয়ে গেছে ঢাকার মানচিত্র থেকে। ’ কালের কণ্ঠকে বলছিলেন রাজধানীর বেগুনবাড়ীর বাসিন্দা মহিউদ্দিন দেওয়ান।

ধানমণ্ডি, কলাবাগান, গ্রিন রোড হয়ে কাঁঠালবাগানের উত্তর পাশ ও সোনারগাঁও হোটেলের দক্ষিণ পাশ দিয়ে প্রবাহিত একটি খাল বর্তমানে বক্স কালভার্ট সড়কে পরিণত হয়েছে।

এরই পূর্বাংশ বর্তমানে হাতিরঝিল হিসেবে পরিচিত। এরপর সেটা একটি সরু নর্দমায় পরিণত হয়ে বেগুনবাড়ী খাল হিসেবে বালু নদে মিশে গিয়ে এখনো টিকে আছে। কেউ একে রামপুরা খালও বলে থাকে। তবে ঢাকার পুরনো ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, একসময় সেখান দিয়ে খাল নয়, একটি বড়সড় নদী প্রবাহিত হতো। নাম ছিল পাণ্ডু নদী। সেই নদীতে অতীতে নৌকা চলত, বাইরে থেকে আসা অনেক ব্যাপারী এই নদী দিয়ে ঢাকায় ঢুকত। এর প্রমাণ মগবাজারের নয়াটোলা। এলাকার প্রবীণ ব্যক্তিরা বলে থাকেন, এলাকাটির নাম নয়াটোলা নয়, নাইয়াটোলা (নেয়ে বা মাঝি থেকে)। এলাকার মাঝিরা পাণ্ডু নদীতেই নৌকা চালাত।

আজকাল রাজধানীর কারওয়ান বাজারে সামান্য বৃষ্টি হলেই রাস্তাঘাট ডুবে যাচ্ছে। অথচ কারওয়ান বাজারের দক্ষিণ পাশ দিয়েই বইতো ওই পাণ্ডু নদী। এই নদী ধরে ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, সিলেট, ফরিদপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ছোটখাটো ব্যবসায়ীরা ঢাকায় আসত, তাদেরই একজন ছিলেন হাজি দিলু বেপারী। সুপরিচিত দিলু রোড তাঁরই নামে হয়েছে। দিলু বেপারী ময়মনসিংহ এলাকা থেকে মাটির হাঁড়ি-পাতিল নিয়ে পাণ্ডু নদী ধরে এসেই মগবাজার এলাকায় বসবাস শুরু করেছিলেন।

কারওয়ান বাজার আন্ডারপাসের পাশেই এখন দেখা মেলে আম্বর শাহ মসজিদের। ঐতিহাসিক ড. মুনতাসীর মামুনের বিবরণ থেকে জানা যায়, মোগল আমলে কারওয়ান বাজারে একটি সরাইখানা ছিল। পাশেই আম্বর শাহ নামে একজন ধর্মীয় পীর থাকতেন। আখড়ার পাশে একটি মসজিদও তিনি নির্মাণ করেছিলেন। পাণ্ডু নদী তাঁর এই আস্তানার পাশ দিয়েই প্রবাহিত হতো। তিনি নদীর ওপর একটি সেতুও নির্মাণ করেছিলেন। সেতুটি আম্বর সেতু হিসেবে পরিচিতিও পায়। আম্বর শাহ মসজিদ টিকে থাকলেও সেতুটি নদীর সঙ্গে হারিয়ে গেছে।

জানা যায়, মোগল আমলে ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার একমাত্র বাহন ছিল নৌযান। নদ-নদীর সঙ্গে নৌপথের যোগাযোগ নিরবচ্ছিন্ন করার জন্য ঢাকা শহরের সর্বত্র ছোট-বড় খাল কাটা হয়। পরবর্তী সময়ে খালগুলো শহরের পানি নিষ্কাশনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে। শত বছর আগে ব্রিটিশ স্থপতির তৈরি করা ঢাকার নগর পরিকল্পনায়ও নগরীর এসব খাল ও নদ-নদীর প্রয়োজনীয়তার গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

