৪ আগস্ট ২০১৭, শুক্রবার, ১১:০৫

সুনামগঞ্জে হাওরে বাঁধ নির্মাণে দুর্নীতি

১৪০ জনের বিরুদ্ধে মামলা

সুনামগঞ্জ হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে এবার আদালতে মামলা করল সুনামগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতি। এতে ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. শাহ কামালসহ ১৪০ জনকে আসামি করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার দুপুরে সুনামগঞ্জ জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ আদালতে সমিতির পক্ষে মামলাটি করেন সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আবদুল হক। বিচারক মো. মুজিবুর রহমান তা গ্রহণ করে তদন্তের জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন।


অন্য আসামিরা হলেন- পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) ১৫ কর্মকর্তা, ৪৬ ঠিকাদার এবং প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির (পিআইসি) ৭৮ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ- এদের অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে হাওরের বাঁধ নির্মাণ সম্পন্ন তো দূরের কথা, অনেক ক্ষেত্রে কাজ শুরুই হয়নি। অথচ বরাদ্দ করা টাকা ঠিকই তুলে নিয়ে আত্মসাৎ করা হয়েছে। সময়মতো ও মানসম্পন্ন কাজ না হওয়ার কারণেই বাঁধ ভেঙে বোরো ফসল ডুবে হাওর এলাকায় দুর্যোগ নেমে আসে।

অভিযোগ করা হয়, ঠিকাদাররা ৮৪টি প্যাকেজের কাজ দরপত্রের শর্ত মোতাবেক সম্পন্ন করেননি। শুধু চলতি বছর নয়, আগের বছরেও তারা একই কাজ করেছেন। পাউবো কর্মকর্তারা এ কাজে সহযোগিতা করেছেন। এর মাধ্যমে তারা অবৈধ সম্পদের মালিক হয়েছেন। তদন্তকালে এদের অবৈধ সম্পদ জব্দ করার আবেদনও জানানো হয়েছে এজাহারে।

ত্রাণ সচিবের বিরুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্তদের কটাক্ষ করার অভিযোগ [দণ্ডবিধির ৫০৫(এ) ধারা] আনা হয়েছে। এজাহারে বলা হয়েছে, ফসলহানির পর ১৯ এপ্রিল ত্রাণ সচিব সুনামগঞ্জে এসে জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে সভা করেন। সেখানে তিনি বলেছেন, ‘দেশে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা নামে একটা আইন আছে। এ আইনের ২২ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো এলাকায় অর্ধেকের ওপরে জনসংখ্যা মারা যাওয়ার পর ওই এলাকাকে দুর্গত এলাকা ঘোষণা করতে হয়। না জেনে যারা এমন সস্তা দাবি জানায়, তাদের কোনো ধরনের জ্ঞানই নেই।’ ত্রাণ সচিব অবজ্ঞার সুরে আরও বলেন, ‘কিসের দুর্গত এলাকা, এ এলাকায় একটি ছাগলও তো মারা যায়নি।’

এর আগে ২ জুলাই একই অভিযোগে সুনামগঞ্জ সদর মডেল থানায় পাউবোর ১৫ কর্মকর্তা ও ৪৬ ঠিকাদারকে (মোট ৬১ জন) আসামি করে মামলা করে দুদক। সংস্থার পক্ষে প্রধান কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. ফারুক আহমদ মামলাটি করেন। তবে ওই মামলায় পিআইসির কোনো সদস্যকে আসামি করা হয়নি। বৃহস্পতিবার আইনজীবী সমিতির মামলায় ৩৯ পিআইসির ৭৮ সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের অনিয়ম তুলে ধরা হয়।

এজাহারে বলা হয়, ‘গত বোরো মৌসুমে হাওরের বাঁধ নির্মাণে পানি উন্নয়ন বোর্ড গঠিত প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির (পিআইসি) সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি ছিল। কোথাও এ সংখ্যা ২৩৯টি আবার কোথাও ২৪৬টি। পাউবোর তালিকায় ৭টি পিআইসির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নাম উল্লেখ করা হয়নি। দুর্নীতি ও লুটপাটের শেষ

