১৮ জুলাই ২০১৭, মঙ্গলবার, ১১:২৫

‘তুঘলকি’ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আন্দোলনে শিক্ষকরা

এমপিওভুক্ত পাঁচ লাখ শিক্ষকের নানা প্রশ্ন কিন্তু জবাব মেলে না

অবসর ও কল্যাণ সুবিধা দিতে এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের মাসিক বেতন থেকে অতিরিক্ত অর্থ কাটার সিদ্ধান্ত নিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এত দিন শিক্ষকরা এই দুই ফান্ডে ৬ শতাংশ চাঁদা দিলেও এখন দিতে হবে মূল বেতনের ১০ শতাংশ করে। কিন্তু এর জন্য বাড়তি কোনো সুবিধা দেওয়া হবে না শিক্ষকদের। আগে একজন শিক্ষক মাসিক এক হাজার ৩২০ টাকা চাঁদা দিয়ে চাকরি শেষে যে সুবিধা পেতেন এখন দুই হাজার ২০০ টাকা জমা দিয়েও ওই একই সুবিধা পাবেন। ফলে ক্ষোভে ফুঁসছেন বেসরকারি পাঁচ লাখ শিক্ষক-কর্মচারী। এরই মধ্যে কর্মসূচিও পালন করেছেন তাঁরা। অচিরেই কঠোর আন্দোলনে নামার হুমকি দিয়েছেন শিক্ষক নেতারা।
অভিযোগ রয়েছে, সরকারপন্থী শিক্ষক নেতাদের প্ররোচনায় অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের এই তুঘলকি সিদ্ধান্ত নিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়; যদিও নিয়মানুযায়ী অবসর সুবিধা বোর্ড ও বেসরকারি কল্যাণ ট্রাস্টের বোর্ড সভায় মাসিক চাঁদা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু যেসব শিক্ষক নেতা ওই সভায় ছিলেন তাঁরা সরকারপন্থী, অনেকে আবার ভুঁইফোড়। ফলে মাঠপর্যায়ের শিক্ষকদের কোনো মতামত ওই সভায় মূল্যায়িত হয়নি।
জানা যায়, সামনেই যেহেতু জাতীয় সংসদ নির্বাচন, তাই এ সময় সরকার কাউকে চটাতে চায় না। আর এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা নির্বাচনে প্রিসাইডিং অফিসার ও সহকারী প্রিসাইডিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করেন। পাঁচ লাখ শিক্ষক-কর্মচারীর প্রত্যেকেই নিজ নিজ এলাকায় সম্মানীয় ব্যক্তি। তাঁদের প্রত্যেকেরই নির্বাচনে ভূমিকা রাখার সুযোগ রয়েছে। তাই চাঁদা বাড়ানোর সিদ্ধান্তে মত দিয়ে বিপাকে পড়েছেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদও। এ পরিস্থিতিতে গত ৯ জুলাই মন্ত্রীর সঙ্গে স্বাধীনতা শিক্ষক পরিষদের (স্বাশিপ) সাধারণ সম্পাদক ও কল্যাণ ট্রাস্টের সদস্যসচিব অধ্যক্ষ শাহজাহান আলম সাজু দেখা করেন।
ইতিমধ্যে অবসর সুবিধা বোর্ডের জন্য আগের ৪ শতাংশের বদলে ৬ শতাংশ এবং বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্টের জন্য আগের ২ শতাংশের বদলে চাঁদা ৪ শতাংশ ধরে গত ১৫ ও ২০ জুন পৃথক দুটি গেজেট প্রকাশ করা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, এই সিদ্ধান্ত অবিলম্বে কার্যকর হবে। আর এতে বিপাকে পড়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর। কারণ জুন মাসের বেতন থেকে তারা ৬ শতাংশ না ১০ শতাংশ টাকা কাটবে, তা ঠিক করে উঠতে পারছে না। আর অবিলম্বে কার্যকর লেখা হলে জুনের বেতন
থেকেই ১০ শতাংশ কাটার কথা। তাই মাউশি অধিদপ্তর এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত জানতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় মৌখিকভাবে জুলাইয়ের বেতন থেকে ১০ শতাংশ টাকা কাটার কথা বললেও লিখিতভাবে কিছুই জানায়নি। তাই গতকাল পর্যন্ত মাসের ১২ দিন পার হলেও এখনো জুন মাসের বেতন পাননি এমপিওভুক্ত পাঁচ লাখ শিক্ষক-কর্মচারী।
