৪ আগস্ট ২০১৭, শুক্রবার, ১১:০৭

জাতীয় সংসদ সার্বভৌম নয়

সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে সুপ্রিমকোর্টের দেয়া পূর্ণাঙ্গ রায়ে বিচারপতিরা সংবিধানের বিভিন্ন দিক নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছেন। এতে গণতন্ত্র, রাজনীতি, নির্বাচন কমিশন, সেনাশাসন, জাতীয় সংসদের সার্বভৌমত্ব, সংসদ ও বিচার বিভাগের সম্পর্ক, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, আইনের শাসনসহ অনেক বিষয় চলে এসেছে। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ, বিচারপতিদের জবাবদিহিতা ও ৩৯ দফা আচরণবিধি,সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল, ক্ষমতার পৃথকীকরণের বিষয়ও রায়ে উঠে এসেছে। এছাড়া সমসাময়িক অনেক ইস্যুর জবাব দেয়া হয়েছে ৭৯৯ পৃষ্ঠার এ রায়ের মাধ্যমে। সেসব বিষয় নিয়েই যুগান্তরের ধারাবাহিক প্রতিবেদন। আজ ছাপা হল প্রথম কিস্তি-


বাংলাদেশে জাতীয় সংসদ ব্রিটিশ পার্লামেন্টের মতো সার্বভৌম নয়। বাংলাদেশের সংবিধানের কোথাও বলা হয়নি যে জাতীয় সংসদ সার্বভৌম। সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পূর্ণাঙ্গ রায়ে সুপ্রিমকোর্টের কয়েকজন বিচারপতি এ নিয়ে দীর্ঘ পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন। তারা বলেছেন, বাংলাদেশে সংসদ নয়, সার্বভৌম হচ্ছে জনগণ আর সংবিধান। রায়ে বলা হয়েছে, জাতীয় সংসদে কোনো আইন প্রণয়ন করলে তা পর্যালোচনা করে বাতিল করার ক্ষমতা সুপ্রিমকোর্টের রয়েছে। সংসদীয় গণতন্ত্রে মন্ত্রিসভার আধিপত্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। সংসদের পুরো নিয়ন্ত্রণ মন্ত্রিসভার হাতে। সংসদের কার্যপ্রণালিতে কার্যত একক আধিপত্য থাকে মন্ত্রিসভার। মঙ্গলবার ৭৯৯ পৃষ্ঠার রায়টি প্রকাশিত হয়। এ রায় নিয়ে দেশে ব্যাপক আলোচনা চলছে।

রায়ে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা লিখেছেন, সংসদের সার্বভৌম ক্ষমতা নিয়ে ভুল ধারণা রয়েছে সংবিধানে। সার্বভৌম হচ্ছেন শুধু জনগণ এবং সর্বময় হচ্ছে সংবিধান। বাকি সব প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা নেহাতই সংবিধানের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের হাতিয়ার মাত্র। আমাদের সংবিধানে সার্বভৌম ক্ষমতা কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে দেয়া হয়নি।

রায়ে তিনি লিখেছেন, সংসদীয় গণতন্ত্রে মন্ত্রিসভার আধিপত্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। সংসদের কার্যপ্রণালিতে কার্যত একক আধিপত্য থাকে মন্ত্রিসভার। ক্ষমতাসীন দল যা চায় সংসদে বেশিরভাগ সদস্য তাকেই সমর্থন করেন। সংসদের পুরো নিয়ন্ত্রণ মন্ত্রিসভার হাতে। সংসদে কী আলোচনা হবে সেই সিদ্ধান্ত নেয় মন্ত্রিসভাই। যখন এটা নিয়ে আলোচনা হয় তখনও কত সময় নিয়ে আলোচনা হবে এবং কী নিয়ে আলোচনা হবে তাও নির্ধারণ করে মন্ত্রিসভা। শেষ পর্যন্ত যেসব বিল সংসদের মাধ্যমে পাস হয় তা মন্ত্রিসভা হয়েই সংসদে আসে। স্বার্থান্বেষী ও সংগঠিত গোষ্ঠীগুলো তাদের স্বার্থ আদায়ে মন্ত্রীদের অব্যাহতভাবে চাপ দিতে থাকে, যাতে আইনে তাদের স্বার্থরক্ষা হয়।

