৪ আগস্ট ২০১৭, শুক্রবার, ১০:৫৮

কোথায় হাত পড়েনি তুফানের?

বগুড়ার তুফান সরকার। নিজেই গড়ে তুলেছে অপরাধ রাজ্য। যে রাজ্যের বাদশাহ সে। এ রাজ্যই তার ভাগ্য বদলে দেয়। বেকারি শ্রমিক থেকে বনে যায় কোটিপতি। গাড়ি, বাড়ি, শানশৌকতের অধিকারী। বগুড়ার মানুষ সবই জানেন। কিন্তু তার প্রভাব আর প্রতিপত্তির কাছে হার মেনেছেন সবাই। মুখ খুললেই নেমে আসবে নির্যাতন- এ ভয়ে সবাই থাকতেন তটস্থ। কিন্তু এখন সবাই তার শাস্তির দাবিতে মাঠে নেমেছেন।

অতীতে ফিরে গেলে দেখা যায়- মাত্র ১০ বছর আগেও চকসুত্রাপুরের ঢাকা বেকারিতে শ্রমিকের কাজ করতো এই তুফান। এরপর এলাকায় হেরোইন ও গাঁজার পুরিয়া বিক্রি করতো। ওই সময়ের মধ্যেই বড়ভাই মতিন সরকারের অর্থ-বৈভব এবং ক্ষমতা বাড়তে থাকায় খুচরা গাঁজা বিক্রেতা তুফান সরকার হেরোইন ও ফেন্সিডিলের পাইকারি ব্যবসা শুরু করে। এতে অল্প সময়ে তার অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন হতে থাকে। এ সময় শ্রমিকলীগেও পদ পান তিনি। কমিটির সদস্যদের নিয়ে তুফান মাদক ব্যবসায় ঝাঁপিয়ে পড়ে। ২০১৫ সালের এপ্রিল মাসে ১৫শ’ বোতল ফেন্সিডিল ও বিপুল অংকের টাকাসহ র্যাবের হাতে ধরা পড়ে তুফান। কিছুদিন হাজতবাসের পর জামিনে বের হয়ে আসে। মাদক ব্যবসা থেকে নিজেকে কিছুটা আড়াল করে গঠন করে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা মালিক সমিতি। এরপর শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে অর্ধশতাধিক কর্মীকে লাঠি হাতে রিকশা থেকে চাঁদা তোলার দায়িত্ব দেয়া হয়। চাঁদা তোলার কাজে পুলিশের সহযোগিতার পাশাপাশি শ্রমিকলীগের প্রভাবশালী এক নেতার সহযোগিতা পান। তার লোকজন ব্যাটারিচালিত রিকশা ধরে চকসুত্রাপুরে তুফানের আস্তানায় নিয়ে যেতো। এরপর সমিতিতে ভর্তি বাবদ আদায় করা হতো ৩ হাজার টাকা। এছাড়াও শহরে চলাচলের জন্য প্রতিদিন রিকশা থেকে আদায় করা হতো ৩০ টাকা করে চাঁদা। এভাবে প্রতিদিন ১০-১৫ হাজার অটোরিকশা থেকে আদায় করা হতো চাঁদার টাকা। এখান থেকেই আঙ্গুল ফুলে কলাগাছে পরিণত হয় তুফান। চকসুত্রাপুরে বিল্ডিং বাড়ি, দুটি বিলাসবহুল প্রাইভেটকার, শহরের চকযাদু সড়কে কোটি টাকা ব্যয়ে দোকানের মালিক হয়ে যায় তুফান সরকার। রিকশা চালক মজিবর সরকারের ৭ম ছেলে তুফান সরকার কয়েক বছরের ব্যবধানে হয়ে ওঠে এলাকার ডন। আর এই ডন হয়ে ওঠার পিছনে শক্তি হিসেবে কাজ করেছে তার বড় ভাই যুবলীগ নেতা মতিন সরকার ও শ্রমিকলীগের এক নেতা।
রাতে বসতো চাঁদা আদায়ের আসর: দিনের আলোতে খুব বেশি দেখা যেতো না তুফান সরকারকে। রাতের বগুড়া নিয়ন্ত্রণে যেতো তার হাতেই। শতাধিক বাহিনী রাস্তায় নেমে পড়তো। কেউ ছিনতাই কেউ ডাকাতি। অপর কয়েকটি গ্রুপ হেরোইন, ফেন্সিডিল, ইয়াবা, গাঁজাসহ সব ধরনের মাদক বিক্রি করতো। রাত দশটার পর থেকেই বিভিন্ন বাহিনী তার কাছে এসবের টাকা নিয়ে হাজির হতো। প্রথমে আসতো অটোরিকশার চাঁদার টাকা। তার পর পর্যায়ক্রমে আসতো মাদক, ছিনতাইয়ের টাকা।
বছরখানেক আগে জেলার আনাচে-কানাছে বিভিন্ন মেলার নামে চলছিল প্রকাশ্যে জুয়া এবং অশ্লীল যাত্রা। এসব আসর থেকে সেই সময় প্রতি রাতে ৫ লাখের বেশি টাকা আসতো তার দরবারে। এছাড়াও প্রতি রাতেই পরিবহন খাত থেকে আসতে শুরু করে বিভিন্ন অবৈধ টাকার বান্ডিল। এসব টাকা বড় বড় শপিং ব্যাগে ভরে তার দরবারে আনতো স্পেশাল বাহিনীর সদস্যরা। এসব টাকার ভাগ পরে বিভিন্ন কর্তাব্যক্তিদের দরবারে পৌঁছে দিতো তুফান বাহিনীর সদস্যরাই। তুফানের এসব অবৈধ টাকার ভাগ পাওয়ার তালিকায় আছে আওয়ামী লীগের জেলা পর্যায়ের উচ্চতর নেতা, পুলিশ প্রশাসন।
