১৮ জুলাই ২০১৭, মঙ্গলবার, ১১:৩৬

একতরফা নির্বাচনের দিকেই এগুচ্ছে ইসি

# রোডম্যাপ জাতিকে হতাশ করেছে -ড. তারেক 

# ইসির আন্তরিকতা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে -ছহুল হোসাইন
# তফশিল ঘোষণার আগেও সুষ্ঠু নির্বাচনের বাধা-বিপত্তি দূর করার সহায়তা সরকারের কাছে চাইতে পারে কমিশন - ড. শাহদীন মালিক
# নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করুন, রাস্তা তৈরি করুন -বিএনপি
# ঘোষিত রোডম্যাপ বাস্তবসম্মত -আ’লীগ
# বর্তমান ইসিকে বিদায়ী ইসির পথে দেখতে চায় না জাতি -জামায়াত
 আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে নির্বাচন কমিশনের ঘোষিত রোডম্যাপ জাতিকে হতাশ করেছে। রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য সমান সুযোগ রেখে লেবেল প্লেইং ফিল্ড তৈরির বিষয়ে কোন নির্দেশনা নেই রোডম্যাপে। তাই এ রোডম্যাপের মাধ্যমে বিরোধী দলকে নির্বাচন থেকে দূরে রেখে ৫ জানুয়ারীর মতো একতরফা নির্বাচনের দিকেই নির্বাচন কমিশন এগুচ্ছে বলে মনে করছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও বিশিষ্টব্যক্তিগন। তবে আওয়ামী লীগ এ রোডম্যাপকে বাস্তবসম্মত বলে স্বাগত জানিয়েছে।
নির্বাচন ও সংবিধান বিশেষজ্ঞদের মতে, অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করার ক্ষেত্রে ইসির ভূমিকা কি হবে তা রোডম্যাপে পরিস্কারভাবে উঠে আসেনি। দেশের অধিকাংশ জনগণ যে ধরনের নির্বাচন চায় সেই নির্বাচনের রোডই এখনও তৈরি হয়নি। তার আগেই ম্যাপ তৈরি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে ইসি। আর বর্তমান সরকারের অধীনেই সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব বলে সিইসির বক্তব্য নিয়ে তীব্র সমালোচনা করছেন তারা। নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন, শক্তিশালী, কার্যকর এবং অর্থবহ করার বিষয়ে ইসির আন্তরিকতা পরিলক্ষিত হয়নি। সকল দলের অংশ গ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য কোন পদক্ষেপের কথা বলেনি ইসি। বরং তফসিল ঘোষণার আগে লেবেল প্লেইং ফিল্ড তৈরির বিষয়ে ইসির করণীয় কিছু নেই মর্মে সিইসি‘র বক্তব্যেরও সমালোচনা করেন তারা। সবমিলিয়ে একটি গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করার বিষয়ে কোন পদক্ষেপ পরিলক্ষিত হয়নি রোডম্যাপে। তাই একতরফা নির্বাচনের দিকেই ইসি এগুচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। আর তা দেশের জন্য কখনো মঙ্গলজনক হবে না। এ জন্য নির্বাচনকালীন সরকারের বিষয়টি রাজনৈতিকভাবে সমাধান করার জন্য তারা আহবান জানান। নির্বাচন কমিশনের ঘোষিত রোডম্যাপ সম্পর্কে প্রতিক্রিয়ায় তারা এসব কথা বলেন।
গত রোববার প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কেএম নুরুল হুদা রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে নির্বাচন কমিশন ভবনে এ রোডম্যাপ ঘোষণা করেন। এর মধ্য দিয়েই শুরু হলো আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম। এতে সাতটি করণীয় বিষয় নির্ধারণ করা হয়েছে। সেগুলো হলো- আইনি কাঠামো পর্যালোচনা ও সংস্কার, নির্বাচন প্রক্রিয়া সহজীকরণ ও যুগোপযোগী করতে সংশ্লিষ্ট সবার পরামর্শ গ্রহণ, সংসদীয় এলাকা পুননির্ধারণ, নির্ভুল ভোটার তালিকা প্রণয়ন এবং সরবরাহ, বিধিবিধান অনুসরণপূর্বক ভোট কেন্দ্র স্থাপন, নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন ও নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের নিরীক্ষা এবং সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে সংশ্লিষ্ট সবার সক্ষমতা বৃদ্ধির কার্যক্রম গ্রহণ। নির্বাচন প্রস্তুতির অংশ হিসেবে রাজনৈতিক দলসহ অংশীজনের সঙ্গে সংলাপে বসার কথাও বলা হয়েছে রোডম্যাপে। তবে এতে সব দলের জন্য মাঠ সমান করাসহ অন্যান্য বিষয়ে নেই সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা।
