৪ আগস্ট ২০১৭, শুক্রবার, ১০:৫৪

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

নিয়ম ভেঙে ৫০ শিক্ষক নিয়োগ দুই বছরেই

নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির শর্তে ছিল মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সব কটিতে প্রথম শ্রেণি থাকতে হবে। কিন্তু উচ্চ মাধ্যমিকের শর্ত পূরণ না করেও এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্বধর্ম ও সংস্কৃত বিভাগের শিক্ষক দিদারুল ইসলাম। একই বিভাগে একই সময়ে নিয়োগ পাওয়া মোহসীন রেজাও মাধ্যমিকের শর্ত পূরণ করতে পারেননি।
এ ছাড়া অনুজীব বিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক ইব্রাহিম মিয়া স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্বের শর্ত পূরণ করতে না পারলেও তিনি এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। ২০১৫ সালে নিয়োগ পাওয়া এ শিক্ষক গত ২৯ জুলাই উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনে সিনেটের বিশেষ অধিবেশন চলাকালে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলায় অংশ নিয়েছিলেন। এই বিভাগে দুটি শূন্য পদে নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হলেও আইন ভেঙে নিয়োগ দেওয়া হয় পাঁচজনকে।
একইভাবে ২০১৬ সালে ফলিত রসায়ন ও কেমিকৌশল বিভাগে নিয়ম লঙ্ঘন করে চারটি পদের বিপরীতে নিয়োগ দেওয়া হয় ৯ জনকে। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর উভয় পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণি থাকার শর্ত দেওয়া হলেও ওই ৯ জনের তিনজন স্নাতকোত্তর পাসই করতে পারেননি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য ও শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ন্যূনতম যোগ্যতাও পূরণ করতে পারেননি এমন অন্তত ৫০ জন শিক্ষককে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে গত দেড় থেকে দুই বছরে। আবার নিয়ম লঙ্ঘন কিংবা বিজ্ঞাপনের শর্ত ভেঙেও নিয়োগ দেওয়া হয়েছে কাউকে কাউকে।
নতুন নতুন বিভাগ খোলার নামেও ‘অযোগ্যদের’ পুনর্বাসন করা হয়েছে—এমন অভিযোগ অনেক শিক্ষকের।
তাঁরা বলছেন, একের পর এক বিভাগ খুলে দলীয় আনুগত্য কিংবা কাছের লোক বিবেচনায় শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এতে পাঠদানের মান অনেক নিচে নেমেছে।
শিক্ষকরা বলছেন, যোগ্য প্রার্থীকে বাদ দিয়ে অযোগ্যদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া নিয়ে সিন্ডিকেটেও মতবিরোধ হয়েছে। তবুও অযোগ্য প্রার্থীকেই নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। প্রভাবশালী শিক্ষকরাই তাঁদের পছন্দের প্রার্থীকে এভাবে নিয়োগ দিয়েছেন।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ইসলামিক স্টাডিজ, যোগাযোগ বৈকল্য, পরিসংখ্যান বিভাগ, ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, ফলিত রসায়ন ও কেমিকৌশল, দর্শন, মুদ্রণ ও প্রকাশনা বিদ্যা, কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, শিল্পকলার ইতিহাস এবং বিশ্বধর্ম ও সংস্কৃতি বিভাগে শিক্ষক নিয়োগে নিয়ম ভাঙা হয়েছে।
সিনিয়র এক শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কম যোগ্যতাসম্পন্ন কিংবা পেছন থেকে নিয়োগ পাওয়া শিক্ষকরা শিক্ষা-গবেষণায় মনোনিবেশের চেয়ে আনুগত্য দেখাতেই বেশি ব্যস্ত। দিনে ক্লাস-পরীক্ষা নেওয়ার পর উপাচার্যের বাসভবনে রাতভর তোষামোদ চলে। কোনো প্রয়োজন না থাকলেও কেবল সালাম দিতে যান সদ্য নিয়োগ পাওয়া তরুণ শিক্ষকরা। ’
নিয়ম ভেঙে শিক্ষক নিয়োগের বিষয়ে জানতে চাইলে সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ও সাবেক সিন্ডিকেট সদস্য অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম বলেন, ‘এই বিষয়ে অনিয়ম হলেও দীর্ঘ সাড়ে আট বছরেও কোনো সিন্ডিকেট সদস্য এটার প্রতিবাদ কিংবা লিখিত অভিযোগ করেননি। কখনো কখনো বিভাগের চেয়ারম্যান অভিযোগ করেছেন। বিভাগের প্রয়োজন না থাকলেও অতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ’
সাদেকা হালিম আরো বলেন, মূলত রাজনৈতিক বা দলীয়করণের জন্যই এমনটি হয়েছে। ব্যক্তিবিশেষের জন্য দল ভারী করা ও ভোটার বাড়ানোর জন্যই এই নিয়োগ দেওয়া হয়। দলীয়করণের মাধ্যমে শিক্ষক হওয়ায় সম্প্রতি একদল শিক্ষক শিক্ষার্থীদের গায়ে হাত দিয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুযায়ী, কোনো বিভাগের সমন্বয় ও উন্নয়ন (সিঅ্যান্ডডি) কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। এই কমিটি যে কয়জনের সুপারিশ করবে ততজনই নিয়োগ দেওয়া হবে।
