৪ আগস্ট ২০১৭, শুক্রবার, ১১:১০

ভোগান্তির একশেষ

মেয়রদের দেখা নেই : একজন বিদেশে

নিশ্চুপ দুই নগরপিতা। অন্যের কাঁধে দায় ঠেলে দিয়ে তারা অনেকটাই নিশ্চিন্ত ও নির্বিঘœ। প্রতিদিন নগরীর মানুষ ভাসছে বৃষ্টির আবদ্ধ পানিতে। আর মেয়রদের একজনের কাজ সীমাবদ্ধ অফিসে আসা-যাওয়ার মধ্যে। অপরজন গেছেন লম্বা সফরে লন্ডনে। এ সুযোগে দুই সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারাও প্রকৃতির পরিণতির হাতে এ শহরকে সঁপে দিয়ে দায় সেরেছেন। গতকালও ঢাকায় প্রবল বৃষ্টি হয়েছে। ডুবেছে বেশির ভাগ রাস্তা। প্রায় সব রাস্তায় পিচ, বিটুমিন উঠে সৃষ্টি হয়েছে গর্তের। যানজট আর জলজটে মানুষের দুর্দশা ছিল বর্ণনাতীত।
গত কয়দিনের বৃষ্টিতে নগরবাসীর নাভিশ্বাস। অব্যাহত বৃষ্টির কারণে সৃষ্ট ভয়াবহতা অতীতের সব রেকর্ড ভেঙেছে। চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে ঢাকা। বৃষ্টি হলেই রাজধানীর অলিগলি থেকে অধিকাংশ মূল সড়কে হাঁটু থেকে কোমর পানি জমে যাচ্ছে। কিন্তু কোনো সমাধানই যেন মিলছে না। সিটি করপোরেশন দোষারোপ করছে ওয়াসার ওপর। আবার ওয়াসা দায় ঠেলছে রাজউকের ওপর। দুই মেয়র প্রকাশ্যে বলে বেড়াচ্ছেন আমাদের করার তেমন কিছু নেই। মাঝে মধ্যে বৃষ্টির পানিতে রাস্তায় নেমে তারা জনভোগান্তির কিঞ্চিৎ উপলব্ধি করার চেষ্টা করছেন। চলছে মিডিয়ার মাধ্যমে পাবলিসিটি সেশন। এতেই যেন দায়িত্ব শেষ।
প্রায় ২৮ বছর আগে ঢাকা ওয়াসা ড্রেনেজ মাস্টারপ্ল্যান করলেও তা শুধু কাগজে কলমেই সীমাবদ্ধ। একটু ভারী বৃষ্টি হলেই ড্রেনেজ ব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে পড়ে। ঢাকা ওয়াসার ব্যর্থতায় দুই সিটি করপোরেশন ড্রেন নির্মাণ শুরু করেছে। কিন্তু সেগুলো এখনো চালু করতে পারেনি। এ ছাড়া খালগুলোও দখল হওয়ায় পানি অপসারণে ধীরগতি হচ্ছে। কিন্তু খাল উদ্ধারে কার্যকর কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। যার সব দায়ভার বহন করতে হচ্ছে জনমানুষকে।
গতকাল দুপুরে রাজধানীতে এক ঘণ্টার মতো ভারী বৃষ্টিপাত হয়। এতে সড়কে বিপর্যয় দেখা যায়। সড়ক থেকে ফুটপাথ এমনকি দোকান এবং কোনো কোনো এলাকার বাসাবাড়িতে পানি উঠে যায়। প্রতিটি সড়কে নদীর ঢেউ বইতে থাকে। ভাঙাচোরা, গর্ত, খানাখন্দে ভরা এসব সড়ক দিয়ে চলতে গিয়ে অনেকে ময়লা পানির মধ্যে পড়ে যান। একইভাবে পানিতে ভাঙাচোরা রাস্তায় ধীরগতিতে যানবাহন চলার কারণে প্রতিটি সড়কে সৃষ্টি হয় অসহনীয় যানজট। এ ছাড়া পানির মধ্য দিয়ে চলতে গিয়ে সিএনজি, মোটরসাইকেলসহ বিভিন্ন ধরনের যানবাহন নষ্ট হয়ে যায়। এতে চরম দুর্ভোগে পড়ে মানুষ।
