৫ আগস্ট ২০১৭, শনিবার, ১২:১৩

জলাবদ্ধতার পর এবার ভাঙা রাস্তা

বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রাম বেহাল

বর্ষা এলেই দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামের সড়ক বেহাল হয়ে পড়বে—এটি এখন নিয়তি। সড়ক সংস্কার ও উন্নয়নে সিটি করপোরেশন প্রতি বছর গড়ে প্রায় ১২৫ কোটি টাকা খরচ করে। এরপরও ভাঙা সড়কের ভোগান্তি থেকে মুক্তি নেই। টানা বৃষ্টি এবং জলাবদ্ধতার কারণে গত দুই মাসে চট্টগ্রাম নগরের অন্তত ৩০০ কিলোমিটার সড়ক ভেঙেছে। সিটি করপোরেশনের প্রকৌশল বিভাগ বলছে, চার বছরের মধ্যে এবারই সড়কের (কিলোমিটারের হিসাবে) সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে।

দুই মাস ধরে বৃষ্টি আর জোয়ারের জলাবদ্ধতায় ভুগছে চট্টগ্রাম। গত এক সপ্তাহ ধরে বৃষ্টিজনিত জলাবদ্ধতা না থাকলেও ভাঙা সড়ক ভোগাচ্ছে বাণিজ্যিক রাজধানীর মানুষকে। ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারের জন্য নগরের বিধ্বস্ত সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থাকে বড় বাধা বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা। তাঁরা মনে করেন, চট্টগ্রামে ব্যবসার ক্ষতি হলে সারা দেশে এর বিরূপ প্রভাব পড়বে।

সড়ক সংস্কার ও উন্নয়নে প্রতি বছর শত কোটি টাকা ব্যয় হলেও তার সুফল জনগণ পাচ্ছে না বলে মন্তব্য করেছেন পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের সহসভাপতি প্রকৌশলী সুভাষ বড়ুয়া। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, প্রতি বছরই সড়ক ভাঙছে। এতে বুঝা যায় সড়ক ও উন্নয়নের নামে কোটি কোটি টাকা ব্যয় হলেও তা সম্পূর্ণ অপচয় হচ্ছে। সুশাসনের অভাবের কারণেই এই সমস্যা হচ্ছে। সুশাসনের অভাবে ব্যবস্থাপনা ঠিক থাকে না। তখন কাজের গুণগত মানও খারাপ হয়। কোনো ধরনের জবাবদিহি না থাকার কারণে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা ইচ্ছেমতো টাকা খরচ করছেন। কিন্তু তার সুফল নেই।

চলতি বছরের ৩১ মে, ১২ জুন এবং ৩, ৪, ২৩, ২৪ এবং ২৫ জুলাই ভারী বর্ষণের কারণে সৃষ্ট জলাবদ্ধতায় নগরের বিভিন্ন এলাকার সড়ক ডুবে যায়। ওই সাত দিনের জলাবদ্ধতায় নগরের মোট সড়কের প্রায় ৩০ শতাংশ মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নগরে সড়কের পরিমাণ ১ হাজার ৬৬ কিলোমিটার। এর মধ্যে প্রধান সড়ক ৩০০ কিলোমিটার। বাকিগুলো অলিগলির সড়ক।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রকৌশল বিভাগের কর্মকর্তারা বলেন, নগরের মূল সড়কই নষ্ট হয়েছে প্রায় দেড় শ কিলোমিটার। বাকি দেড় শ কিলোমিটার বিভিন্ন অলিগলির সড়ক। ক্ষতিগ্রস্ত ৩০০ কিলোমিটার সড়ক সংস্কারের জন্য ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়ে স্থানীয় সরকারমন্ত্রীকে গত ৩ জুলাই চিঠি দেন মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন।

২০১৪ সালে বর্ষা মৌসুমে চট্টগ্রাম নগরের ১০০ কিলোমিটার সড়ক ভেঙে যায়। পরের বছর ১৫০ কিলোমিটার এবং ২০১৬ সালে ১১০ কিলোমিটার সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই তথ্য সিটি করপোরেশনের প্রকৌশল বিভাগের।

