বগুড়ার অত্যাধুনিক ময়না হোটেলের মালিক যুবলীগ নেতা মতিন : নয়া দিগন্ত
৪ আগস্ট ২০১৭, শুক্রবার, ১১:০৭

তুফানের অবাধ্য হলেই টর্চার সেলে নির্যাতন : সীমান্তে পাড়ি জমানোর চেষ্টায় মতিন সরকার

বগুড়ায় কিশোরী ধর্ষণ ও মা-মেয়ে নির্যাতন মামলার প্রধান আসামি তুফান সরকারের ক্ষমতার দাপট এতটাই ছিল যে, বগুড়ায় সরকারের মধ্যে যেন আরেক সরকার কায়েম করেছিল সে। আর এসবই সম্ভব হয়েছিল আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, শ্রমিকলীগের স্থানীয় ও শীর্ষ নেতৃবৃন্দের আশীর্বাদের বদৌলতে। সেই সাথে যারা তার কথামতো চলত না তাদেরকে নিজের টর্চার সেলে নিয়ে নির্যাতন করত। কিন্তু কেউ ভয়ে এসব অভিযোগ স্থানীয় প্রশাসনে দিত না। তবে স্থানীয় প্রশাসনের সব কিছুই জানা ছিল।
তুফানের টর্চার সেল : শ্রমিকলীগ নেতা তুফানের টর্চার সেল থেকে কেউ রক্ষা পেত না। সেখানে সব শ্রেণী-পেশার মানুষই নির্যাতনের শিকার হতো। বিশেষ করে ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকেরা যারা নতুন লাইসেন্স, নবায়ন ও দৈনিক চাঁদা দিতে চাইতেন না, তাদেরকে নিজের অফিসে তুফানের ক্যাডার বাহিনী নিয়ে বেধড়ক নির্যাতন করত। এরপর তার টাকা দিয়ে ছাড়া পেতে হতো অথবা রিকশা রেখে বাড়ি যেতে হতো। কিন্তু তুফান গ্রেফতারের খবরে রিকশাচালকসহ তার নির্যাতনের শিকার মানুষ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন। তারা গ্রেফতারে খুশি হয়ে বলছেন, আল্লাহর বিচার হয়েছে। সে যেন আর ফিরে না আসে সেই দোয়া করি। তবে তারা তুফানের শাস্তি নিয়ে সংশয়ে রয়েছেন। তাদের আশঙ্কা, সে যদি আবার জেল থেকে ছাড়া পায় তাহলে আবারো একই অবস্থা সৃষ্টি হবে। তাই তারা তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চেয়েছেন।
মতিন সরকার গ্রেফতার হয়নি : হত্যা মামলার আসামি হলেও পুলিশ তাকে ধরেনি। তার বিরুদ্ধে আদালত দেড় মাস আগে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করলেও তা গায়েব হয়েছে বলে জানা গেছে। সে এখন সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ওপারে পাড়ি জমানোর চেষ্টা করছে বলে জানা গেছে। সূত্র জানায়, ২০০১ সালের ২৮ অক্টোবর শহরের চকসূত্রাপুরের কসাই পট্টিতে শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল হত্যার প্রধান আসামি তুফানের মেঝো ভাই যুবলীগ নেতা আবদুল মতিন। সেই মামলার ওয়ারেন্টের আসামি সে। হত্যা, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজির ঘটনায় মতিন সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কেউ মুখ খোলেন না। তাদের বিশ্বাস এদের বিরুদ্ধে পুলিশ কিংবা অন্য কোনো সংস্থা কিছুই করবে না। মুখ খুললেই নেমে আসবে নির্যাতন। উজ্জ্বল হত্যার আসামি হিসেবে মতিন সরকারের বিরুদ্ধে মামলা হয় তখন। সেই মামলায় তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা হলে সে জামিন নেয়। জামিন নেয়ার পর আদালতে হাজির না হওয়ায় আবারো গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়। গত ২০ জুন পরোয়ানা জারি হলেও তা পুলিশের কাছে পৌঁছেনি। বগুড়া কোর্ট ভবন থেকে সদর থানার দূরত্ব ৫০০ গজ হলেও তা দেড় মাসেও পৌঁছেনি। কে বা কারা ওই কাগজ গায়েব করেছে।