বিচারপতি সিনহা লিখেছেন, কোনো সংসদ সদস্য মন্ত্রী না হলেও সংসদে বিল উত্থাপন করতে পারেন (কার্যপ্রণালি বিধির ৭২ ধারা অনুসারে)। তবে সরকারের সমর্থন ছাড়া বেসরকারি ওই বিল পাসের সম্ভাবনা ক্ষীণ। ব্যক্তি সংসদ সদস্যের ক্ষমতা ভীষণভাবে সীমিত। তাদের ব্যক্তিগত উদ্যোগ বাস্তবায়নের সুযোগও সীমিত। সংসদের বেশিরভাগ দিনই যায় সরকারের কার্যক্রম সম্পাদনে। ব্যক্তিগত উদ্যোগ নিয়ে আলোচনার জন্য সপ্তাহে শুধু একদিন বরাদ্দ রয়েছে। সরকারের এত বিল অপেক্ষমাণ থাকে যে, তার ফলে

বেসরকারি বিল চাপা পড়ে যায়।

বিচারপতি আবদুল ওয়াহহাব মিঞা রায়ে প্রশ্ন তুলেছেন, সংসদ কি সার্বভৌম। তিনি নিজেই এর জবাব দিয়েছেন। রায়ে তিনি লিখেছেন, একদল লোক এ দাবি করছেন। বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেলও একই কথা বলেছেন। এটা সত্য যে, ব্রিটিশ পার্লামেন্ট কিছু ক্ষেত্রে সার্বভৌম। সেখানে কোনো লিখিত সংবিধান নেই। সুইস তাত্ত্বিক জঁ লুইন ডি লোম ১৭৭১ সালে ইংলিশ কন্সটিটিউশন গ্রন্থে লিখেছেন, ‘(এই) সংসদ নারীকে পুরুষ আর পুরুষকে নারী বানানো ছাড়া সবই করতে পারে।’

বাংলাদেশ ১৯৭২ সালেই লিখিত সংবিধান পায়। এতে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রের তিনটি বিভাগ- নির্বাহী, আইন ও বিচার বিভাগ। এতে কারও ওপর কাউকে শ্রেষ্ঠত্ব বা আধিপত্য দেয়া হয়নি। এর অর্থ হল, সংবিধান একটি ইঞ্জিন এবং এর পৃথক তিনটি কম্পার্টমেন্ট আছে, যেখানে সেগুলো আরোহণ করে।

তিনি লিখেছেন, বাংলাদেশের সংবিধান ও দেশের জনগণই শুধু সার্বভৌম। তবে সংবিধানে বিচার বিভাগের মর্যাদা অনন্য। কারণ ১০২ অনুচ্ছেদ অনুসারে সংবিধানের অভিভাবকত্ব বা বিচারিক পর্যালোচনার অধিকার শুধু বিচার বিভাগকেই দেয়া হয়েছে, আর কাউকে নয়। এর মানে এই নয় যে, বিচার বিভাগ নির্বাহী কিংবা আইন বিভাগের এলাকায় অনধিকার প্রবেশ করবে। সংবিধানে এর সীমানা চিহ্নিত করে দেয়া হয়েছে। কোনো আইনে সংবিধানের মৌলিক কাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত না হলে সেই আইনকে অবৈধ বা এখতিয়ারবহির্ভূত বলে ঘোষণা দেয়া যাবে না।

তিনি লিখেছেন, সংবিধানের যে কোনো সংশোধনী সংসদের আইন প্রণয়নের ক্ষমতার আওতার মধ্যে ছিল কিনা, সুপ্রিমকোর্ট তা পর্যালোচনা করে দেখতে পারেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে প্রণীত সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদেই এ ক্ষমতা সুপ্রিমকোর্টকে দেয়া হয়েছিল। কোনো সংশোধনীতেই এ ক্ষমতা রহিত করা হয়নি। বিচারপতি ওয়াহহাব মিয়া লিখেছেন, সংবিধানের কোথাও বলা নেই যে, সংসদ হবে সুপ্রিম বা সার্বভৌম। কিছু লোক কীভাবে বলে যে, সংসদ সার্বভৌম তা আমার বুঝে আসে না।

বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন তার রায়ে লিখেছেন, সংসদীয় গণতন্ত্র আছে- এমন কয়েকটি দেশে সাংবিধানিক আইনে সংসদের সার্বভৌমত্বের ধারণা রয়েছে। এতে বলা হয়, আইন বিভাগের চূড়ান্ত সার্বভৌম ক্ষমতা রয়েছে। নির্বাহী ও বিচার বিভাগসহ সরকারের অন্যান্য বিভাগের চেয়ে এটি সুপ্রিম। এতে আরও বলা হয়, আইন বিভাগ আইনের যে কোনো পরিবর্তন ও বিধান বাতিল করতে পারে। তবে সংসদের সার্বভৌমত্ব ক্ষমতার পৃথকীকরণের বিপরীত। কারণ এটা আইন বিভাগের আইন প্রণয়নের এবং বিচার বিভাগের তা পর্যালোচনা করার ক্ষমতা সীমিত করে দেয়। এক্ষেত্রে সংসদে পাস হওয়া আইনও কিছু ক্ষেত্রে বাতিল করা যায়।