সিটি করপোরেশনের বাজেট ও বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩-১৪ অর্থবছর থেকে ২০১৬-১৭ অর্থবছর পর্যন্ত চারটি অর্থ বছরে সড়কের রক্ষণাবেক্ষণ ও উন্নয়নে ব্যয় হয় ৫০১ কোটি টাকা। এই সময়ে সড়ক মেরামত করা হয় ৩৭৭ কিলোমিটার। গত অর্থবছরে (২০১৬-১৭) সড়ক সংস্কার ও উন্নয়নে (পুরোনো রাস্তা নতুন করে নির্মাণ) ব্যয় হয় ১৯০ কোটি ৭২ লাখ টাকা। চলতি অর্থবছরে সড়কের সংস্কার ও উন্নয়নে বরাদ্দ ধরা হয়েছে ৪৬২ কোটি ৫০ লাখ টাকা। প্রতিবছরই এই খাতে ব্যয় বাড়ছে।

কর্ণফুলী নদীর পারে ১২ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত মেরিনার্স সড়ক ২০১৪ সালের ২৩ জুলাই যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়। তিন বছর পার হওয়ার আগেই এই সড়কটি খানাখন্দে ভরে গেছে। একই অবস্থা ২০১৩ সালের অক্টোবরে উদ্বোধন হওয়া মুরাদপুর-অক্সিজেন সড়কেরও। উদ্বোধনের পরের বছরেই বৃষ্টিতে সড়কের বিভিন্ন অংশে ছোট-বড় গর্ত হয়। ওয়াসার খোঁড়াখুঁড়ির কারণে এই সড়কের অবস্থা বেহাল হয়ে পড়েছে।

নির্মাণের দুই-তিন বছরের মধ্যে সড়ক কেন ভেঙে যাচ্ছে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মাহমুদ ওমর ইমাম বলেন, চট্টগ্রামে পরিকল্পিত পানিনিষ্কাশনব্যবস্থা না থাকায় প্রবল বৃষ্টি ও জোয়ারের সময় বিভিন্ন সড়ক ডুবে যায়। ডুবে থাকা সড়কেই চলে ভারী যানবাহন। সড়ক নির্মাণের ক্ষেত্রে যথাযথ মান বজায় রাখা হয় না। এ ছাড়া বিভিন্ন সেবা সংস্থার খোঁড়াখুঁড়ি তো রয়েছেই। মূলত এই তিন কারণে চট্টগ্রামের সড়ক টেকে না। সঠিক মান অনুসরণ করে নির্মাণ করা হলে পিচ ঢালাইয়ের সড়ক ১০ বছর টেকসই হওয়ার কথা।

তবে সড়কের সংস্কার কাজের মানের ক্ষেত্রে কোনো প্রকৌশলগত ত্রুটি নেই বলে মনে করেন মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, এবার অতিবর্ষণ ও জলাবদ্ধতায় সারা দেশের রাস্তাঘাট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। চট্টগ্রামও এর বাইরে নয়। এ ছাড়া এখানে উন্নয়ন কাজের জন্য বিভিন্ন সেবা সংস্থা সড়ক খোঁড়াখুঁড়ি করছে। এতে পানি জমে সড়ক আরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) ২৪ কোটি ৭৫ লাখ টাকা ব্যয়ে ২০১৩ সালের জুন মাসে ৬ দশমিক ৩০ কিলোমিটার দীর্ঘ আরাকান সড়কের সংস্কার ও উন্নয়নকাজ করেছিল। চার বছর আগে নির্মিত এই সড়কের বেশির ভাগ অংশে পিচের অস্তিত্ব নেই। সড়কের বহদ্দারহাট অংশে উড়ালসড়কের র‍্যাম্প নির্মাণ করছে সিডিএ। আর পানির পাইপ বসানোর জন্য সড়কের এক পাশ খুঁড়েছে ওয়াসা।

