১৮ জুলাই ২০১৭, মঙ্গলবার, ১১:২৪

পানি উন্নয়ন প্রকল্পে দুর্নীতি

বাঙ্গাল আবদুল কুদ্দুস

সরকারের পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনস্ত বোর্ড, অধিদফতর, পরিদফতরগুলোতে একচ্ছত্র দলবাজির কারণে অনিয়ম, অব্যবস্থা, ঘুষ, দুর্নীতি বেশ কয়েক বছর ধরে অনেকটাই ওপেন-সিক্রেট। অভিযোগ রয়েছে, প্রকল্পের কাজের অগ্রগতি ও কাজ যথাসময়ে সম্পন্ন করার ব্যাপারে দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের আগ্রহ যতটা, তার চেয়ে অনেক বেশি আগ্রহ সরকারি বরাদ্দের অর্থ ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে। বলা হয়, সরকারের পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের বরাবরে বরাদ্দকৃত অর্থের বেশির ভাগই ‘পানিতে যায়’ বা লুটপাট করে খেয়ে ফেলা হয়। দলবাজ, কমিশনবাজ, অসাধু কর্মকর্তা এবং দলীয় নেতা-কর্মী, ক্যাডার নামধারী ঠিকাদাররা যোগসাজশ করে এই বিশাল অংকের সরকারি টাকা মেরে খায়। এ কারণেই প্রকল্পের কাজ যথাসময়ে হয় না, মানসম্পন্নভাবে হতে পারে না। সময় বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে বরাদ্দ বৃদ্ধি পায়, এতে করে লুটপাটের পরিমাণ বাড়ে। মানসম্পন্নভাবে কাজ না হওয়ার কারণ নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার, এর ও প্রধান কারণ কমিশন লুটপাট। দুর্নীতি ও লুটপাট ছাড়া পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের কোনো প্রকল্পের কাজ হয় বা হতে পারেÑ এ কথা এখন দেশের কোনো মানুষই আর বিশ্বাস করে না।
সম্প্রতি দেশের হাওরাঞ্চলে হঠাৎ করে পানির সয়লাব এবং উঠতি ফসলহানির ঘটনায় জনগণ একবাক্যে অভিযোগ করেছে, পানি উন্নয়ন বোর্ড ফসল রক্ষায় বেড়িবাঁধের কাজ সময়মতো ও ভালভাবে না করার কারণেই এমন ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটেছে। আগাম অবিরাম বর্ষণ এবং উজানের দেশ ভারতের মেঘালয়, আসাম, ত্রিপুরা, মণিপুরসহ বেশ কয়েকটি রাজ্য থেকে ধেয়ে আসা প্রবল পাহাড়ী ঢলের পানি বাঁধ ভেঙে বা ছাপিয়ে বিশাল হওরের ধানক্ষেতে প্রবেশ করেছে এবং খুব অল্প সময়ের মধ্যে উঠতি ধান অথৈ পানির নীচে তলিয়ে গেছে। হাওরাঞ্চলের মানুষ অভিযোগ করেছেন, বাঁধ মেরামত ও রক্ষার কাজ যথাসময়ে ও টেকসইভাবে করা হলে এমন বিপর্যয় ঘটতো না। চোখের সামনে ফসল হারিয়ে এভাবে তাদের সর্বস্বান্ত হতে হতো না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের এই চরম অবহেলা, অদক্ষতা, দায়িত্বহীনতা ও ব্যর্থতা নিয়ে ব্যাপক প্রতিবাদ উঠে হাওরাঞ্চলে। সভা-সমাবেশ ও বিক্ষোভ পর্যন্ত হয়। সঙ্গত কারণেই অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, স্বজনপ্রীতি, দলবাজি, কমিশনবাজি, ঘুষ, দুর্নীতি ও লুটপাটের বিষয়টিও সবার কাছে পরিষ্কারভাবে ধরা পড়ে। খোদ প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকল্পসমূহের দুর্নীতি-লুটপাট নিয়ে অভিযোগ ও উষ্মা প্রকাশ করেন। হাওরাঞ্চলের ফসলহানির সূত্র ধরে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাস্তবায়নাধীন ৩ হাজার ৭শ’ কোটি টাকা ব্যয় সাপেক্ষে পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকল্পসমূহের যাবতীয় অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, ঘুষ-দুর্নীতি এবং লুটপাট খতিয়ে দেখার জন্য নির্দেশনা দেয়া হয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ড. মোহাম্মদ আলীকে প্রধান করে ৬ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। ওদিকে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পক্ষ থেকেও একটি কমিটি করা হয়েছে। হাওরাঞ্চলের পাঁচ জেলার দুর্নীতি খতিয়ে দেখতে আরো একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। অন্যান্য কমিটির তদন্ত কাজ চলছে বলে জানা গেছে।