সরেজমিন দেখা গেছে, গতকাল বৃষ্টিতে রাজধানীর মতিঝিল, টিকাটুলি, আর কে মিশন রোড, গোপীবাগ, নটর ডেম কলেজের সামনের সড়ক, ফকিরাপুল, দৈনিক বাংলা, নয়াপল্টন, কাকরাইল, বঙ্গভবনের দক্ষিণ গেটের সামনের সড়ক, গুলিস্তান, সচিবালয়ের সামনের সড়ক, সচিবালয়ের ভেতরের সড়ক, শান্তিনগর, রাজারবাগ, মালিবাগ, মৌচাক, মগবাজার, মধুবাগ, কাওরানবাজার, পান্থপথ, বাটা সিগন্যাল থেকে হাতিরপুল, বিজয় সরণি, সাতরাস্তা থেকে মহাখালী, আগারগাঁও, মিরপুর-১ থেকে ২ নম্বর মূল সড়ক, চিড়িয়াখানা রোড, মিরপুর-১০ থেকে কাজীপাড়া, শ্যাওড়াপাড়া, কালশী রোড, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সামনের সড়ক, উত্তরার ৪ নম্বর সেক্টর, বিমানবন্দর সড়ক, জসীমউদ্দীন রোড, খিলক্ষেত, রামপুরা, খিলগাঁও চৌধুরীপাড়া, বাসাবো, মানিকনগর, মাণ্ডা, মুগদা, পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডসহ রাজধানীর বেশির ভাগ সড়কই পানিতে তলিয়ে যায়। কোথাও হাঁটু পানি আবার কোথাও কোমর পানি জমে যায়।
দুপুরে বৃষ্টির পর মিরপুর-১ মূল সড়কে হাঁটু পানি জমে যায়। এ ছাড়া আশপাশ সব অলিগলিতে পানির স্রোত বইতে থাকে। এ কারণে সড়কটিতে ভয়াবহ যানজট সৃষ্টি হয়। পানির মধ্য দিয়ে চলতে গিয়ে অসংখ্য সিএনজি বিকল হয়ে যায়। পরে সিএনজি টেনে নিয়ে যেতে হয় চালককে। রিপন নামে এক সিএনজিচালক বলেন, ‘আজ অনেক বেশি বৃষ্টি হইছে। এ কারণে রাস্তায় পানি জমে গেছে। কিন্তু পানি চলে যাওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। ড্রেন যা আছে তাও বন্ধ। পানি বেশি হওয়ায় গাড়ির সাইলেন্সারে পানি ঢুকে নষ্ট হয়ে গেছে। কিন্তু যানজটের কারণে দ্রুত টেনে নিয়েও যাওয়া যাচ্ছে না।’
ওই সড়কে দেখা যায় শুধু সড়কই নয় ফুটপাথও তলিয়ে গেছে। অনেক দোকানেও পানি ঢুকে গেছে। অনেক দোকানদার পানি সেচ দিয়ে বাইরে ফেলছেন। আরিফ হোসেন নামে এক দোকানদার বলেন, ড্রেন শুধু নামেই। বৃষ্টি হলেই আর কাজ করে না। একটু বেশি হলেই রাস্তায় হাঁটু পানি জমে যায়। কিন্তু সিটি করপোরেশন, ঢাকা ওয়াসার কারো দেখা যায় না। এলাকার দোকানদারেরা গিয়ে ম্যানহোলের ঢাকনা খুলে দিয়েছেন। কিন্তু এগুলো দিয়েও পানি ঠিকমতো যেতে চায় না।
মতিঝিল নটর ডেম কলেজের সামনে দেখা যায় প্রায় কোমর সমান পানি। রাস্তার দুই পাশের ফুটপাথও পানিতে তলিয়ে যায়। ব্যাংক কলোনির সড়কগুলোয়ও ছিল পানি। ফুটপাথ ভাঙা থাকায় দুর্ঘটনার আশঙ্কায় পথচারীদের ধীরে ধীরে হাঁটতে দেখা যায়। নটর ডেম কলেজ ছুটির পর বিকেলে ছাত্ররা রাস্তায় বেরিয়েই বিপাকে পড়েন। পানির কারণে হাঁটার উপায় না থাকায় রিকশার খোঁজ করলে ভাড়া শুনেই আঁতকে ওঠেন। নটর ডেম কলেজ থেকে টিকাটুলি যেতে রিকশাওয়ালা ভাড়া চান ১০০ টাকা। কোনো উপায় না থাকায় বেশি ভাড়া গুনেই গন্তব্যে যেতে বাধ্য হন আরোহীরা।
