৫ আগস্ট ২০১৭, শনিবার, ১২:২৪

ডিসি বাছাই শুরু

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকালীন প্রশাসন কেমন হবে এবং সেখানে নির্বাচন সংশ্লিষ্ট পদে কারা দায়িত্ব পালন করবেন? সাদা চোখে এ প্রশ্নের উত্তর অনেকেরই আগাম জানার কথা নয়। তবে প্রশাসন যারা চালান, তাদের কাছে এর একটি সরল হিসাব রয়েছে। বিশেষ করে ওই সময় ডিসি, এসপি, ইউএনও, ওসি এবং জুডিশিয়াল ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব কারা পালন করবেন তা এখনই অনেকটা আগাম বলে দিতে পারেন প্রশাসনের কর্ণধাররা। আগামী একাদশ নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্বে থাকা সরকার যত চেষ্টায় করুক না কেন, ওই ছকের বাইরে কিছুই করতে পারবে না।

গতকাল শুক্রবার নতুন জেলা প্রশাসক (ডিসি) পদে নিয়োগের জন্য কর্মকর্তা বাছাইয়ের (ফিটলিস্ট) প্রক্রিয়া শুরু করছে সরকার। সকালে সচিবালয়ে মন্ত্রীপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলমের সভাপতিত্বে তার অফিস কক্ষে জেলা প্রশাসক পদে নিয়োগের লক্ষে ফিটলিস্ট প্রণয়নের জন্য সাক্ষাৎকার শুরু হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নির্বাচনী ছকে প্রশাসন সাজাতে রোডম্যাপের প্রধান পরিকল্পনায় দুটি অ্যাজেন্ডাকে বেশি প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। এর একটি হলোÑ নির্বাচনকালে বিএনপিপন্থী কর্মকর্তাদের নির্বাচন সংশ্লিষ্টসহ সব ধরনের গুরুত্বপূর্ণ পদের বাইরে রাখা। দ্বিতীয় অ্যাজেন্ডায় থাকছেÑ আওয়ামী লীগ তথা মহাজোট সমর্থক কর্মকর্তাদের টার্গেটকৃত বেশির ভাগ পদে পদায়ন নিশ্চিত করা। এ উদ্দেশে এখন থেকেই নির্বাচনকালীন সরকারের জন্য কর্মকর্তাদের একাধিক বিকল্প টায়ার (ধাপ) প্রস্তুত করে রাখা হচ্ছে। জানা গেছে, ১৭, ১৮ এবং ২০তম ব্যাচের ২০৪ জন কর্মকর্তার জেলা প্রশাসক পদে নিয়োগের সাক্ষাৎকার শুরু হয়েছে। চলবে ১২ আগস্ট পর্যন্ত। কর্মকর্তা বাছাই কমিটির সভা সম্পর্কে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মাঠ প্রশাসন-২ শাখার সিনিয়র সহকারী সচিব দেওয়ান মাহাবুবুর রহমান স্বাক্ষরিত একটি নোটিশ গত ২৫ জুলাই জারি করা হয়েছে। আগামী অক্টোবরের মাঝামাঝি দেশের বিভিন্ন জেলার ডিসিদের বদলি প্রক্রিয়া শুরু করবে সরকার।

