১৮ জুলাই ২০১৭, মঙ্গলবার, ১১:৩৭

কুরবানির পশুর দেড় কোটি চামড়ার কি হবে?

সংকট কাটছেনা ট্যানারি শিল্পের। হাজারিবাগে গ্যাস, বিদ্যুৎ আর পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার প্রায় দুই মাস হয়ে গেলেও গ্যাস সংযোগ মিলছেনা সাভারের চামড়া শিল্পনগরীতে। আসছে কুরবানি ঈদে ৬০ লাখ গরু-মহিষ আর ১ কোটি ছাগল ভেড়া জবাই হতে পারে। কিন্তু এত পরিমাণে চামড়া প্রক্রিয়াকরণ করতে এখনও প্রস্তুত হয়ে ওঠেনি সাভারের চামড়া শিল্পনগরী। এতে করে প্রতিবেশি দেশে কাচা চামড়া পাচার হওয়ার আশঙ্কা আরও বাড়ছে। সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াকরণের সক্ষমতা রয়েছে মাত্র আটটি ট্যানারির। ৮ টি ট্যানারিতে বছরে মাত্র ১০/১২ লাখ চামড়া প্রক্রিয়াকরণে সক্ষম। বাকি দেড় কোটি চামড়ার কি হবে। চামড়া নিয়ে বিপাকে পড়বে ব্যবসায়ীরা আর বঞ্চিত হবে হকদাররা।
চামড়া প্রক্রিয়াকরণে এখন সক্ষম সাভারের ট্যানারি শিল্প। বিসিকের এমন রিপোর্টে হাজারিবাগ থেকে ট্যানারি শিল্প স্থনান্তরের ঘোষনা দেয় সরকার। ২০০৩ সালে কাজ শুরু হয়ে ২০০৬ সালে কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও গত ১৪ বছরের কাজ শেষ হয়নি। পুরো কাজ শেষ হতে আরও সময় লাগবে কয়েক বছর। অথচ মিথ্যা রিপোর্টের ওপর আদালতের রায়ে গ্যাস, বিদ্যুৎ পানির লাইন বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হলো। এর আগে রায় না মানার কারণে আদালত জরিমানাও করে ট্যানারি মালিকদের। এখন দেখা যাচ্ছে কাজ শেষ হয়নি এক তৃতীয়াংশও। এতে করে কোটি কোটি টাকার রফতানি অর্ডার হারালো ট্যানারি মালিকরা। বেকার হলো কয়েক লাখ শ্রমিক। কিন্তু কার স্বার্থে এ শিল্প ধ্বংস করা হলো তা এখনও অজানা।
সিইটিপি আর ডাম্পিং স্টেশনের কাজও বাকি অনেক। তাই উৎপাদন বন্ধ, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে রপ্তানী। এখন ঈদকে সামনে রেখে শ্রমিক অসন্তোষের আশংকা করছেন ট্যানারি মালিকরা। এক সময় দিন রাত কাজ চলতো এসব ট্যানারিতে। এখন নিস্তব্ধ স্থবির আর পরিত্যাক্ত হয়ে পরে আছে সবকিছু।
সাভারে স্থানান্তরের জন্য গেলো মে মাসের ৮ তারিখ হাজারিবাগে গ্যাস, বিদ্যুৎ আর পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার পর এখন চরম বিপাকে এই শিল্প। হাজারিবাগে সব কাজ বন্ধ, আবার সাভারের আধুনিক চামড়া শিল্প নগরী পুরোপুরি প্রস্তুত না হওয়ায় সেখানে শুরু করা যাচ্ছেনা কাজ। এমনকি হাইকোর্টের নির্দেশনা থাকার পরও মিলছেনা গ্যাসের সংযোগ। তাহলে এখন বিসিকের বিরুদ্ধে কি রায় দেবে? চামড়া শিল্পের এ ক্ষতিপূরণ কিভাবে হবে। এ ক্ষতির দায়ভার কে নেবে? লাখ শ্রমিকের পরিবার কে চালাবে?
এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে, চামড়ার অভ্যন্তারিণ বাজার এবং রপ্তানীতে। তাই ঈদকে সামনে রেখে শ্রমিকদের পাওনা বকেয়া পরিশোধ নিয়ে শংকায় ট্যানারি মালিকরা। প্রতিবছর ঈদুল ফিতর এবং ঈদুল আযহায় সব চেয়ে বেশি কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করা হলেও এবারের পরিস্থিতি একেবারেই ভিন্ন। ব্যাবসায়ীরা বলছেন, সরকার সাভারের প্রস্তুতি শেষ না করে হাজারিবাগের গ্যাস, পানি আর বিদ্যুতের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়েছে সম্ভাবনাময় চামড়া শিল্পকে।
কোরবানি আসতে দেড় মাসের কিছু সময় বাকি। দেশে সারাবছর যে পরিমাণ চামড়ার জোগান আসে, এর ৫০ থেকে ৫৫ শতাংশ আসে কোরবানির ঈদে। এ সময় দেশে প্রায় ৬০ লাখ গরু-মহিষ জবাই হয়। এ ছাড়া কোটিখানেক ছাগল-ভেড়ার চামড়া পাওয়া যায়। কিন্তু এত পরিমাণে চামড়া প্রক্রিয়াকরণ করতে এখনও প্রস্তুত হয়ে ওঠেনি সাভারের চামড়া শিল্পনগরী। সেখানে মাত্র এক-তৃতীয়াংশ কারখানা চালু হলেও সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াকরণের সক্ষমতা রয়েছে মাত্র আটটি ট্যানারির। এতে কোরবানির চামড়া নিয়ে বিপাকে পড়বে ব্যবসায়ীরা। এর প্রভাব পড়তে পারে কোরবানির পশুর চামড়ার দামেও।
সাভারের ট্যানারি মালিকরা বলছেন, শিল্পনগরীতে বরাদ্দপ্রাপ্ত ১৫৪টির মধ্যে মাত্র এক-তৃতীয়াংশ ট্যানারি এখন চালু হয়েছে। তবে অধিকাংশ ট্যানারি শুধু চামড়া কাঁচা প্রক্রিয়াকরণের প্রথম ধাপের ওয়েট ব্লু উৎপাদন কাজ শুরু করতে পেরেছে। কিন্তু প্রক্রিয়ায় মধ্যবর্তী ধাপ- ক্রাশড লেদার ও পণ্য তৈরির উপযোগী ফিনিশড লেদারের তৈরি করার সুবিধা নেই সে সবের বেশিরভাগ ট্যানারিতে। হাতেগোনা কয়েকটি ট্যানারি সম্পূর্ণ চামড়া প্রক্রিয়াকরণে সক্ষম। এ কারণে কোরবানির পশুর চামড়া কেনার ক্ষেত্রে তেমন আগ্রহ থাকবে না অধিকাংশ ট্যানারি মালিকের।
বাংলাদেশ ট্যানার্স এসোসিয়েশনের (বিটিএ) সভাপতি শাহিন আহমেদ বলেন, ক্রাশড ও ফিনিশিংয়ের কাজ করছে গ্যাস সংযোগ প্রাপ্তদের মধ্যে আটটি ট্যানারি। এসব ট্যানারিতে মাত্র ৮/১০ লাখ চামড়া ফিনিশড লেদার তৈরি করতে পারবে। বাকি প্রায় দেড় কোটি চামড়ারর ভবিষৎ নিয়ে আমরা চিন্তিত। এতে করে চামড়া ব্যবসায়ী এবং গরিব হকদাররা ক্ষতিগ্রস্ত ও বঞ্চিত হবেন। যারা গ্যাস সংযোগের অভাবে এসব প্রক্রিয়া চালু করতে পারেনি, তারা চরম প্রতিযোগিতায় পড়বে। অনেকে লোকসানের ভয়ে কোরবানির চামড়ায় আগ্রহ দেখাবে না। এমনটা হতেই পারে। এ ছাড়া অনেক ট্যানারি মালিক অবকাঠামোর কাজের জন্য পূঁজি সংকটে ভুগছে। তারাও চামড়া কিনতে পারবে না।
সরেজমিন সাভার চামড়া শিল্পনগরী ঘুরে দেখা গেছে, শিল্পনগরীর এখনও অনেক প্লট একেবারেই খালি পড়ে রয়েছে। আর সম্পূর্ণ প্রস্তুত কারখানা আটটি। এর বাইরে চামড়া প্রক্রিয়াজাত করতে যারা শুরু করেছে তাদের মধ্যে বেশিভাগেরই আবার অবকাঠামো শতভাগ প্রস্তুত নয়। তার মধ্যেই চলছে চামড়ার কাজ। নগরীর সামনের সারিতে কয়েকটি বড় ট্যানারির কাজ করছে তবে পেছনের দিকে এখনও বেশিভাগের কাজ শুরু হয়নি অথবা একেবারেই প্রাথমিক পর্যায়ে।
এদিকে যারা প্রক্রিয়াকরণ শুরু করেছে, তাদের মধ্যে বেশিভাগ ট্যানারি শুধু কাঁচা চামড়া প্রক্রিয়াকরণের ওয়েট ব্লু করছে। কিন্তু ক্রাশড লেদার তৈরি করার সুবিধা নেই। সেক্ষেত্রে ওইসব ট্যানারি পরবর্তীতে অন্য ট্যানারি থেকে ক্রাশড করাচ্ছে। আবার পণ্য তৈরির উপযোগী ফিনিশড লেদারের কাজ হচ্ছে আরেক জায়গায়।