জহির হোসেন নামে একজন মগবাজার থেকে মতিঝিল আসার জন্য রিকশা ভাড়া করেন ১০০ টাকা। কিন্তু আরামবাগ আসার পর আর রিকশাচালক কিছুতেই মতিঝিল আসতে রাজি হন না। মৌচাক, মালিবাগ, শান্তিনগর, কাকরাইল ও নয়াপল্টনের সাগর ঠেলে কর্মকান্ত হওয়ায় তিনি আর যেতে পারবেন না বলে জানান। ফলে বাধ্য হয়ে জহির হোসেন নেমে যেতে বাধ্য হন। বাকি পথটুকু তিনি বাসে চড়ে আসেন বলে জানান।
তবে বৃষ্টি পথশিশুদের জন্য আনন্দের উপলক্ষ হয়ে ধরা দেয়। আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিসের বিপরীত দিকের সড়কে বিকেলে দেখা যায় বেশ কিছু শিশু পানিতে সাঁতার কাটার চেষ্টা করছে। আর পানি ছিটিয়ে একে অপরকে ভিজিয়ে দিচ্ছে।
মেয়রদের দেখা নেই : বিগত বৃষ্টির দিনগুলোতে হাঁটু পানিতে নেমে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন এবং ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আনিসুল হক বিভিন্ন সড়ক পরিদর্শন ও পানি নিষ্কাশনের চেষ্টা করলেও গতকাল তেমনটি দেখা যায়নি। জানা যায়, ঢাকা দক্ষিণের মেয়র গতকাল অফিস করলেও তিনি কোনো সড়ক পরিদর্শনে যাননি। আর ঢাকা উত্তরের মেয়র বর্তমানে দেশের বাইরে রয়েছেন। গত ৩০ জুলাই তিনি লন্ডন গেছেন। ফিরবেন ১০ আগস্ট। ঢাকা ওয়াসার কর্মকর্তাদের কোনো তৎপরতাও দেখা যায়নি গতকাল।
জলাবদ্ধতার সমাধান কী : নগর বিশেষজ্ঞ স্থপতি ইকবাল হাবিব নয়া দিগন্তকে বলেন, রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিরসনে চারটি কাজ করতে হবে। ১. কঠিন বর্জ্য ড্রেন, খাল বন্ধ করে দিচ্ছে। এ জন্য কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে হবে, ২. রাজউকের ডিটেইল এরিয়া প্ল্যানে (ড্যাপে) প্লাবন ও জলাভূমি সংরক্ষণ করতে হবে, ৩. জলাধার উদ্ধার ও সংরক্ষণ করতে হবে এবং ৪. পাম্প স্টেশনগুলোর সক্ষমতা আরো বাড়াতে হবে। ইকবাল হাবিব বলেন, ঢাকা ওয়াসা দীর্ঘ দিন আগে ড্রেন মাস্টারপ্ল্যান করে বসে আছে। তাদের দিয়ে হবে না। জনসম্পৃক্ত প্রতিষ্ঠান দুই সিটি করপোরেশনকে এ দায়িত্ব দিতে হবে। তাদের দায়িত্ব দিতে হবে সমন্বিত ড্রেনেজ ব্যবস্থা গড়ে তোলার। মূলত জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছার বড় প্রয়োজন। এ জন্য মেয়ররা না পারলে প্রয়োজনে মন্ত্রীদের নামতে হবে। তিনি বলেন, রাজধানীতে একসময় বৃষ্টির পানি মাটিতেই চলে যেত ৪০ ভাগ। কিন্তু এখন অধিকাংশ বাড়ির ভেতরে পাকা করে দেয়া হয়। রাস্তা-ফুটপাথ পাকা। এতে মাটিতে পানি যাচ্ছে মাত্র ১০ ভাগ। আর বাকি ৯০ ভাগ রাস্তায় চলে যাচ্ছে। এই নগর বিশেষজ্ঞ বলেন, নিয়মানুযায়ী প্রতিটি বাড়ির ২৫ ভাগ মাটি উন্মুক্ত রাখতে হয়। কিন্তু এটি করা হচ্ছে না। রাজউককে এ বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/241298