পর্যায়ে এসব নম্বর ব্যবহারে কাল্পনিক নাম সন্নিবেশ করে কোটি টাকা লুটপাটের জন্য পরিকল্পিতভাবে এমন লুকোচুরি করা হয়েছে। পাউবো কর্মকর্তাদের এ কাজ কোটি টাকা আত্মসাতের প্রচেষ্টা ছাড়া আর কিছুই না।’

পিআইসি প্রসঙ্গে আরও বলা হয়, ‘কোনো বছরই পিআইসি কর্তৃক কাজের ডিজাইন ও তালিকা জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয় না। মামলার আসামি ৩৯টি পিআইসির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক বাঁধের কোনো কাজ করেননি। কাজ না করেই তারা বরাদ্দকৃত বিলের টাকা পাউবো কর্মকর্তাদের যোগসাজশে রূপালী ব্যাংক থেকে উত্তোলন করে আত্মসাৎ করেন। আত্মসাৎকৃত অর্থের পরিমাণ চার কোটি ২০ লাখ ২৭ হাজার ২০১ টাকা।’

৪৬ ঠিকাদার সম্পর্কে এজাহারে বলা হয়, ‘আগেরবার যেসব ঠিকাদার হাওরের বাঁধ নির্মাণে ব্যর্থ হন পাউবো কর্মকর্তাদের যোগসাজশে গত মৌসুমেও তাদেরকেই বাঁধ নির্মাণের দায়িত্ব দেয়া হয়।’

আদালতে বাদীর পক্ষে আইনজীবী ছিলেন সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট শহীদুজ্জামান চৌধুরী। এ সময় সমিতির শতাধিক সদস্য উপস্থিত ছিলেন। দুর্গত মানুষের পক্ষে ও দুর্নীতিগ্রস্তদের বিরুদ্ধে আইনজীবী সমিতির এ মামলাটি ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন সর্বস্তরের মানুষ। সুনামগঞ্জ জেলা বারের ইতিহাসে সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে কোনো প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতির বিরুদ্ধে এ রকম মামলা এবারই প্রথম। মামলাটি সুনামগঞ্জে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে।

মামলার পর শহীদুজ্জামান চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, দুর্নীতির বিষয়ে জেলা আইনজীবী সমিতির পক্ষে সর্বসম্মত সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে মামলা করে আমরা দেশে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছি। এটা দেশের জন্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।’ সমিতির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আবদুল হক জানান, মামলাটি তদন্তের জন্য দুদকে পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন আদালত।

চলতি বোরো মৌসুমে বোরোপ্রধান সুনামগঞ্জের হাওরে ১ লাখ ৬৭ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো ধান আবাদ হয়। চৈত্রের মাঝামাঝি সময় থেকে আগাম বন্যায় একের পর এক হাওরের বাঁধ ভেঙে তলিয়ে যায় বিস্তীর্ণ হাওরের ফসল। এতে চরম ক্ষতির সম্মুখীন হয় চার লাখেরও বেশি কৃষক পরিবার। হাওরের বাঁধ নির্মাণের দুর্নীতির সঙ্গে যুক্তদের বিচারের দাবিতে বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠেন কৃষকসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ। দুর্গত মানুষকে দেখতে আসেন রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী। তারা হাওরে দুর্নীতিতে জড়িতদের বিচারের প্রতিশ্রুতি দেন।

২ জুলাই সুনামগঞ্জ সদর মডেল থানায় ৬১ জনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে মামলা করে দুদক। ওই দিনই সংস্থাটি পাউবোর সুনামগঞ্জ কার্যালয়ের সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আফছার উদ্দিন ও বাঁধের কাজের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স ইব্রাহিম ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী মো. বাচ্চু মিয়াকে গ্রেফতার করে। এ দু’জন এখনও জেলহাজতে আছেন।