তিনি লিখেছেন, আমাদের দেশে সংবিধানের ৬৫ অনুচ্ছেদে এককক্ষবিশিষ্ট সংসদের কথা বলা হয়েছে, যা জাতীয় সংসদ নামে পরিচিত। এখানে প্রজাতন্ত্রের আইন প্রণয়নের ক্ষমতা ন্যস্ত করা হয়েছে। ব্রিটিশ সংসদ সার্বভৌম। কারণ তারা কোনো বাধা ছাড়াই আইন প্রণয়ন করতে পারে- হোক তা অযৌক্তিক কিংবা মর্জিমাফিক। ব্রিটিশ সংসদে পাস হওয়া কোনো আইনকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করা যায় না। তবে সেদেশে আইনের ব্যাখ্যার অধিকার বিচার বিভাগের। এই অধিকারবলে তারা অন্যায় ও অযৌক্তিক কোনো আইন সরিয়ে দিতে পারে। কিন্তু আমাদের দেশের সংবিধান অনুসারে সংসদ নয়, সার্বভৌম হচ্ছে সংবিধান। সংবিধানের আলোকে আইন প্রণয়ন করতে হবে। সংবিধানের সঙ্গে কোথাও অসঙ্গতি থাকলে সেটি বাতিল হয়ে যাবে। সংবিধান সংসদকে যে ক্ষমতা দিয়েছে তারা সেই সীমা লঙ্ঘন করল কিনা, তা পর্যালোচনা করার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে সুপ্রিমকোর্টকে।

বিচারপতি মোহাম্মদ ইমান আলী লিখেছেন, সার্বভৌম মানে সর্বময় ক্ষমতা। সংসদ সার্বভৌম মানে হচ্ছে, সংসদ যে কোনো বিষয়ে আইন প্রণয়ন করতে পারে। এর মর্মার্থ হচ্ছে, আইন প্রণয়নে সংসদে অসীম ক্ষমতা। তিনিও এক্ষেত্রে ব্রিটিশ সংসদের ক্ষমতা নিয়ে লোমের উদ্ধৃতি দেন এবং লেখেন, আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের অগ্রগতির কারণে এ য–গে আদালত অবশ্যই কোনো ব্যক্তির লিঙ্গ নির্ধারণ করতে পারে এবং ঘোষণা করতে পারে তিনি নারী নাকি পুরুষ।

ব্রিটিশ সংসদের আইন প্রণয়নের ক্ষমতা সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, যে কোনো আইন প্রণয়নের ক্ষমতা তার রয়েছে। তবে কোনো সংসদ এমন আইন প্রণয়ন করতে পারে না যা ভবিষ্যতে কোনো সংসদ পরির্বতন করতে পারে না। সংসদে পাস হওয়া কোনো আইন সংসদই পরিবর্তন করতে পারে। এ কারণে ওয়েস্টমিনিস্টার সংসদের ক্ষমতা শর্তহীন।

তিনি রায়ে লিখেছেন, বাংলাদেশের সংসদ ও সংবিধানের ব্যাপারে আমাদের সুপ্রিমকোর্টের যথেষ্ট কর্তৃত্ব রয়েছে। বিচারপতি ইমান আলী লিখেছেন, রাষ্ট্রের ক্ষমতা তিনটি বিভাগের মধ্যে ভাগ করা। তিন বিভাগের ক্ষমতার পৃথকীকরণ মানে হচ্ছে নির্বাহী, আইন ও বিচার বিভাগ সংবিধান বর্ণিত সীমা অতিক্রম করতে পারে না। সংবিধান তাদের যে ক্ষমতা দিয়েছে তার মধ্যে কাজ করতে তিনটি বিভাগই বাধ্য। বলা যায়, কোনো বিভাগই অন্য একটি বিভাগের ওপর আধিপত্য বা অভিভাবকত্ব দাবি করতে পারে না এবং প্রত্যেককেই সংবিধানের বিধান তথা জনগণের ইচ্ছা অনুসারে কাজ করতে হয়। কাজেই সংসদে পাস হওয়া কোনো আইন যখন বিচার বিভাগ অবৈধ ঘোষণা করে তখনও সে সুপিরিয়র পাওয়ার চর্চা করে না, বরং সে সাংবিধানিক দায়িত্বই পালন করে থাকে। বিচার বিভাগ যদি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখতে পায় যে, সংবিধান সংসদকে যে ক্ষমতা দিয়েছে কোনো আইন প্রণয়নে সেই সীমা অতিক্রম করা হয়েছে তবে তাকে অবৈধ বা এখতিয়ারবহির্ভূত ঘোষণা করতে পারে।

http://www.jugantor.com/first-page/2017/08/04/145163/