বৃষ্টিতে গতকালও রাজধানীর বেশির ভাগ সড়ক তলিয়ে যায়। ছবিটি আরামবাগ এলাকার : শফিউদ্দিন বিটু
৪ আগস্ট ২০১৭, শুক্রবার, ১১:০৯

সড়কে যেন পদ্মার ঢেউ

রাজধানীর বুকে যেন পদ্মার ঢেউ। পিচঢালা কালো রাজপথের দুই পাশ আর ফুটপাথে আছড়ে পড়া বৃষ্টির পানি যেন সমুদ্রের সৈকত। কোথাও বাঁধভাঙা স্রোতের মতো তীব্র গতিতে বয়ে চলছে বৃষ্টির পানি। কোথাও প্রশস্ত রাজপথ যেন উত্তাল নদী। হ্যাঁ, এসবই এখন রাজধানী ঢাকার নতুন পরিচিতি। আধা ঘণ্টার টানা বৃষ্টিতেও তলিয়ে যায় এ নগরীর পথঘাট। রাজপথগুলো মুহূর্তে যেন রূপ নেয় খাল আর নদীতে। চার দিকে থৈ থৈ করে পানি আর পানি। হাঁটুসমান পানিতে ডুবন্ত রাস্তায় চলা বাসের চাকার সৃষ্ট ঢেউ ভাসিয়ে দিয়ে যায় রাস্তার দুই ধারের দোকান পাট আর পথচারীদের।
টানা ভারী বৃষ্টি এ নগরে আগেও হয়েছে অনেক। ১৯৯৮, ২০০৪ সালের রেকর্ড বৃষ্টির কথা আজো ভুলতে পারেননি এ নগরের পুরনো অনেক বাসিন্দা। কিন্তু গত কয়েক দিন ধরে বেশ কয়েকবার হয়ে যাওয়া ভারী বৃষ্টির সাথে সাথে রাজধানীর রাজপথ আর ছোটবড় সব গলিপথের এভাবে পানিতে তলিয়ে যাওয়ার ঘটনা অনেকের কাছে বিস্ময়কর। ১৯৯৮, ২০০৪ সালের স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা যারা দেখেছেন এ নগরে তারাও বিস্মিত কয়েক দিনের বৃষ্টিতে বারবার এভাবে তলিয়ে যাওয়ার ঘটনায়। সবার প্রশ্নÑ আধা ঘণ্টার বৃষ্টির পানিও নামার ব্যবস্থাও নেই একটি রাজধানী শহরের? সামান্য বৃষ্টিতেই এভাবে রাজধানীর অলিগলি পানিতে তলিয়ে যাওয়া নিয়ে অনেকে অনেক ধরনের ব্যঙ্গ-বিদ্রƒপ করছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও চলছে উন্নয়নের ধরন নিয়ে তীব্র সমালোচনা। সমুদ্রসৈকত দেখতে আর কক্সবাজার যাওয়ার দরকার নেই, ঢাকার রাজপথই এখন সমুদ্রসৈকতÑ এজাতীয় মন্তব্য করছেন অনেকে। বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ ধরে চলা রাস্তা কাটার উন্নয়ন আর লুটপাট নিয়ে তীব্র ক্ষোভ আর হতাশা বিরাজ করছে অনেকের মধ্যে। উন্নয়নের নামে রাজধানীকে যেন পরিণত করা হয়েছে এক বিধ্বস্ত নগরীতে।
শুধু রাজধানী ঢাকা নয়, দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামও এবারের পুরো বর্ষা মওসুমজুড়ে বারবার গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছে বৃষ্টির পানির কারণে। সেখানকার অবস্থা ঢাকার চেয়েও ভয়াবহ। ২৬ জুলাইয়ের আগে থেকেই সেখানে দিনরাত টানা ভারী বৃষ্টিতে বিভিন্ন রাস্তায় জমে যায় গলা সমান পানি। বারবার অচল হয়ে পড়ে দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এ বাণিজ্যিক নগরী। ২৬ জুলাই ঢাকায় টানা আট ঘণ্টার রেকর্ড বৃষ্টি হয়। আধা ঘণ্টার টানা ভারী বৃষ্টিতে যেখানে তলিয়ে যায় এ নগরীর পথঘাট সেখানে টানা সাত-আট ঘণ্টা বৃষ্টির পর অবস্থা যে কত শোচনীয় তা ফুটে উঠেছে পরের দিনের জাতীয় পত্রিকায়। ফুটে উঠেছে টিভির পর্দা আর হাজারো মানুষের মোবাইলের ছবিতে। কয়েক দিন পর্যন্ত ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অগণিত ছবি পোস্ট হতে থাকে। আলোচনা চলে পানিতে তলিয়ে যাওয়া ঢাকার এ অবর্ণনীয় অবস্থা নিয়ে। ২৬ জুলাইয়ের বৃষ্টি আর রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিয়ে আলোচনার রেশ না কাটতেই ৩১ জুলাই উত্তরা আবার তলিয়ে যায় ভারী বৃষ্টিতে। সে দিন ভারী বৃষ্টিতে উত্তরা তলিয়ে গেলেও রাজধানীর মতিঝিলসহ পুরো দণিভাগে বিরাজ করে তীব্র রোদ আর গরম। তবে ২ আগস্ট আবার রাজধানীর দণিভাগ, মতিঝিলসহ বিভিন্ন এলাকায় মাত্র আধা ঘণ্টার ভারী বৃষ্টিতে প্রচণ্ড জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়।
একই অবস্থা হয়েছে গতকাল। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় কোথাও কোথাও আধা ঘণ্টা থেকে এক ঘণ্টা পর্যন্ত টানা ভারী বৃষ্টি হয়। রাজধানীতে গতকালের বৃষ্টি, জলাবদ্ধতা এবং দুর্ভোগের বর্ণনা দিয়ে মামুন নামে এক ব্যক্তি জানান, আমি আড়াইটার দিকে সিপাহিবাগে থাকা অবস্থায় তীব্র বৃষ্টি শুরু হলো। বৃষ্টির মধ্যেই আমি গুলিস্তানগামী একটি লেগুনায় উঠলাম। কিন্তু আশ্চর্য হয়ে দেখলাম রাজারবাগ মোড়ে আসার আগেই রাস্তা তলিয়ে গেল পানিতে। খিলগাঁও ফাইওভারে রাজারবাগের প্রান্ত থেকেই দেখলাম রাস্তায় পানি। এরপর রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সের পাশের রাস্তায় দেখি প্রায় হাঁটুপানি। আমার মতো লেগুনার অন্য সব যাত্রীরও একই প্রশ্নÑ এত তাড়াতাড়ি কিভাবে তলিয়ে গেল এসব রাস্তা! একজন যাত্রী বললেন, এ দিকে মনে হয় আগেই শুরু হয়েছে বৃষ্টি। না হলে এভাবে তলিয়ে যায় কী করে। এরপর ফকিরাপুল মোড়, দৈনিক বাংলা মোড়সহ পুরো রাস্তা হাঁটুপানি পাড়ি দিয়ে আসলাম গুলিস্তান। সোয়া ৩টার দিকে যখন গুলিস্তান আসি তখনো তীব্র বৃষ্টি হচ্ছে। গুলিস্তান এসে দেখি চার দিকের সমস্ত রাস্তা পানির নিচে। রাস্তার ওপর দিয়ে তীব্র বেগে বইছে স্রোত। পানির মধ্যেই গাড়ি থেকে নেমে কোনোমতে রাস্তার মাঝে পুলিশ বক্সে আশ্রয় নিলাম।