এ ধরনের বিক্ষিপ্ত অবস্থা আসন্ন কোরবানির ঈদে সংগৃহীতব্য চামড়ার ওপর প্রভাব ফেলতে পারে’ বলে জানিয়ে ইউসুফ ট্যানারির মালিক ইউসুফ আলী বলেন, সবাই এখন স্বাভাবিক পরিমাণের কাজ তুলতেই চাপের মধ্যে পড়ছে। তখন তো অনেক বেশি চামড়া আসবে। এ অল্পসংখ্যক রেডি ট্যানারিতে এতো চামড়া কীভাবে প্রক্রিয়াকরণ হবে? এ কারণে এবার ব্যবসায়ীরা কোরবানির চামড়ার প্রতি আগ্রহ হারাবে। এতে চামড়ার দাম এবারও কম হবে।
সাভারের ব্যবসায়ীরা এমন অবস্থার জন্য গ্যাস সংযোগ না পাওয়াকে দায়ী করছে। তারা বলছেন, এখনও গ্যাস সংযোগ না পাওয়ায় কারখানা চালু করা যাচ্ছে না। হাজারীবাগে থাকা ৬৬টি বাণিজ্যিক লাইনধারী ট্যানারিকে এখন পর্যন্ত গ্যাস দেওয়া হয়েছে। যাদের মধ্যে অনেকে আবার ট্যানারির অবকাঠামোর কাজ সম্পূর্ণ করতে পারেনি। কিন্তু অনেকে ট্যানারি অবকাঠামোর কাজ শেষ করে বেকার বসে আছে গ্যাসের সংযোগের অভাবে। অনেকে গ্যাস ছাড়াই বিকল্প ব্যবস্থায় প্রক্রিয়াকরণ করছে। কিন্তু খরচে পোষাতে পারছে না।
কিন্তু সরকারের নিযুক্ত মহলের দাবি, ওই এলাকার চারপাশের সব সড়ক ঘিরে গ্যাসের লাইন বসানোর কাজ সম্পন্ন হয়েছে ২০০৬ সালে। শিল্পনগরীর অভ্যন্তরে গ্যাসের লাইনে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু ১১ বছর আগে গ্যাসের লাইন বসানোর কাজ শেষ হলেও অনেক ট্যানারি মালিক নিজ নিজ প্লটের সংযোগের জন্য আবেদন করেননি। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গ্যাস সংযোগ দিচ্ছে তিতাস গ্যাস।
গত মাসে জাতীয় সংসদে কাজের ধীরগতির কথা জানিয়ে শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু জানান, সাভারের ট্যানারি শিল্পনগরীতে এ পর্যন্ত ৩৫ শতাংশ ট্যানারি স্থানান্তরিত হয়েছে। বাকি ট্যানারিগুলো তাদের ভবন নির্মাণ ও ড্রাম মেশিনারি স্থাপন কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। ৩১ মে পর্যন্ত সাভারে বরাদ্দপ্রাপ্ত ১৫৪টি ট্যানারির মধ্যে ৫৫টি ওয়েট ব্লু উৎপাদন কাজ শুরু করেছে। শিগগির আরও কিছু ট্যানারি শিল্প তাদের উৎপাদন কার্যক্রম আরম্ভ করবে।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত বিদ্যুৎ সংযোগের জন্য পল্লীবিদ্যুৎ সমিতির কাছে আবেদন করেছে ১৫২টি ট্যানারি। এর মধ্যে ১০৭টিকে ডিমান্ড নোট দেওয়া হয়েছে। গ্যাস সংযোগের জন্য আবেদন করলেও ১০৫টি ট্যানারি এখনও গ্যাস পায়নি। এ ছাড়া পানির সংযোগের জন্য আবেদন করেছে ৮৯টি ট্যানারি। সম্পূর্ণ উৎপাদন প্রক্রিয়ায় যাওয়ার মতো অবস্থা রয়েছে আট ট্যানারির। বাকিগুলোর মধ্যে যারা অবকাঠামোর কাজ করছে তাদের ১০-৮০ শতাংশ অবকাঠামো শেষ হয়েছে।
প্রতি বছর কুরবানি এলেই সীমান্ত দিয়ে ভারতে কাচা চামড়া পাচার হয়ে তাকে। চামড়া পাচার ঠেকাতে সরকার নানা উদ্যোগ নিলেও পাচার বন্ধ হয় না। এ বছর পাচার হওয়ার আশঙ্কা আরও বেড়েছে কয়েকগুন। কারণ সাভারে মাত্র এখনও পর্যন্ত মাত্র ৮টি ট্যানারি চালু হয়েছে। বাকি ট্যানারি মালিকরা বেশি চামড়া কিনতে চাইবে না। ফলে বাধ্য হয়ে কাচা চামড়া ভারতে পাচার করবে সীমান্তবর্তি ব্যবসায়ীরা। এতে করে চামড়ার আর্ন্তজাতিক বাজার হারাবে বাংলাদেশ।

 

http://www.dailysangram.com/post/292144-