এই সড়কের বিষয়ে দুই বাসচালক আবদুল হক ও জসিম উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, আরাকান সড়কের কাপ্তাই রাস্তার মাথা থেকে পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকত পর্যন্ত যেতে আগে সময় লাগত সর্বোচ্চ দুই ঘণ্টা। এখন এই পথ (প্রায় ২২ কিলোমিটার) পাড়ি দিতে সময় লাগে তিন থেকে চার ঘণ্টা। আগে যেখানে ৫-৬টি ট্রিপ (আসা-যাওয়া) দেওয়া যেত, এখন তিন ট্রিপের বেশি দেওয়া যায় না।

গতকাল সরেজমিনে দেখা যায়, নগরের সিডিএ অ্যাভিনিউ সড়কের ২ নম্বর গেট মোড়, নাসিরাবাদ সিঅ্যান্ডবি কলোনি ও জিইসি মোড়ের অংশে অসংখ্য খানাখন্দ। ভাঙা রাস্তায় যানবাহন চলাচল করছে ধীরগতিতে। গর্তের কারণে সৃষ্ট ঝাঁকুনিতে ভোগান্তি পোহাতে হয় যাত্রীদের। জিইসি মোড় থেকে প্রায় ৮ কিলোমিটার দূরে পোর্ট কানেকটিং রোডের নিমতলা, পোর্ট কলোনি ও বড়পোল এলাকায় সড়কের অনেক অংশে পিচের অস্তিত্বই নেই।

পোর্ট কলোনির বাসিন্দা হাফেজ আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, পাঁচ মাস ধরে পিসি রোড নষ্ট। একেবারে ভেঙেচুরে গেছে। ইট দিয়ে একবার ঠিক করলেও তা বেশি দিন থাকে না।

অটোরিকশাচালক শাহ আলম জানান, পুরো শহরের রাস্তাঘাট খারাপ। গাড়ি চালাতে কষ্ট হয়। ১০ মিনিটের পথ পাড়ি দিতে সময় লাগে এক থেকে দেড় ঘণ্টা।

পিসি রোডের নয়াবাজার থেকে প্রায় ২ কিলোমিটার দূরে আগ্রাবাদ এক্সেস রোডের ছোটপুল এলাকায় সড়কের উত্তর পাশের একাংশ কেটে বৈদ্যুতিক কেব্‌ল লাইন স্থাপনের কাজ চলছে। সড়কের আরেক পাশের গর্ত ভরাট করা হয়েছে ইট বিছিয়ে। সড়কের শান্তিবাগ এলাকা থেকে ব্যাপারিপাড়া পর্যন্ত অংশেও ছোট-বড় গর্ত রয়েছে।

সিটি করপোরেশনের প্রকৌশল বিভাগ সূত্র জানায়, ওয়াসা পানির পাইপ বসানোর জন্য নগরের অন্তত বায়েজিদ বোস্তামী সড়ক, আরাকান সড়ক, হাটহাজারী সড়ক (মুরাদপুর-অক্সিজেন), সিডিএ অ্যাভিনিউসহ ৩৪টি সড়কে খোঁড়াখুঁড়ি করছে।

প্রত্যাশিত বরাদ্দ না পাওয়ায় নিজস্ব তহবিলের টাকায় জোড়াতালি দিয়ে নগরের সড়কগুলো সংস্কার করতে হচ্ছে বলে জানান চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী লেফটেন্যান্ট কর্নেল মহিউদ্দিন আহমদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, নগরের একটি বড় অংশে ওয়াসার খোঁড়াখুঁড়ি চলছে। আবার কয়েকটি প্রধান সড়কে সিডিএর উড়ালসড়কের নির্মাণকাজ চলছে। আগামী ১৫ দিনের মধ্যে সব সড়ক সংস্কার করা সম্ভব হবে।