এখন যে ধোলাইখাল এলাকা আমরা দেখি, সেটা সত্যিই খাল ছিল এবং প্রথম শাসক সুবেদার ইসলাম খাঁ চিশতী নদ-নদী থেকে শহরের ভেতরে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন এবং শহরের নিরাপত্তা পরিখা হিসেবে খালটি খনন করেছিলেন। প্রখ্যাত পুরাতত্ত্ববিদ নলিনীকান্ত ভট্টশালীর মতে, ঢাকা নগরীর নিরাপত্তা বাড়ানো ইসলাম খাঁর অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল। ১৮৭২ সালে খালের মালিকানা চলে যায় ঢাকা পৌরসভার হাতে। তখন খালে যাতায়াতকারী জলযান থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ জলকর আদায় করা হতো। তখন বার্ষিক গড়ে ১৩ হাজার টাকা আদায় করা হতো। ১৮৩২ সালে ওই খালের ওপর ঢাকার কালেক্টর ওয়াল্টার একটি ঝুলন্ত সেতু নির্মাণ করেন, যা ছিল সে সময় প্রকৌশল সাফল্যের অন্যতম নিদর্শন। মূলত ঢাকার সঙ্গে নারায়ণগঞ্জের স্থলপথের সরাসরি যোগাযোগ নিশ্চিত করার জন্যই সেতুটি নির্মাণ করেছিলেন।

ডেমরা ও গেণ্ডারিয়া মিল ব্যারাক দিয়ে ধোলাইখালে নৌযান যাতায়াত করত, যার মাধ্যমে পুরান ঢাকার সূত্রাপুর, জনসন রোড, তাঁতীবাজার, নারিন্দা, গোয়ালনগর, বংশাল, তেজগাঁও, শাহবাগ, কারওয়ান বাজারসহ নগরীর বিস্তীর্ণ এলাকায় নৌ যোগাযোগে রক্ষা করা হতো। বর্ষাকালে ধোলাইখালে সাঁতার প্রতিযোগিতা এবং নৌকাবাইচ হতো। খালের দুই পাশে তখন মেলা বসত। ঐতিহাসিকদের মতে, নগরীর পানি নিষ্কাশনের সহজতর পথ তৈরি করাও ছিল ধোলাইখাল কাটার উদ্দেশ্য।

ঢাকা নগরী ঘিরে চার-পাঁচটি বড় বড় নদ-নদী থাকার পরও ছোট ছোট খাল খনন করা হয়েছিল যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ করতে। জানা যায়, ঢাকায় একসময় দুই থেকে তিন লাখ মানুষ বাস করত। ধীরে ধীরে সেটার সংখ্যা কয়েক গুণ বৃদ্ধি পায়। আর একে একে নগরীতে প্রায় ৪৬টি কৃত্রিম খাল খনন করা হয়।

মোগল আমলে রাজধানী ঢাকার সুনাম ছিল। কিন্তু সেখান থেকে রাজধানী সরিয়ে নেওয়ার পর শহরটি অনেকটা পরিত্যক্ত ঘোষিত হয়। ব্রিটিশ শাসনামলের প্রথম দিকেও এর তেমন উন্নতি হয়নি। ঢাকায় কর্মরত ব্রিটিশ নাগরিক ড. ওয়াইজ ১৮৬৮ সালে তাঁর এক প্রতিবেদনে ঢাকাকে নোংরা শহর হিসেবে উল্লেখ করেন। তখন ঢাকার খাল, বিল, পুকুরঘাট সব কিছু ঝোপঝাড়ে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। প্রচুর মশা হতো। একই বছর ঢাকায় বসবাসরত যাজক রেভারেন্ড এ ম্যাকেনা তাত্কালীন লেফটেন্যান্ট গভর্নর স্যার উইলিয়াম গ্রেটকে এক চিঠিতে বলেন, তিনি ভারতবর্ষে ১৭ বছর থাকলেও ঢাকার মতো নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর শহর আর দ্বিতীয়টি দেখেননি। শহরের কোনো উন্নয়ন পরিকল্পনা না করায় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।

 

http://www.kalerkantho.com/print-edition/grab-canal/2017/08/05/527898