৫ আগস্ট ২০১৭, শনিবার, ১১:৫৮

নিরপেক্ষ নির্বাচন নিয়ে আপিল বিভাগের পর্যবেক্ষণ যথার্থ

আইনবিদদের অভিমত

সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করে আপিল বিভাগের রায়ে নিরপেক্ষ ব্যবস্থায় জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পর্কে পর্যবেক্ষণ দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে হস্তক্ষেপমুক্ত নির্বাচন না হলে গণতন্ত্র বিকশিত হতে পারে না। বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের অভাব হলে একটি গ্রহণযোগ্য সংসদ প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না বলেই আমাদের নির্বাচন প্রক্রিয়া এবং সংসদ শিশু অবস্থায় রয়ে গেছে। জনগণ এ দু’টি প্রতিষ্ঠানের ওপর আস্থা রাখতে পারছে না। এ দু’টি প্রতিষ্ঠান যদি জনগণের আস্থা এবং শ্রদ্ধা অর্জনের জন্য প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ থেকে বিরত থাকে তাহলে কোনো গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হতে পারে না। আদালতের এই অভিমত সঠিক এবং দেশের বর্তমান অবস্থার প্রতিফলন হয়েছে বলে আইন বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।

এ বিষয়ে সাবেক আইনমন্ত্রী ও সিনিয়র আইনবিদ ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের এই রায় ইতিহাসের ল্যান্ড মার্ক। এটি একটি চমৎকার রায়। রায়ে বলা হয়েছেÑ আমাদের গণতন্ত্র শিশুর পর্যায়ে রয়েছে। স্বাধীনতার ৪৭ বছর পেরিয়ে গেলেও স্বাধীন ও নিরেপক্ষ প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করা হয়নি। তিনি বলেন, নির্বাচনকালে দলীয় সরকার থাকলে নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়। আর নিরপেক্ষ নির্বাচন না হলে কর্তৃত্ববাদী সরকার থাকে।

নিরপেক্ষ নির্বাচন ছাড়া গণতন্ত্র বিকশিত হবে নাÑ আপিল বিভাগের এই অভিমত সম্পর্কে মওদুদ আহমদ বলেন, বিচারপতিরা যেখানে বসেন, সেখানে থেকে সব কিছু বুঝতে পারেন। তারাও দেশের নাগরিক। আমাদের যে প্রতিক্রিয়া হয় তা তারা বুঝেন। তারা বিচ্ছিন্ন কোনো দ্বীপ নন।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ও সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি প্রবীণ আইনবিদ অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, আমাদের সংবিধান অনুযায়ী জনগণই সব ক্ষমতার অধিকারী। জনগণ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এই অধিকার প্রতিফলন ঘটায় সুষ্ঠু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে। কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার তাদের অধীনে জাতীয় নির্বাচন করে ক্ষমতা ধরে রাখার চেষ্টা চালায়। ফলে সে নির্বাচন সুষ্ঠু হয় না, জনগণ স্বাধীনভাবে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে না। তাই আমাদের দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ১৯৯৬ সালে বিএনপি সরকার নির্বাচনকালীন সময়ের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করেছিল। অথচ বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট একই অবস্থায় থাকা সত্ত্বেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান বাতিল করে দিয়েছে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি একটি প্রহসনের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে তারা ক্ষমতায় আসে এবং তারই পরিপ্রেক্ষিতে দেশ আজ এক চরম অবস্থায় পৌঁছেছে। হত্যা-গুম, দুর্নীতি, বিরোধী দলের হাজার হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলার ফলে দেশে আজ এক অরাজক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এই পরিস্থিতি থেকে মুক্ত হতে হলে আগামী জাতীয় নির্বাচন অবশ্যই সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ হতে হবে। কিন্তু ক্ষমতাসীন দল ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন করলে সে নির্বাচন কোনোভাবেই সুষ্ঠু হতে পারে না। নির্বাচন কমিশন যতই নিরপেক্ষ থাকুক সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় নির্বাচন সুষ্ঠু হতে পারে না। নির্বাচন কমিশনকে প্রশাসনের ওপর নির্ভরশীল থাকতে হয় বলে তারা সুষ্ঠু নিরপেক্ষ করতে সক্ষম হবে না। এই বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে ষোড়শ সংশোধনীর রায়ের মধ্য দিয়ে, মাননীয় প্রধান বিচারপতি রায়ে এটি উল্লেখ করেছেন। এ ব্যাপারে দ্বিমতের কোনো অবকাশ নেই। আশা করি সরকার এ ব্যাপারে সদইচ্ছা পোষণ করে নির্বাচনকালীন সময়ের জন্য একটি সহায়ক সরকারের ব্যবস্থা করে দেশকে একটি আশু সঙ্কট থেকে রক্ষা করবে।