চকসূত্রাপুরের বাসিন্দা হোসনে আরা স্বপ্না জানান, আমার ভাই আবু তালহা ঠাণ্ডুকে মতিনের ক্যাডার বাহিনী প্রকাশ্যে খুন করেছিল। মতিনের সাথে চলার কারণে অনেকেই তাকে ঘৃণা করত। তাই মতিনের পক্ষ ছাড়ায় প্রকাশ্যে ছোট ভাই ঠাণ্ডুকে খুন করা হয়েছে। কষ্ট একটাইÑ ঠাণ্ডু ছাড়া মেয়েকে বিয়ে দিলাম। কিন্তু ওই সব ঘাতককে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। এতেই খুশি। স্বপ্না আরো বলেন, উজ্জ্বল ও এমরান হত্যাসহ বগুড়ায় এখন চাঁদাবাজি, দখল, মাদকের সাথে যুক্ত মতিন বাহিনী।
রুমকির ফোনে নির্যাতনের ভিডিও ধারণ : মামলার আসামি নাপিত জীবন রবিদাস আদালতে দেয়া স্বীকারোক্তিতে উল্লেখ করেছে, কাউন্সিলর মার্জিয়া হাসান রুমকি ও তুফানের স্ত্রীর নির্দেশে সে তাদের ন্যাড়া করে দেয়। কাউন্সিলর রুমকির বাসায়ই ন্যাড়া করে দেয়ার ঘটনাটি ঘটে। শহরের চকসূত্রাপুরে রুমকির বাড়িতে এ ঘটনা ঘটে। অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট তার দেয়া জবানবন্দী ১৬ ধারায় রেকর্ড করেন। এ তথ্য মামলার নথি থেকে পাওয়া গেছে। এ ছাড়া জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তুফানের বাড়ির কাজের মেয়ে শারমিন (১৫) ও মালাকেও (১০) থানায় আনা হয়েছিল। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তাদেরকে নিজ অভিভাবকদের জিম্মায় দেয়া হয়েছে।
চুলকাটা ও নির্যাতনের ঘটনার চিত্রটি ধারণ করা হয়েছিল ওয়ার্ড কাউন্সিলর রুমকির মোবাইল ফোন থেকে। আলামত হিসেবে সেগুলো আদালতে দেয়া হয়েছে।
তুফানের আরো ৫ ভাই আত্মগোপনে : বগুড়ায় কিশোরীকে ধর্ষণের পর মা-মেয়ের মাথা ন্যাড়া করে দেয়ার ঘটনার প্রধান আসামি তুফানকে গ্রেফতারের পর অপর পাঁচ ভাইও আত্মগোপন করেছে। শহরের চকসূত্রাপুর চামড়া গুদাম লেন এলাকায় মতিন সরকারের বাড়িতে এখন সুমসাম নীরবতা। গত ২৮ জুলাই শুক্রবার রাতে তুফান সরকার গ্রেফতার হওয়ার পর ৩০ জুলাই পর্যন্ত মতিন সরকারের সাথে পুলিশের যোগাযোগ ছিল। ৩১ জুলাই বিভিন্ন পত্রিকায় হত্যা মামলার আসামি মতিন সরকারের সাথে পুলিশের সখ্যতা নিয়ে সংবাদ প্রকাশের পর সে আত্মগোপন করে। এর আগে পুলিশ তাকে গ্রেফতারের উদ্যোগ নেয়নি।
দুই ভাইয়ের ত্রাসের রাজস্ব : শহরের মাদক সম্রাট ও ত্রাস খ্যাত তুফান সরকার ও মতিন সরকারের রাজত্ব চলত এই শহরে। আলোচিত দুই নাম তুফান সরকার ও মতিন সরকার। এই দুই সহোদর বগুড়ায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলন সম্প্রতি ধর্ষণের পর এক কিশোরীকে তার মা-সহ মাথা ন্যাড়া করে নির্যাতনের ঘটনার পর তাদের অপকর্ম আর কুকীর্তি একে একে বেরিয়ে আসছে। তবে বগুড়া শহরের এ ত্রাসরা নিজেদের মতাসীন দলের নাম ভাঙিয়ে ও বিভিন্ন নেতার ছত্রছায়ায় শত কোটি টাকার মালিক বনে গেছে। পরিবহন খাতে ব্যাপক চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, জমি দখল, সেটেলমেন্টসহ এমন কোনো অপকর্ম নেই যেখান থেকে তারা আয় করেনি। প্রশাসনের লোকদের ম্যানেজ করেই তুফান-মতিনরা তাদের অপকর্মগুলো চালিয়ে যেত। তাদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে পুলিশ, প্রশাসন, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, রাজনৈতিক নেতারাও হয়েছে অগাধ সম্পদের মালিক।