আসামি যারা-

প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি) : ৩৯ পিআইসির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে আসামি করা হয়েছে। এরা হলেন- শনির হাওর পিআইসির সভাপতি আবদুল বাতেন ও সাধারণ সম্পাদক রইছ উদ্দিন, গুরমার বর্ধিতাংশ হাওরের বিশ্বজিৎ সরকার ও সর–প মিয়া, মো. ফেরদউস-উর-রহমান ও মো. রিপন মিয়া, আঙ্গারুলি হাওরের জগন্নাথ বিশ্বাস ও মো. ওয়াহেদুজ্জামান, উদগল বিল হাওরের সিথিল চন্দ্র দাস ও রনদা প্রসাদ দাস, চাপতির হাওরের মো. শাহাব উদ্দিন ও তোবা মিয়া, মো. শেখ ফরিদ ও আহমদ চৌধুরী, বরাম হাওরের মো. লাল মিয়া ও আইদ উল্লাহ, হালির হাওরের মনু মিয়া ও সত্যজিত তালুকদার, অসীম চন্দ্র তালুকদার ও অখিল সরকার, মো. মনছুর নূর চৌধুরী ও প্রবীর দাস, সুফিয়ান ও সসীম তালুকদার, আবদুল হাশিম ও আতাবুর রহমান, মাটিয়ান হাওরের হাজী সাইফুল ইসলাম ও মো. সুহেল, গুরমার বর্ধিতাংশ হাওরের (হলদিবাঁধ) মো. আরশাদ মিয়া ও গোলাম মোস্তফা।

কাইল্যানি হাওরের মো. খালেদুজ্জামান তালুকদার ও আবদুল আউয়াল, মো. ওয়াছিল আহমদ ও জজ মিয়া, গুরমার হাওরের জাকিরুল আজাদ মান্না ও আবদুল হাসান পরুল, দুলাল মিয়া ও পারভেজ আহমদ, আনিছুজ্জামান ও আসাদুজ্জামান রোকন, গুরমার বর্ধিতাংশ হাওরের মো. মজনু মিয়া ও সাধারণ সম্পাদক হোসেন আলী, দেখার হাওরের মো. হাবিবুর রহমান ও সোহেল তালুকদার, আবুল হোসেন ও বশির উদ্দিন, মুহিনুর রহমান ও আবদুল মন্নান, জামখোলা আসাদ মিয়া ও ইসকন আলীম, খাইর হাওরের দিদারুল হক দিদার ও দিলদার আহমদ দীলিপ, ফরিদুল ইসলাম ও মো. আবু খালেদ চৌধুরী, আবদুল মালেক ও মো. ফতেকুল ইসলাম, জোয়াল ভাঙ্গার হাওরের ফয়জুল ইসলাম ও আবদুল মন্নান, ফুল মিয়া ও জাহানারা বেগম। করচার হাওরের হাবিবুর রহমান ও আবদুর রহীম, খরচার হাওরের আবদুল হেকিম ও লুৎফুর রহমান, নেছার আহমদ ও তহুর মিয়া, দিরাই চরনারচর হাওরের প্রদ্বীপ ভৌমিক ও স্বপন মজুমদার, কালিকুটা হাওরের সৌম্য চৌধুরী ও চিত্তরঞ্জন সুত্রধর, ছায়ার হাওরের সুব্রত সরকার ও পান্ডব দাস, নলুয়ার হাওরের মো. সুজাত মিয়া ও ছুরত আলী, কালিকোটা হাওরের বশির আহমদ ও রমাকান্ত তালকদার এবং আবুল মিয়া ও দিপক চন্দ্র সরকার।

পানি উন্নয়ন বোর্ড : সুনামগঞ্জ পাউবোর সাবেক নির্বাহী প্রকোশলী মো. আফসার উদ্দিন, সিলেট বিভাগীয় সাবেক তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. নূরুল ইসলাম, সাবেক অতিরিক্ত প্রকৌশলী মো. আবদুল হাই, উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাস, খলিলুর রহমান, সেকশন অফিসার মো. শহীদুল্লাহ, ইব্রাহিম খলিলুল্লাহ, খন্দকার আলী রেজা, মো. রফিকুল ইসলাম, মো. শাহ আলম, মো. বরকত উল্লাহ ভুঁইয়া, মো. মাহমুদুল করিম, মো. মোছাদ্দেক, সজিব পাল ও মো. জাহাঙ্গীর হোসেন।