এ বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন বলেন, আমরা এক অদ্ভুত অবস্থার মধ্যে আছি। দেশ জনগণের, সার্বভৌমত্ব জনগণের। এমন অবস্থায় প্রধান বিচারপতি বলেছেন পঙ্গু সমাজ। আমি বলব আতঙ্কিত সমাজ। নিরপেক্ষ নির্বাচন ছাড়া গণতন্ত্র বিকশিত হবে নাÑ আপিল বিভাগের রায়ের এ বিষয় সম্পর্কে তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশনের সুষ্ঠু নির্বাচন করার ক্ষমতা নেই। তবে এখানে নির্বাচন কমিশনকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের রায়ে তাদের হাত-পা বেঁধে দেয়া হয়েছে। এটি রিভিউ করা প্রয়োজন। নির্বাচন কমিশন স্বাধীনভাবে নির্বাচন করতে চায়। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী, অন্যান্য মন্ত্রী ও এমপিরা ক্ষমতায় বহাল থাকা অবস্থায় নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়। তিনি বলেন, সুপ্রিম কোর্ট পবিত্র দায়িত্ব পালন করছেন। তাদের এই সাহস দেখানোর জন্য জাতি কৃতজ্ঞ থাকবে।

সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, রায়ে কিছু কিছু ভালো কথা রয়েছে। রায়ের পর্যবেক্ষণগুলো তাৎপর্যপূর্ণ। রায়ে নির্বাচন সম্পর্কে অভিমত দেয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশন একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান। এটি নিয়ে প্রশ্ন তোলার অধিকার কারো নেই। তিনি বলেন, সহায়ক সরকার কি স্বর্গ থেকে আসবে। যে সময় যে দল ক্ষমতায় থাকবে তারা সহায়ক সরকার। নির্বাচন কমিশনকে নির্বাচন পরিচালনা করতে সহায়তা করবে।

এ বিষয়ে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব:) সাখাওয়াত হোসেন বলেন, নির্বাচন ও নির্বাচন কমিশন নিয়ে আদালত যে অভিমত দিয়েছেন তা নতুন কিছু নয়। এটিই অবস্থা। শুরু থেকেই। বিএনপি-আওয়ামী লীগসহ পর্যায়ক্রমে যারা ক্ষমতায় এসেছে তারা ক্ষমতায় বসে এই প্রতিষ্ঠানকে দুর্বল করেছে। তিনি বলেন, আমাদের নির্বাচন কমিশন গঠন প্রক্রিয়া সঠিক নয়। স্বাধীনতার ৪৬ বছর আদালত নতুন কথা বলেননি। বর্তমান নির্বাচন কমিশন বলেছে ৫ জানুয়ারি ও ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের মতো নির্বাচন তারা করতে চান না। কাজেই এটি নতুন কোনো বিষয় নয় আদালত বর্তমান অবস্থাটাই তুলে ধরেছেন।