তদন্ত কমিটিগুলোর সব রিপোর্ট হাতে এসে গেলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকল্পসমূহে কোথায় ঠিক কতটা অনিয়ম, অব্যবস্থা, দুর্নীতি ও লুটপাট হয়েছে, তা হয়তো সকলের জানা সম্ভব হতে পারে। তবে আমাদের শর্ত এই যে, সরকারকে তা জনগণের অবগতির জন্য প্রকাশ করতে হবে। আমরা জানি, অনেক ক্ষেত্রেই অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, ঘুষ-দুর্নীতি ও লুটপাট নিয়ে তদন্ত অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু সব ক্ষেত্রে তদন্তের রিপোর্ট জনগণের সামনে প্রকাশ করা হয় না। সকলের মনে থাকার কথা, শেয়ারবাজারে ধস ও লুটপাট নিয়ে তদন্ত কমিটি হয়েছিল। তদন্ত কমিটি রিপোর্টও দিয়েছিল। কিন্তু সে রিপোর্ট কখনোই আলোর মুখ দেখেনি। কোনো বিচারও হয়নি। কুখ্যাত লুটেরারা ধরা-ছোঁয়ার বাইরেই থেকে গেছে। কখনো কখনো তদন্ত রিপোর্টের বিষয়বস্তু জানানো হয়। কিন্তু সুপারিশমালা আর কার্যকর করতে দেখা যায় না। উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায় যে, গত ২০০৭ সালে চট্টগ্রামে ভয়াবহ পাহাড় ধস ও ১২৭ জন মানুষের মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি ২২টি কারণ ও ৩৬টি সুপারিশ করেছিল, যার একটিও বাস্তবায়ন করা হয়নি। যদি করা হতো তাহলে এবারে পাহাড় ধসে হয়তো এতো মানুষের অকাল মৃত্যুর ঘটনা ঘটতো না। কাজেই তদন্ত কমিটি গঠন, দুর্নীতি, লুটপাটের অনুসন্ধান করা বড় কথা নয়, সবচেয়ে বড় কথা হলো তদন্ত কমিটির রিপোর্ট ও সুপারিশ যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় ও দুদকের পক্ষ থেকে যে তদন্ত ও অনুসন্ধান চালানো হচ্ছে, তা দ্রুত সম্পন্ন করে প্রকাশ ও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। পানিসম্পদ, মন্ত্রণালয়ের অধীন বোর্ড, দফতর ও পরিদফতরের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ যেহেতু নতুন নয় এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীও অভিযোগ অস্বীকার করেননি সুতরাং দুর্নীতি ও লুটপাট এবং দুর্নীতিবাজ ও লুটেরাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ কঠোর ব্যবস্থা নিতে কোনো প্রকার প্রহসনের আশ্রয় নিলে জাতির কাছে তা আদৌ গ্রহণযোগ্য হবে কী? পত্রিকায় প্রকাশিত এক খবরে জানা গেছে যে, পানি উন্নয়ন বোর্ডের ৭টি ড্রেজার কেনার সময় যে দুর্নীতি হয় তার খেসারত হিসাবে ড্রেজারগুলো অচল হয়ে পড়ে আছে এবং তাতে নিয়মিত ড্রেজিং কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। সাড়ে চারশ’ কোটি টাকার এসব ড্রেজার কেনার সময় সকল যন্ত্রাংশ সরবরাহ করা হয়। উন্নত দেশের যন্ত্রাংশ দেয়ার কথা থাকলেও দেয়া হয় বাংলাদেশেরই যশোরের ওয়ার্কশপে তৈরি করা যন্ত্রাংশ। সংশ্লিষ্ট সূত্র দাবি করেছে, ঠিকাদার ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের কয়েকজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তার যোগসাজশে এই দুর্নীতি সংঘটিত হয়েছে।
পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের কাজ দেশব্যাপী। বাঁধ ও নদী সংক্রান্ত যত কাজ রয়েছ তার প্রায় সবই এ মন্ত্রণালয়ের অধীন। সাগর ও উপকূলীয় রক্ষা বাঁধ, নদী রক্ষা বাঁধ ও শহর রক্ষা বাঁধসহ সকল রক্ষাবাঁধ, নদী নিয়ন্ত্রণ, নদী ড্রেজিং ইত্যাদি পানি উন্নয়ন বোর্ডের অধীন। বাঁধসমূহ নির্মাণই শুধু নয়, এসবের সংস্কার-মেরামত ইত্যাদিও তার দায়-দায়িত্বের মধ্যে। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, বাঁধের কাজ, পানির কাজ, নদীর কাজ সব ক্ষেত্রেই অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, দলবাজি, কমিশনবাজি, ঘুষ, দুর্নীতি ও বেপরোয়ার লুটপাটের কারণে রাষ্ট্রের হাজার হাজার কোটি টাকা গায়েব হয়ে যাচ্ছে। প্রকল্পসমূহের উপকার ও সুবিধা থেকে জনগণ বঞ্চিত হচ্ছে। সোজা কথায়Ñ পানি উন্নয়ন বোর্ডের আওতাধীন বাঁধগুলোর অবস্থা মোটেও ভালো নয়। উপকূলীয় এলাকার বাঁধগুলো খুবই দুর্বল অবস্থায় রয়েছে যে, মাঝারি ধরনের কোনো ঝড়-জলোচ্ছ্বাস হলেই সেগুলো হুড়মুড়িয়ে ভেঙে বিলীন হয়ে যাবে। শহররক্ষা বাঁধগুলোর অবস্থাও ঐ একই রকম। চাঁদপুর, সিরাজগঞ্জ, রাজশাহী, খুলনা প্রভৃতি শহররক্ষা বাঁধ বর্ষা এলেই হুমকির মুখে পড়ে। এসব বাঁধ টেকসই ও স্থায়ীভাবে নির্মাণ এবং নিয়মিত তদারকি আজো নিশ্চিত করা যায়নি কেন? দেশে পরিকল্পনার কোনো কমতি নেই। কিন্তু কাজ সেভাবে হচ্ছে কী? জনগণের কষ্টার্জিত ট্যাক্সের হাজার হাজার কোটি টাকার অপচয় ও লুটপাট কী হতেই থাকবে? যে কোনো মূল্যে এই অপচয় ও লুটপাট বন্ধ করতে হবে। অনেক দেরী করে সরকার দুর্নীতির তদন্ত ও অনুসন্ধানে উদ্যোগ নিয়েছে। এর মধ্যে দিয়ে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়, বোর্ড, দফতর, পরিদফতরের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠিত করা হবে বলে আশা করা যায়।

http://www.dailysangram.com/post/292190-