মাউশি অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. এস এম ওয়াহিদুজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মন্ত্রণালয় থেকে আমরা এখনো লিখিত জবাব পাইনি। জুলাই মাসের বেতন থেকে ১০ শতাংশ অর্থ কাটা হবে বলে আমরা জেনেছি। তবে নতুন অর্থবছরের বাজেটে ব্যয় বিভাজনের কারণে জুন মাসের বেতন দিতে দেরি হচ্ছে। ’
মাউশি অধিদপ্তর সূত্র জানায়, বর্তমানে এমপিওভুক্ত স্কুল, কলেজ ও মাদরাসার সংখ্যা প্রায় ২৮ হাজার। আর এতে অন্তর্ভুক্ত পাঁচ লাখ শিক্ষক-কর্মচারী। তাঁদের বেতন বাবদ প্রতি মাসে সরকারকে প্রায় ৯৫০ কোটি টাকা পরিশোধ করতে হয়। বছরে যার পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ১১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। এত দিন শিক্ষকদের বেতন থেকে ৬ শতাংশ হিসাবে অবসর সুবিধা বোর্ড ও কল্যাণ ট্রাস্টে প্রতিবছর জমা হয়েছে প্রায় ৬৮৪ কোটি টাকা। আর চলতি মাস থেকে ১০ শতাংশ হিসাবে জমা হবে এক হাজার ১৪০ কোটি টাকা। ফলে বছরে অতিরিক্ত আদায় করা হবে ৪৫৬ কোটি। কিন্তু অতিরিক্ত এই টাকার বিপরীতে বাড়তি কোনো সুবিধা দেওয়া হবে না।
শিক্ষকরা জানান, একজন সিনিয়র শিক্ষকের বর্তমান বেতন স্কেল ২২ হাজার টাকা। এ অবস্থায় যদি একজন শিক্ষক ২৫ বছর চাকরি করে অবসরে যান তাহলে তিনি মূল বেতনের ১০০ গুণ হিসাবে দুই প্রতিষ্ঠান থেকে পাবেন প্রায় ২২ লাখ টাকা। কিন্তু একজন শিক্ষক যদি ২৫ বছর বেতনের ১০ শতাংশ হিসাবে দুই হাজার ২০০ টাকা করে ডিপিএস, এফডিআরসহ বিভিন্ন স্কিমে খাটান তাহলে তিনি পাবেন ৩০ লাখ টাকারও বেশি।
তবে কল্যাণ ট্রাস্টের সদস্যসচিব অধ্যক্ষ শাহজাহান আলম সাজু কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘১৯৯৭ সালে যখন কল্যাণ ট্রাস্টের যাত্রা শুরু হয় তখন একজন শিক্ষকের মূল বেতন ছিল চার হাজার ৩০০ টাকা। কিন্তু এখন যখন ওই শিক্ষক অবসরে যাবেন তখন তাঁর মূল বেতন ২২ হাজার টাকা। ফলে তাঁকে সর্বশেষ মূল বেতন হিসেবেই সুবিধা দিতে হবে। সে ক্ষেত্রে এই বাড়তি টাকা আমরা কোথায় পাব? বর্তমানে আমরা চাঁদা পাই ১৭ কোটি টাকার মতো। এ ছাড়া এফডিআর থেকেও কিছু টাকা আসে। কিন্তু ব্যয় হয় মাসে ৪০ থেকে ৪২ কোটি টাকা। এখন যদি চাঁদা দ্বিগুণ হয় তাহলে হয়তো সমস্যার কিছুটা সমাধান হবে। ’
অবসর সুবিধা বোর্ড সূত্র জানায়, ৪ শতাংশ হারে শিক্ষক-কর্মচারীদের কাছ থেকে বছরে আদায় হয় প্রায় ২১৬ কোটি টাকা। একই পরিমাণ টাকা বছর শেষে ঘাটতি থেকে যায়। ফলে একজন শিক্ষককে অবসর সুবিধার টাকার জন্য বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে হয়। এখন চাঁদা বাড়লে সমস্যার কিছুটা সমাধান হবে।
জাতীয় শিক্ষক-কর্মচারী ফ্রন্টের প্রধান সমন্বয়কারী বর্ষীয়ান শিক্ষক নেতা অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা চাই সরকারি শিক্ষকদের মতো পূর্ণাঙ্গ পেনশন। এ জন্য তাঁদের বেতন থেকে যে টাকা কাটা হয় এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বেতন থেকেও সেটা কাটা যেতে পারে। কিন্তু আগের চেয়ে যদি সুবিধা না বাড়িয়ে চাঁদা বাড়ানো হয়— তাহলে সেটা নীতিগতভাবে গ্রহণযোগ্য হবে না। এখন এটা যদি প্রধানমন্ত্রীর কাছে যায় তাহলে আমার বিশ্বাস তিনি কোনোভাবেই নতুন সিদ্ধান্তে মত দেবেন না। তবে আমাদের শিক্ষক নেতৃত্বের মধ্যেও ঐকমত্য থাকা দরকার। মতবিরোধের কারণে আমরা নিজেরাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। ’