ঠিকাদার ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান : গুডম্যান এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী আফজালুর রহমান, মেসার্স খন্দকার শাহীন আহমেদের খন্দকার শাহীন আহমেদ, মাহীন কন্সট্রাকশনের জিল্লুর রহমান, সজিবরঞ্জন দাসের সজিব রঞ্জনদাস, মেসার্স এমএল কন্সট্রাকশনের পার্থ সারথী পুরকায়স্থ, মেসার্স হান্নান এন্টারপ্রাইজের হান্নান আহমেদ, মেসার্স নিউ ট্রেডিংয়ের খায়রুল হুদা চপল ও সবুজবাগ পটুয়াখালীর কামাল হোসেন। ঠিকাদার কাজী নাসিম উদ্দিন, খন্দকার আলী হায়দার, মেসার্স আকবর আলীর মো. আকবর আলী, আমিন অ্যান্ড কোম্পানির মো. রবিউল ইসলাম, মেসার্স রোনাম ইন্টারন্যাশনালের মো. আবুল হোসেন, মেসার্স বসু নির্মাণ সংস্থার শিব্রত বসু, মেসার্স হাসান এন্টারপ্রাইজের মো. মোজ্জামেল হক মুনিম, মেসার্স ইব্রাহিম ট্রেডার্সের মো. বাচ্চু মিয়া, মেসার্স এম রহমানের শেখ মো. মিজানুর রহমান, মেসার্স মাহবুব এন্টারপ্রাইজের মো. আবুল মহসিন মাহবুব, মেসার্স মালতি এন্টারপ্রাইজের ব্রিপ্রেস তালুকদার বাপ্পী, মেসার্স মো. জামিল ইকবালের জামিল ইকবাল, মেসার্স নিম্মি অ্যান্ড মুমুর চিন্ময় কান্তি দাস, মেসার্স নিয়াজ ট্রেডার্সের নিয়াজ আহমদ খান, মেসার্স প্রীতি এন্টারপ্রাইজের মিলন কান্তি দে, মেসার্স আরআর ট্রেডিংয়ের খান মো. ওয়াহিদ রনি, মেসার্স সুয়েব এন্টারপ্রাইজের মো. সুয়েব আহমদ, মেসার্স ইউনুছ অ্যান্ড ব্রাদার্সের মো. ইউনুছ, মো. আবদুল কায়ূমের মো. আবদুল কাইয়ূম।

ঠিকাদার আতিকুর রহমান মো. গোলাম সরওয়ার, মো. কামরুজ্জামান কন্সট্রাকশনের খাইরুজ্জামান, মো. মহিজুল হক, মো. মুখলেছুর রহমান প্রা. লিমিটেডের মুখলেছুর রহমান, মো. নূরুল হক, মো. রেনু মিয়া, মো. শাহরিন হক মালিক, শামসুর রহমান, মেসার্স মিম কন্সট্রাকশনের আবদুল মান্নান, মকসুদ আহমদ, মোনা ট্রেডার্সের মো. সাইদুল হক, মেসার্স রাজেন কন্সট্রাকশনের মো. আহতাব চৌধুরী, এসএএসআই প্রা. লিমিটেডের হাসিনা আফরোজ, শেখ আশরাফ উদ্দিন, সুহেল কন্সট্রাকশনের লুৎফুর করিম, সৈকত কন্সট্রাকশনের হাজী মো. কেফাতুল্লা, টেকবি ইন্টারন্যাশনালের হুমায়ূন কবির এবং ঠিকাদার ইকবাল মাহমুদ।

 

http://www.jugantor.com/last-page/2017/08/04/145174/