মহাসড়কে পরিবহন চাঁদাবাজি: বগুড়া শহরের পূর্ব এবং পশ্চিম পাশ দিয়ে চলে গেছে রংপুর-বগুড়া-ঢাকা মহাসড়ক। এসব সড়কে প্রতিদিন হাজার হাজার বাস ট্রাক চলাচল করে। বগুড়া জেলা শুরুর সীমানা শিবগঞ্জের মোকামতলা থেকে শেরপুর পর্যন্ত বিভিন্ন স্পটে মতিন-তুফান বাহিনীর সদস্যরা পরিবহনগুলো থেকে অবৈধ ভাবে টাকা আদায় করতো। বগুড়ার সীমানার উপর দিয়ে এসব পরিবহন যাতায়াত করতে এই বাহিনীর কাছে দিতে হতো প্রতি গাড়ি ৬০ টাকা। প্রতিদিন কমপক্ষে ৩০ হাজার গাড়ি এই রোডে যাতায়াত করে। গত বুধবার রাত পর্যন্ত বগুড়ার মহাসড়কে মতিন-তুফান বাহিনীর সদস্যরা চাঁদা তুলেছে। বৃহস্পতিবারে দিনের বেলা ট্রাক থেকে চাঁদা তুলতে দেখা না গেলেও বাস থেকে দ্বিগুণ পরিমাণ চাঁদা তুলতে দেখা গেছে।
সমস্যা সমাধানের সাইনবোর্ড: দেশে আর কোথাও এমন সাইনবোর্ড কেউ না দেখলেও বগুড়াবাসী শহরের বিভিন্ন জায়গায় ঝুলতে দেখেছেন ব্যতিক্রমী সাইনবোর্ড। সেই সাইনবোর্ডে লেখা জমিজমা দখল করে দেয়া, টাকা উদ্ধার, বিচার সালিশসহ যাবতীয় সমস্যার জন্য যোগাযোগ করুন। যোগাযোগের ঠিকানার জায়গায় লেখা আছে তুফান সরকার। সঙ্গে তার মুঠোফোন নম্বর। অনেকেই তার সঙ্গে সমস্যা সমাধানের জন্য যোগাযোগ করতো। মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে ন্যায় হোক আর অন্যায় হোক কাজ করে দিতো তুফান।
মানববন্ধন: বগুড়ার বহুল আলোচিত কিশোরী ধর্ষণ ও মা-মেয়ের মাথা ন্যাড়া করার ঘটনায় ধর্ষক শ্রমিকলীগ নেতা তুফান ও তার পরিবারের অভিযুক্ত সদস্যদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে উত্তাল সমগ্র বগুড়া জেলা। প্রতিদিনের মতো গতকালও বিক্ষোভ সমাবেশ হয়েছে। সকাল থেকেই শহরের জিরোপয়েন্ট সাতমাথায় দাঁড়িয়ে ধর্ষকদের শাস্তির দাবি জানাচ্ছে বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন। মানববন্ধন ও বিক্ষোভ সমাবেশে বক্তারা বলেন, এ বর্বরোচিত ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হলে নারী নির্যাতন কমবে না। শুধু ধর্ষক তুফানই নয় তুফানের গডফাদারদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা সম্ভব না হলে অপরাধীদের দমন করা সম্ভব হবে না।
রিমান্ড শেষে আসামিরা জেলে: কিশোরী ধর্ষণের ঘটনায় তুফান সরকারের স্ত্রী আশা ও শাশুড়ি রুমকির দ্বিতীয় দফা রিমান্ড শেষ হয় বৃহস্পতিবার। বিকালে তাদের অতিরিক্ত চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করা হয়। এ সময় মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ইন্সপেক্টর (অপারেশন) আবুল কালাম তৃতীয় দফায় আবারো পাঁচ দিনের রিমান্ডের আবেদন করেন। শুনানি শেষে অতিরিক্ত চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক শ্যাম সুন্দর রায় রিমান্ড নামঞ্জুর করে তাদের জেলহাজতে প্রেরণের নির্দেশ দেন। প্রয়োজনে সাতদিনের মধ্যে জেল গেটে জিজ্ঞাসাবাদের আদেশ দেন।
বগুড়া সদর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (মিডিয়া) সনাতন চক্রবর্তী বলেন, মতিন-তুফান বগুড়ার কুখ্যাত মাদক ব্যবসায়ী। বিভিন্নভাবে তারা অবৈধ অর্থের মালিক হয়ে যায়। তাদের অবৈধ কারবার সম্পর্কে খোঁজ নেয়া হচ্ছে। অপরদিকে ব্যাটারিচালিত রিকশা থেকে চাঁদা আদায় পুলিশি হস্তক্ষেপে ইতিমধ্যেই বন্ধ হয়েছে। একটি হত্যা মামলায় মতিনকে গ্রেপ্তারের জন্য আদালত থেকে ওয়ারেন্ট কপি থানায় পৌঁছেছে। তাকে অচিরেই গ্রেপ্তার করা হবে।

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=77097