নির্বাচন কমিশন ঘোষিত রোডম্যাপ সম্পর্কে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ইসি একাদশ জাতীয় নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করেছেন। খুব ভাল কথা। কিন্তু নির্বাচন করতে হলে সকল রাজনৈতিক দলগুলোকে একই রাস্তায় নিয়ে আসতে হবে, সেই রাস্তা কোথায়? রোডই যখন নেই তখন ম্যাপে কী হবে?
ইসির উদ্দেশ্য মির্জা ফখরুল বলেন, নির্বাচনী পরিবেশ তৈরি করুন। রাস্তা তৈরি করুন। অন্যথায় নির্বাচনী রোডম্যাপ স্বার্থক হবে না। আপনাদেরকেও ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির মত কুকুর বিড়াল নিয়ে নির্বাচন করতে হবে, মানুষ তো ভোট কেন্দ্রে যাবে না। এসব ব্যর্থতার দায় আপনাদের নিতে হবে।
একাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে নির্বাচন কমিশন ঘোষিত রোডম্যাপকে বাস্তবসম্মত উল্লেখ করে সব দলকে নির্বাচনের প্রস্তুতি নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য ও বাণিজ্যন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ।
তোফায়েল আহমেদ বলেন, নির্বাচন কমিশন যে রোডম্যাপ জাতির সামনে পেশ করেছে তা খুবই সুন্দর হয়েছে এবং বাস্তবসম্মত হয়েছে। আমরা মনে করি নির্বাচনকালীন যে সরকার নিয়ে বিএনপি প্রশ্ন তুলেছে- সহায়ক সরকার নিয়ে, পৃথিবীর কোনো দেশে সহায়ক সরকার বলে কোনো শব্দ নেই। সংবিধানে আছে ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নিরপক্ষেভাবে দায়িত্ব পালন করে নির্বাচন কমিশন।
আগামী নির্বাচন ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, যেদিন শিডিউল ঘোষণা করবে তারপর থেকে এই ক্ষমতাসীন সরকার অন্তবর্তীকালীন সরকার হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে, তাদের কাজ হবে ডে টু ডে কার্যকলাপ করা, নির্বাচন কমিশন যা চাইবে সরকার তাই করবে। এখন সব দলেরই আগামী নির্বচানের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা উচিত বলে মনে করেন তোফায়েল আহমেদ।
নির্বাচনী রোডম্যাপ সম্পর্কে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারী জেনারেল ডাঃ শফিকুর রহমান বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আদৌ সম্ভব নয়। তার সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হলে তাতে ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারীর নির্বাচনেরই পুনরাবৃত্তি ঘটবে। এ ধরনের প্রহসনের নির্বাচন অনুষ্ঠানের যে কোন উদ্যোগ জাতি ঘৃণার সাথে প্রত্যাখ্যান করবে।
তিনি বলেন, বর্তমান নির্বাচন কমিশন বিদায়ী নির্বাচন কমিশনের পথেই হাটুক তা জাতি দেখতে চায় না। আমরা বিশ্বাস করি শেখ হাসিনা সরকারের অধীনে কোনভাবেই অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে না। ইভিএম নির্বাচন ব্যবস্থা পৃথিবীর কোন দেশেই গ্রহণযোগ্য হয়নি। এ ব্যবস্থা সব দেশেই প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। জাতি আশা করেছিল নির্বাচন কমিশনের রোডম্যাপ ঘোষণায় জাতি আশান্বিত হবে। কিন্তু তাদের রোডম্যাপ ঘোষণা জাতিকে হতাশ করেছে।