জানা গেছে, মূলত ভবিষ্যৎ নির্বাচনী ছক কষার অঙ্ক মহাজোট সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসেই শুরু করে। দায়িত্ব নেয়ার অল্প কিছুদিনের মধ্যে সরকারবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত ও সন্দেহভাজন বেশ কিছু কর্মকর্তাকে ওএসডি করা হয়। যাদের আর পোস্টিং দেয়া হয়নি। কিছু অংশকে ডাম্পিং কিংবা হয়রানিমূলক পোস্টিং দিয়ে কাবু করা হয়। এ ছাড়া এ তালিকার বেশির ভাগ কর্মকর্তাকে দফায় দফায় পদোন্নতি না দিয়ে একেবারে পেছনের কাতারে বন্দি করে ফেলে রাখা হয়েছে। পদোন্নতি ও ভালো পোস্টিং না পাওয়ায় এরা প্রশাসনের মধ্যে গত আট বছর তেমন কোনো প্রভাব বিস্তার করতে পারেননি। আর যারা তদবির করে পোস্টিং নিতে পেরেছেন, তারাও ছিলেন কোণঠাসা। এতে করে প্রথম অংশের বাস্তবায়ন এরই মধ্যে অনেকটা যথাযথভাবে সম্পন্ন হয়েছে। যেহেতু সংবিধান অনুযায়ী একাদশ সংসদের মেয়াদ ২০১৯ সালের ২৫ জানুয়ারি শেষ হওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে (২৫ অক্টোবর থেকে ২৪ জানুয়ারি) অনুষ্ঠিত হবে, তাই চ‚ড়ান্ত পর্ব বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এর অংশ হিসেবে গত কয়েক বছর ধরে প্রশাসনে বাধ্যতামূলক অবসর দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। গত ১০ বছরে অনেক যোগ্য ও মেধাবীকে বাধ্যতামূলক অবসর দেয়া হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে মন্ত্রীপরিষদের সাবেক সচিব আলী ইমাম মজুমদার ইনকিলাবকে বলেন, রাজনৈতিক বিবেচনায় ডিসি নিয়োগ না হওয়াই উত্তম। কারণ, সরকারের যে কোনো উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে মাঠপ্রশাসনে যোগ্য কর্মকর্তাদের দরকার। তিনি বলেন, জেলা প্রশাসক (ডিসি) নিয়োগ একটি নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার মধ্যে হয়। এ জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ডিসি ফিটলিস্ট তৈরি করে। তার ভিত্তিতেই নিয়োগ দেয়া হয়। তিনি মনে করেন, শুধু ডিসি নয়, এসপি, ইউএনও এবং ওসি নিয়োগও মেধার ভিত্তিতেই হওয়া উচিত। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, শিগগির মাঠ প্রশাসনের ডিসি, এডিসি ও ইউএনও পদে বেশ কিছু কর্মকর্তার দফতর বদলের সম্ভাবনা রয়েছে। এ জন্য একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছে। এদিকে প্রশাসনের কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, অভিজ্ঞতা ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন কর্মকর্তারা এখন আর মাঠপ্রশাসনে যেতে আগ্রহী হচ্ছেন না। ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের আচরণে বেশির ভাগ জায়গায় কর্মকর্তারা খুবই বিরক্ত। তবে যেসব কর্মকর্তা সরকারের অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে চান, তারা নিজ আগ্রহে ডিসি, এডিসি ও ইউএনও পদে যাওয়ার জন্য তদবির করেন।

জাতীয় নির্বাচনকালীন ডিসি, ইউএনও এবং নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন এমন কয়েকজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, নির্বাচনকালীন নির্বাচন কমিশন যতই নিরপেক্ষ ও কঠোর হোক না কেন, যেসব কর্মকর্তা নির্বাচন সংশ্লিষ্ট পদে দায়িত্ব পালন করবেন, তারা সত্যিকার নিরপেক্ষ না হলে সুকৌশলে ও সূ²ভাবে নির্বাচনী ফলাফলে প্রভাব বিস্তার করতে পারে। কারণ, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে ফল গণনা পর্যন্ত মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের দিয়ে কাজ করা হয়। এতে কেউ যদি নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন না করে, বিশেষ কোনো দল বা প্রার্থীর পক্ষে কাজ করতে চাইলে অনেক সুযোগ থাকে। যেমনÑ জাতীয় নির্বাচনে জেলা প্রশাসকরা রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করেন। এ দায়িত্ব পাওয়ার পর তারা নিজেদের মতো করে পোলিং অফিসার, প্রিজাইডিং ও সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার নিয়োগ দিতে পারেন। ফলে ভোট কারচুপির পরিকল্পনা থাকলে আস্থাভাজন এসব কর্মকর্তাকে দিয়ে তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব।

কর্মকর্তারা আরো বলেন, বিশেষ করে অনেক আগের পরিকল্পনা অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী আসনে সিভিল ও পুলিশ প্রশাসন একযোগে কাজ করলে তা শতভাগ বাস্তবায়ন করা সম্ভব। যেমন দেশের সব কয়টি আসনকে টার্গেট না করে সর্বোচ্চ ১০০ আসনকে টার্গেট করে নির্বাচনসংশ্লিষ্ট পদে পছন্দের কর্মকর্তা পদায়ন করা হয়। এখানে কর্মকর্তারা যে প্রার্থীর বিরুদ্ধে কাজ করবেন তার ভোট ব্যাংক সংশ্লিষ্ট ভোট কেন্দ্রগুলো মূলত টার্গেটের আওতায় আনা হবে। ভোট গ্রহণ শুরু হওয়ার পর যখন বিপুলসংখ্যক ভোটারের উপস্থিতি তৈরি হবে, তখন কৃত্রিমভাবে তুচ্ছ ঘটনা সৃষ্টি করে পুলিশকে দিয়ে লাঠিচার্জ করা হবে। এতে ভয় ও আতঙ্কে মহিলাসহ সাধারণ ভোটারদের অনেকে ভোট না দিয়েই চলে যাবেন। এ রকম আরো অনেক সূ² পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়।

https://www.dailyinqilab.com/article/90494/