শুধু মূল সড়ক নয়, নগরের অলিগলির সড়কগুলোর অবস্থাও ভালো নয়। গত তিন দিনে সরেজমিনে নগরের জামালখানে আসকারদীঘির পূর্ব পাড় সড়ক, পলিটেকনিক এলাকার আবদুল হান্নান সড়ক, শুলকবহরের আবদুল লতিফ সড়ক, চকবাজারের আবদুল্লাহ খান সড়ক, কাতালগঞ্জের তিন নম্বর সড়ক, উত্তর আগ্রবাদের চৌমুহনী-ব্যাপারিপাড়া সড়ক ঘুরে দেখা যায়, বেশির ভাগ জায়গায় ছোট-বড় গর্ত। পিচ ঢালাই উঠে গেছে। অনেক সড়কে হাঁটাও দুষ্কর।

বিভিন্ন সড়কের দুরবস্থার বিষয়ে সিটি বাস সার্ভিস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি তরুণ দাশগুপ্ত প্রথম আলোকে বলেন, রাস্তায় এত বেশি গর্ত যে স্বাভাবিক গতিতে গাড়ি চালাতে পারছেন না চালকেরা। এতে যানজট হচ্ছে। আবার গর্তে পড়ে গাড়ির স্প্রিং, চাকা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। গাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ খাতেও ব্যয় বেড়েছে। ভাঙা সড়কের কারণে মানুষের দুর্ভোগের পাশাপাশি ব্যবসা-বাণিজ্যেরও ক্ষতি হচ্ছে।

বর্ষা মৌসুমে বারবার সড়ক ভেঙে যাওয়ায় তিনটি বিকল্প পদ্ধতিতে সড়ক নির্মাণের পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। বর্তমানে বিটুমিন পদ্ধতিতে (পিচ ঢালাই) সড়ক নির্মাণ করা হয়। চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মাহমুদ ওমর ইমাম বলেন, বিটুমিনের সবচেয়ে বড় শত্রু পানি। পানি জমে থাকলেই সড়ক নষ্ট হয়ে যায়। এর পরিবর্তে টেকসই সড়ক নির্মাণের জন্য রিজিড পেভমেন্ট (কংক্রিটের ঢালাই) বা মডিফাইড বিটুমিনাস কার্পেটিং (বিটুমিনের মধ্যে রাবার বা পলিমারের মিশ্রণ) কিংবা আরসিসি (রোলার-কমপেক্টেড কংক্রিট) পদ্ধতির যেকোনো একটি প্রয়োগ করা যেতে পারে।

এই অধ্যাপক বলেন, সড়ক নির্মাণে বর্তমানে যে টাকা খরচ হয়, এর চেয়ে দেড় গুণ বেশি খরচ পড়বে ওই তিন পদ্ধতির যেকোনো একটিতে। শুরুতে খরচ বেশি হলেও পরে রক্ষণাবেক্ষণ খরচ বর্তমানের চেয়ে অনেক কমবে। বারবার তাগাদা দেওয়ার পরও অদৃশ্য কারণে সিটি করপোরেশন এসব পদ্ধতি প্রয়োগ করছে না।

সড়ক নির্মাণে তিনটি বিকল্প পদ্ধতি ব্যবহারের বিষয়ে সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী বলেন, রিজিড পেভমেন্ট সড়ক নির্মাণের খরচ বিটুমিন সড়কের চেয়ে চার থেকে পাঁচ গুণ বেশি। আর প্রধান সড়কগুলো আরসিসিতে করার ক্ষেত্রে কিছু জটিলতা রয়েছে। অলিগলির কিছু সড়ক আরসিসিতে করা হচ্ছে। তবে বিদ্যমান পদ্ধতিতে সড়ক নির্মাণ ও সংস্কারের ক্ষেত্রে ঠিকাদারদের কাজের মান নিয়ে কিছু সমস্যা আছে বলে স্বীকার করেন প্রধান প্রকৌশলী।