তুফানের স্ত্রী ও শাশুড়ি কারাগারে : প্রধান আসামি তুফানের স্ত্রী আশা খাতুন ও শাশুড়ি রুমী বেগমের প্রথম দফা রিমান্ড শেষে বৃহস্পতিবার মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা দ্বিতীয় দফায় ৫ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন। বগুড়ার অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক শ্যাম সুন্দর রায় শুনানি শেষে রিমান্ড নামঞ্জুর করে প্রয়োজনে ৭ দিনের মধ্যে জেল গেটে জিজ্ঞাসাবাদের আদেশ দেন।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সদর থানার পুলিশ পরিদর্শক (অপারেশন) আবুল কালাম আজাদ জানান, তুফানের স্ত্রী ও শাশুড়িকে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে।
বগুড়ার বর্বরোচিত ঘটনায় জেলা আ’লীগের প্রতিক্রিয়া
বগুড়া যুবলীগ নেতা মতিন সরকার ও শ্রমিকলীগ নেতা তুফান সরকারের অপরাধজগৎ নিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের পর টনক নড়েছে জেলা আ’লীগের। গত এক সপ্তাহ চুপচাপ থাকলেও মুখ খুলেছেন জেলা সভাপতি মমতাজ উদ্দিন। তিনি বগুড়ার সাম্প্রতিক ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও ক্ষোভ জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন। বিবৃতিতে তিনি বলেন, সংগঠন করা মানে অপরাধ করার লাইসেন্স নয়। সহযোগী সংগঠনসহ ভুঁইফোড় কিছু সংগঠনের কারণে আওয়ামী লীগের দুর্নাম হচ্ছে। সহযোগী সংগঠনগুলোর আলাদা গঠনতন্ত্র থাকায় আওয়ামী লীগ তাদের কাজে কখনই হস্তক্ষেপ করার এখতিয়ার রাখে না। তার পরও বগুড়ায় আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে বারবার সাবধান করেছি। ডেকে নিয়ে বুঝিয়েছি। অনেক সময় কড়া ভাষায় সমালোচনা এবং সঠিক পথে আসার আহ্বান জানিয়েছি। কেউ শুনেছে কেউ শোনেনি। কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ অনেক সময় আওয়ামী লীগের নেতাদের সাথে যোগাযোগ না করে সহযোগী সংগঠনের নেতাদের বাসায় দাওয়াত খান। তাদেরকে বিভিন্নভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করেন; যার ফলে আমাদেরকে অনেকে তোয়াক্কাই করে না।
তিনি বলেন, বগুড়ার ঘটনায় প্রশাসন তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করলেও বিএনপি বগুড়া শহরে সস্তা রাজনীতির অংশ হিসেবে মিছিল সমাবেশ করছে। তারা ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে চায়। আওয়ামী লীগ তা হতে দেবে না। শুধু তুফান সরকার বা মতিন সরকার নয়, যারা এদের স্রষ্টা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। কিছু গণমাধ্যম আমাকে জড়িয়ে যে খবর প্রকাশ করেছে, তাতে আমি দুঃখ পেয়েছি। সারা জীবন সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়েছি। এখনো সোচ্চার রয়েছি। বগুড়ায় আইনশৃঙ্খলা মিটিংয়ে বারবার বগুড়ার যানজট, পরিবহন খাতে চাঁদাবাজি, জুয়া ও মাদকের ব্যাপারে প্রশাসনকে ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ করেছি।
প্রশাসনের উদ্দেশে বলতে চাই এসব ব্যাপারে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। নতুবা এমন ঘটনা ঘটতেই থাকবে।

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/241313