আপিল বিভাগের রায়ে দু’টি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে : তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাসংক্রান্ত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর বিষয়ে সে সময়কার প্রধান বিচারপতি রায়ে বলেছেন, সংখ্যাগরিষ্ঠের রায়ে আপিল বিভাগ মত দিয়েছিলেন, দু’টি সংসদীয় নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে। রায়ে বলা হয়েছে, সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে আদালত এই অভিমত দেন যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অধীনে দু’টি সংসদীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে। তবে শর্ত হলো, বিলুপ্ত হওয়া ৫৮(ক) অনুচ্ছেদের ৩ ও ৪ দফা অনুযায়ী সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি কিংবা আপিল বিভাগের সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিকে প্রধান উপদেষ্টা পদে নিয়োগ করা যাবে না। যে শর্তে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচন সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি বা অবসরপ্রাপ্ত আপিল বিভাগের বিচারপতিদের মধ্য থেকে করা উচিত হবে না। এই আদালত মনে করেন, এই ব্যবস্থাটি পালন করে প্রধান বিচারপতি নির্বাচনে রাজনৈতিকীকরণের সম্ভাবনা রয়েছে এবং বিকল্পভাবে নির্বাচন কমিশনকে আরো ক্ষমতাপ্রাপ্ত এবং প্রাতিষ্ঠানিকভাবে করা উচিত যাতে সংসদীয় নির্বাচনগুলো সর্বদা যথাযথভাবে অনুষ্ঠিত হতে পারে।

সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন বলেন, সংবিধানের ১৩তম সংশোধনীর রায়ে আদালত বলেছিলেন আরো দু’টি সংসদীয় নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে। ষোড়শ সংশোধনী বিষয়ে আপিল বিভাগের রায়ে এ সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। ষোড়শ সংশোধনী মামলার রায়ে অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে বক্তব্য উপস্থাপন কালে সুপ্রিম কোর্টের প্রবীণ আইনজীবী সাবেক বিচারপতি টিএইচ খান এই বিষয়টি আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক আদালতে ঘোষিত রায়ে আরো দু’টি সংসদীয় নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে বলে উল্লেখ করেছিলেন। তবে বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের লিখিত রায়ে ওই বিষয়টি আর রাখা হয়নি।

জয়নুল আবেদীন আরো বলেন, আপিল বিভাগের রায়ে পর্যবেক্ষণে একটি শক্তিশালী নির্বাচন কমিশনের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কথা বলা হয়েছে। রায়ে সংসদ ও নির্বাচনের বর্তমান চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।

বিএনপির আইন সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেন, আমাদের গণতন্ত্রকে বিকশিত করার জন্য সব দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অপরিহার্য। আর ওই নির্বাচন অর্থবহ ও গ্রহণযোগ্য করতে গেলে নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থার কোনো বিকল্প নেই। তত্ত্বাবধায়ক সরকার সম্পর্কে রায়ে আপিল বিভাগ যথার্থ বলেছেন। দু’টি জাতীয় সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে এটা ত্রয়োদশ সংশোধনী বিষয়ে আদালতে ঘোষিত সংক্ষিপ্ত রায়ে ছিল। তবে সাবেক প্রধান বিচারপতি অবসরে যাওয়ার পর যে লিখিত রায় দিয়েছেন সেখানে এই বিধান বাদ দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, আমরা মনে করি ১৯৯১ সালের ফর্মে সবপক্ষের মতামতের ভিত্তিতে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকার হতে পারে।

নিরপেক্ষ নির্বাচন বিষয়ে আপিল বিভাগের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, এই আদালত মনে করে একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য সরকার নির্বাচন কমিশনকে সর্বপ্রকার ক্ষমতা দিয়ে শক্তিশালী করবে, যাতে নির্বাচন কমিশন কোনো প্রকার হস্তক্ষেপ ছাড়াই কাজ করতে পারে এবং সরকারের হস্তক্ষেপ ছাড়া নির্বাচন কমিশনের স্বয়ংক্রিয়ভাবে শূন্য পদে নিয়োগ দিতে পারে। অথচ কোনো সরকারই এই বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। এমনকি বিরোধীদলীয় রাজনৈতিক দলও সংসদ বা কোনো ফোরামেই নির্বাচন কমিশনকে প্রাতিষ্ঠানিক হয়নি।

স্বাধীন ও সুষ্ঠু নির্বাচনের অনুপস্থিতিতে পার্লামেন্ট বিজ্ঞ রাজনীতিবিদদের নিয়ে গঠন হয় না এবং পার্লামেন্ট নিজেই প্রাতিষ্ঠানিকীকরণে হস্তক্ষেপ করতে পারে।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/241568