ভাঙা রাস্তার কারণে চট্টগ্রাম নগরের যোগাযোগব্যবস্থা প্রায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। যানজটে কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ হোসেন জিল্লুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, শুধু রাজধানীতে প্রতিদিন যানজটের কারণে ৩০ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়। চট্টগ্রামে যানজটের কারণে ক্ষতি ঢাকার চেয়ে বেশি হবে। কেননা সেখানে চট্টগ্রাম বন্দরসহ বেশ কটি শিল্পাঞ্চল রয়েছে। যানজটের কারণে অর্থনৈতিক ক্ষতির পাশাপাশি মানুষের সামাজিক যোগাযোগ এবং মনস্তাত্ত্বিক ক্ষতিও কম নয়। ফলে চট্টগ্রামের যানজট বাংলাদেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।

বিশেষজ্ঞ মত

দক্ষতা ও সুশাসনে ধস

হোসেন জিল্লুর রহমান, অর্থনীতিবিদ

বর্ষায় চট্টগ্রামে জলাবদ্ধতা যে হবে, তা তো সবারই আগেই জানা ছিল। আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাসে বেশি বৃষ্টি হতে পারে বলা হয়েছিল। কিন্তু চট্টগ্রামের উন্নয়ন প্রশাসনে যাঁরা দায়িত্বে ছিলেন, তাঁরা কি এ জন্য যথেষ্ট প্রস্তুত ছিলেন? এই প্রশ্ন এখন অনেক বড় হয়ে সামনে এসেছে। আমরা চট্টগ্রামে দেখলাম সেখানকার প্রশাসনের আগাম প্রস্তুতির কোনো বালাই ছিল না। ঘাড়ের ওপরে যখন সমস্যাটি এসেছে, পুরো শহর জলাবদ্ধ হয়ে বড় ধরনের বিপর্যয়কর অবস্থা তৈরি হয়েছে, তখন টোটকা সমাধানের পথে আমরা হাঁটতে দেখেছি।

চট্টগ্রাম শহরে সড়ক নির্মাণ ও তদারকির ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটি আমরা দেখেছি। কিন্তু আমরা দেখেছি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) ও চট্টগ্রামের যেসব রাজনীতিবিদ মন্ত্রী হয়েছেন, তাঁরা নিজেদের একটি ক্ষমতার বলয় তৈরি করে কাজ করছেন। প্রত্যেকে যার যার পোষা প্রকল্প (পেট প্রজেক্ট) নিয়ে ব্যস্ত। কেউ মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চল, কেউ উড়ালসড়ক, কেউ বন্দর আবার কেউ সড়ক নিয়ে ব্যস্ত। কিন্তু চট্টগ্রাম শহরের সমস্যার সমন্বিত সমাধানের ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি।

চট্টগ্রামে আরেকটি বিষয় আমরা দেখতে পাচ্ছি উন্নয়নের ক্ষেত্রে জনচাহিদাকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। উড়ালসড়কগুলো নির্মাণ তার একটি বড় উদাহরণ। সড়ক মেরামতে বছরে ৫০০ কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে, প্রতি কিলোমিটারে বছরে কোটি টাকার ওপরে খরচ হচ্ছে। কিন্তু তার ফলাফল হিসেবে চট্টগ্রামের মানুষের সড়কপথে গতি অর্ধেক কমে যাচ্ছে। অর্থাৎ উন্নয়নের ফলাফল হিসেবে খরচ দ্বিগুণ বাড়ছে আর এই গতি অর্ধেক কমছে। আর এই উন্নয়নের ফলে সাধারণ মানুষের ক্ষতি হচ্ছে, দুর্দশা বাড়ছে। আর ক্ষমতার বলয়ে থাকা মানুষেরা লাভবান হচ্ছে।

জনচাহিদাকে আমলে না নেওয়া ও সুশাসনের অভাবের কারণে উন্নয়ন অকার্যকর হয়ে যাচ্ছে। এ ধরনের উন্নয়ন শুধু চট্টগ্রাম বা ঢাকায় না, সারা দেশে আমরা দেখতে পাচ্ছি। যা জনকল্যাণ নিশ্চিত করছে না। ক্ষমতা বলয়ের আশীর্বাদপুষ্ট গুটিকয়েক ব্যক্তি ও গোষ্ঠীকে যা লাভবান করছে।

http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/1277406