জাতীয় শিক্ষক-কর্মচারী সংগ্রামী ঐক্যজোটের প্রধান সমন্বয়কারী মো. নজরুল ইসলাম রনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘একজন শিক্ষক যদি আগে কম বেতনে চাকরি করে থাকেন আর এখন বেশি বেতন পান এই গ্যাপ পূরণের দায়িত্ব তো সরকারের। এই দায়িত্ব কেন আমাদের নিতে হবে। আগে আমরা ৬ শতাংশ চাঁদা দিয়ে যা পেতাম, এখন ১০ শতাংশ দিয়েও তাই পাব। এটা কোনো যুক্তির মধ্যেই পড়ে না। একজন শিক্ষক নেতা কল্যাণ ট্রাস্টে বসে যা ইচ্ছে করছেন। মন্ত্রণালয়ও তাঁর সিদ্ধান্তে সায় দিচ্ছে। আমরা তাঁকে প্রত্যাহারের দাবি জানাচ্ছি। আমরা এই মাসটা দেখব, এর মধ্যে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন না হলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও শিক্ষা ভবন ঘেরাও করে অবস্থান কর্মসূচি ঘোষণা করব। ’
অবসর বোর্ড ও কল্যাণ ট্রাস্টের চাঁদা বাড়ানোয় পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী গত ১২ জুলাই রাজধানীর জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে বিক্ষোভ ও মানববন্ধন পালন করে বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি। একই সঙ্গে সংগঠনটির উদ্যোগে সারা দেশের জেলা-উপজেলায় বিক্ষোভ ও মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করা হয়। সংগঠনের সভাপতি মুহাম্মদ আবু বকর সিদ্দিক বলেন, ‘সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জাতীয়করণ আন্দোলনের দাবিকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য কিছুসংখ্যক সরকারি তোষামোদকারী শিক্ষক নেতার প্ররোচনায় ওই প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। এই সিদ্ধান্ত কোনোভাবেই শিক্ষকরা মেনে নিতে পারেন না। শিগগির প্রজ্ঞাপন প্রত্যাহার না হলে পাঁচ লাখ শিক্ষক-কর্মচারী মাঠে নামবে। ’
গত শুক্রবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে জাতীয় শিক্ষক-কর্মচারী ফ্রন্ট ১০ দিনব্যাপী কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। এর মধ্যে ১৮ জুলাই প্রত্যেক জেলা সদরে সংবাদ সম্মেলন, ২০ জুলাই মানববন্ধন, ২৩ জুলাই দাবির সপক্ষে মিছিল এবং ২৮ জেলা সদরে শিক্ষক-কর্মচারী সমাবেশ ও জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে শিক্ষামন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করা হবে। এর মধ্যে অবসর ও কল্যাণের বর্ধিত চাঁদা প্রত্যাহার না হলে আগমী ৭ সেপ্টেম্বর সংবাদ সম্মেলন করে পরবর্তী বৃহত্তর কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।
গত শুক্রবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে একই দাবিতে আরেক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির একাংশ ৩০ জুলাই পর্যন্ত সময় দিয়েছে। এর মধ্যে দাবি মানা না হলে মানববন্ধন, বিক্ষোভ, অনশন ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লাগাতার ধর্মঘটের হুমকি দেওয়া হয়েছে। একই দিন রাজধানীর বিসিএসআইআর উচ্চ বিদ্যালয়ে মাধ্যমিক স্কুল জাতীয়করণ লিয়াজোঁ কমিটির এক সভায় বর্ধিত চাঁদা প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয়। অন্যথায় কঠোর আন্দোলনের হুমকি দিয়েছে সংগঠনটি।
বর্ধিত চাঁদা প্রত্যাহারের দাবিতে গত বৃহস্পতিবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে দেশের অন্যতম পুরনো শিক্ষক সংগঠন বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি (কামরুজ্জামান)। তারা ২৫ জুলাই জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। এতে দাবি আদায় না হলে কঠোর আন্দোলনে যাওয়ার হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়।

 

http://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2017/07/18/520667