সংলাপে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রস্তাব নির্বাচন কমিশন আন্তরিকভাবে গ্রহণ করে কি না? তা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে বলে মনে করেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ ছহুল হোসাইন। রোডম্যাপ সম্পর্কে প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, রোডম্যাপে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এখন অপেক্ষা করতে হবে, ওই সংলাপে যেসব পরামর্শ বা প্রস্তাব উঠে আসে, সেগুলোর মধ্যে গ্রহণযোগ্য প্রস্তাবগুলো কমিশন আন্তরিকভাবে গ্রহণ করে কিনা? এছাড়া রোডম্যাপে অন্যান্য যেসব বিষয় রয়েছে, সেগুলোর বাস্তবায়নে কমিশন কতটুকু আন্তরিক তা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
তিনি বলেন, কোন সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে তা রাজনৈতিক বিষয়। এটি রাজনৈতিকভাবে সমাধান করতে হবে। এতে ইসি কিছু বললে, তা সরকার না রাখলে ইসির কিছুই করণীয় নেই। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার পরিবর্তন হলেও আমাদের দেশে এ কালচার গড়ে উঠেনি। এ জন্যই নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি ছিল। কিন্তু এখন তো আইন করে তা বাতিল করা হয়েছে। এক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের সময় শক্তভাবে আইন প্রয়োগ করে সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।
তিনি আরো বলেন, রোডম্যাপ দেয়ার ফলে মানুষ জানতে পারবে নির্বাচন কমিশন কখন কি কাজ করছে। মানুষকে সচেতন থাকতে হবে। নির্বাচন কমিশন তফসিলের আগে নির্ভুল ভোটার তালিকা প্রণয়ন ও সীমানা নির্ধারণের কাজ করতে হবে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমান মনে করেন নির্বাচন কমিশন ঘোষিত এই রোডম্যাপ জাতিকে হতাশ করেছে। ইসির রোডম্যাপ নিয়ে গণমাধ্যমে প্রদত্ত প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, দেশবাসীর দাবি সব দলের অংশগ্রহণে একটি অংশগ্রহণমূলক জাতীয় সংসদ নির্বাচন। তারা আরেকটি ৫ জানুয়ারি মার্কা নির্বাচন দেখতে চায় না। এ অবস্থায় নির্বাচন কমিশন সব দলকে নিয়ে কিভাবে নির্বাচনের আয়োজন করবে কিংবা সব দলের নির্বাচনে আসার বিষয়টি কিভাবে নিশ্চিত করবে- সে বিষয়ে রোডম্যাপে স্পষ্টভাবে কিছুই উল্লেখ করা হয়নি। কিভাবে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করা হবে- সে বিষয়েও খোলাসা করেনি নির্বাচন কমিশন। এছাড়া ইসি কিভাবে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করবে সে বিষয়েও কিছু বলেনি। নির্বাচনী বিধিবিধানের সংস্কার নিয়ে কথা বললেও এটি কিভাবে করা হবে সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো দিকনির্দেশনা নেই।
ইভিএম ব্যবহার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ইভিএম ব্যবহার নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। পৃথিবীর কোথাও এটি ব্যবহৃত হয় না। বেশির ভাগ রাজনৈতিক দলও ইভিএম ব্যবহারের বিপক্ষে। এরপরও প্রচ্ছন্নভাবে ইসি ইভিএম ব্যবহারের পক্ষে। তাহলে কার স্বার্থে নির্বাচন কমিশন এটি ব্যবহার করতে চাইছে? এ বিষয়টিও সবার কাছে একটি বড় প্রশ্ন।
সংবিধান বিশেষজ্ঞরা বলেন, সংবিধানের ১২৬ অনুচ্ছেদে স্পষ্ট করে বলা আছে, নির্বাহী বিভাগ নির্বাচন কমিশনকে সহায়তা করবে। এই সহায়তা কেবল তফসিল ঘোষণার পরপরই করতে হবে- তা বলা নেই। তফসিল ঘোষণার আগেই নির্বাচন কমিশন অবাধ, নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের বাধাগুলো সরকারের কাছে তুলে ধরতে পারে। এসব বাধা-বিপত্তি দূর করতে নির্বাচন কমিশন সরকারের সহায়তা চাইতে পারে বলে অভিমত সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিকের। সব দলের অংশগ্রহণভিত্তিক নির্বাচন, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি, রাজনৈতিক দলগুলোর সভা-সমাবেশ করার অধিকার, প্রভাবমুক্ত নির্বাচন প্রভৃতি ইস্যুতে ইসির রোডম্যাপে কোনো কথা নেই বলে তিনি উল্লেখ করেন।

 

http://www.dailysangram.com/post/292147-