মামুন জানান, আমার গন্তব্য ছিল টিকাটুলি। সাড়ে ৩টার সময় বৃষ্টি থামলো গুলিস্তানে। এরপর পুলিশ বক্স থেকে বের হয়ে ২০ মিনিট পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম সায়েদাবাদ যাত্রাবাড়ীগামী বাসের জন্য। কিন্তু কোনো বাস পেলাম না। ইতোমধ্যে বৃষ্টি থামার কারণে চার দিক থেকে বের হয়ে এলো মানুষের ঢল। অনেকে দাঁড়িয়ে ছিল রাস্তার আইল্যান্ডের ওপর। মতিঝিলগামী কিছু বাস এলেও তাতে উঠতে পারলেন না অনেকে। কারণ রাস্তায় এত পানি যে পানি যে, পানি ভেঙে যেতে পারছিলেন না অনেকে।
মামুন বলেন, শেষ পর্যন্ত সায়েদাবাদের কোনো গাড়ি না পেয়ে অনেক রিকশাওয়ালাকে অনুরোধ করলাম। কিন্তু সবাই বলল, বঙ্গভবনের পাশের রাস্তায় কোমর পানি। যাওয়া যাবে না। শেষে গুলিস্তান থেকে রাজউক ভবনের দিকে হাঁটা শুরু করলাম। রাজউক ভবনের সামনে এসে দেখি বাঁধভাঙা স্রোতের মতো পানি রাজউক ভবনের সামনের রাস্তায় দণি দিক থেকে উত্তর দিকে যাচ্ছে তীব্র গতিতে। এরপর বঙ্গভবনের উত্তর পাশের রাস্তা দিয়ে শাপলা চত্বরের দিকে যেতে থাকলাম। একটু সামনে এগোতেই দেখি যানজট। সায়েদাবাদগামী যেসব বাস বঙ্গভবনের দণি পাশ দিয়ে যাতায়াত করে সেসব বাস এখানে এসে আটকে আছে। পানির কারণে এসব বাস বঙ্গভবনের দণি পাশের রাস্তা বাদ দিয়ে এদিক দিয়ে এসেছে। এরপর আলিকো ভবনের পাশে এসে দেখি সেখানেও পানির তীব্র স্রোত। শাপলা চত্বর থেকে টিকাটুলি পর্যন্ত সড়ক পানির নিচে। কোথাও কোথাও আইল্যান্ডের দুই পাশ কিছুটা পানিমুক্ত।
কয়েক দিন ধরে ভারী বৃষ্টিতে এভাবে রাজধানীর অলিগলি তলিয়ে যাওয়ায় আবারো উঠে এসেছে রাজধানীর বুক চিরে বয়ে চলা একসময়ের অর্ধশতাধিক খাল দখল হয়ে যাওয়ার বিষয়টি। এ ছাড়া রাজধানীতে ছিল অনেক বড় বড় পুকুর, জলাশয়। এসবই দখল করে গড়ে উঠেছে বহুতল ভবন। রাজধানীর বুকে বয়ে চলা এসব খাল, পুকুর ও নদী ধারণ করত বৃষ্টির পানি। এ ছাড়া শহরের চারদিকে ছিল অনেক ছোট-বড় বিল, খাল। সেগুলোও দখল হয়ে গেছে। এখনো রাজধানীর পূর্ব দিকে যেটুকু জলাশয় রয়েছে তা ভরাট করে বসতি নির্মাণ আর নগরায়নের কাজ চলছে পুরোদমে। এভাবে শহরের মধ্যে এবং চারদিকের জলাশয় ভরাট করার কারণেই রাজধানীর এ জলাবদ্ধতার মূল কারণ বলে একমত সব বিশেষজ্ঞ। কিন্তু তারপরও সবার চোখের সামনে চলছে রাজধানীর পূর্ব দিকসহ আশপাশের জলাশয়ে ভরাটের কাজ। এর পরিণতি ভবিষ্যতে আরো ভয়াবহ আকারে দেখা দেবে বলেই মনে করছেন অনেকে। অনেকের আশঙ্কা এভাবে উন্নয়নের নামে আসলে ধ্বংসাত্মক পরিকল্পনার কারণে এক দিন এ রাজধানী পরিত্যক্ত হয়ে যেতে পারে।

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/241296