সূত্র জানায়, ২০১৩ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটে আইন করা হয়, নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির বাইরে অতিরিক্ত একজনকে নেওয়া যাবে। তবে সেটিতে বিভাগের সিঅ্যান্ডডি কমিটির সুপারিশ থাকতে হবে। কিন্তু সাম্প্রতিক নিয়োগে এমন নিয়ম মানা হয়নি; যদিও সিন্ডিকেট সদস্যরা আপত্তি করেছিলেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সিন্ডিকেট সদস্য কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিজ্ঞপ্তির শর্ত পূরণ না করলেও নিয়ম ভেঙে শিক্ষক নিয়োগ হয়েছে। এই নিয়ে সিন্ডিকেটে নীল-সাদা দলের সদস্যরা আপত্তি জানালেও মতামত আমলে নেওয়া হয়নি। যোগ্য ও ভালো ফলধারী শিক্ষার্থীদের বাদ দিয়ে উপাচার্য নিজের প্রাধান্য দিয়েছেন। ’ গত ১২ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভায় ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের অধীন ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস বিভাগে শর্ত শিথিল করে ন্যূনতম যোগ্যতা ছাড়াই ছয়জনকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস বিভাগে সাতটি পদের বিপরীতে ৯ জন শিক্ষক নিয়োগ পেয়েছেন। ১১ জনের সাক্ষাৎকার নেওয়ার পর ৯ জনকে নিয়োগের সুপারিশ করা হয়। কিন্তু নিয়োগ পাওয়া ছয়জনই বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা শর্ত পূরণ করতে পারেননি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান সিন্ডিকেট সদস্য ও ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক নীলিমা আকতার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ন্যূনতম শর্ত পূরণ না করা সত্ত্বেও শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। আবার বিভাগের সিঅ্যান্ডডি কমিটির সুপারিশের বাইরেও নিয়ম লঙ্ঘন করে শিক্ষক নেওয়া হয়েছে। বিশেষ বিবেচনায় নিয়োগ পাওয়া শিক্ষকরা দলবাজিতেই বেশি ব্যস্ত। ’
এদিকে দর্শন বিভাগে শিক্ষক হিসেবে খন্দকার তোফায়েল আহমেদকে দেওয়া নিয়োগ অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করে হাইকোর্টের রায় নিয়ে আপিল বিভাগ ‘নো অর্ডার’ বলে আদেশ দিয়েছেন। ফলে হাইকোর্টের রায় বহাল থাকল।
প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে আপিল বিভাগ গতকাল এ আদেশ দেন। হাইকোর্টের রায় স্থগিত করতে তোফায়েল আহমেদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের করা পৃথক দুই আবেদনের ওপর শুনানি শেষে এ আদেশ দেওয়া হয়।
শুনানিতে প্রধান বিচারপতি বলেছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঐতিহ্য বজায় রেখে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে না। আগে কোনো একটি বিভাগে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার ক্ষেত্রে সেই বিভাগে যারা মেধাতালিকায় প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় হতো তাদের মধ্য থেকে নিয়োগ দেওয়া হতো। একজন উপাচার্যের নাম উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, ‘ওই পর্যন্ত নিয়োগপ্রক্রিয়া ঠিক ছিল। কিন্তু এখন আর সেটি হচ্ছে না। এটা অশনিসংকেত। ’
দর্শন বিভাগে দুজন প্রভাষক নিয়োগে গত বছর ২ জুলাই বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়। বিজ্ঞপ্তিতে আবেদনকারীদের এসএসসি ও এইচএসসিতে যোগ্যতা হিসেবে সিজিপিএ ৫-এর মধ্যে ন্যূনতম ৪.২৫ পয়েন্ট চাওয়া হয়। আবেদন পাওয়ার পর গত বছর ২৯ ডিসেম্বর দর্শন বিভাগে পাঁচজনকে প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। কিন্তু দেখা যায়, নিয়োগপ্রাপ্তদের মধ্যে খন্দকার তোফায়েল আহমেদের সিজিপিএ ৩.১৯। এ ছাড়া কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে দুই শিক্ষক নিয়োগে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। তবে বিভাগের সিঅ্যান্ডডি কমিটির সুপারিশ ছাড়াই নিয়মবহির্ভূতভাবে ১১ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে; যা গত বছরের ২৪ আগস্ট সিন্ডিকেট সভায় অনুমোদন পেয়েছে। এটি নিয়ে কয়েকজন সিন্ডিকেট সদস্য বিরোধিতা করলেও সংখ্যায় কম হওয়ায় সেটি ধোপে টেকেনি বলে জানান এক সিন্ডিকেট সদস্য।
২০১৬ সালের ২১ জুন পরিসংখ্যান বিভাগে বিজ্ঞাপনে দেওয়া পদের চেয়ে অতিরিক্ত দুজনকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে কুষ্টিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্ত্র প্রশিক্ষণ নেওয়া মতিয়ার রহমানকে পেছনের সারি থেকে নিয়োগ দেওয়া হয়।
২০১৬ সালের নভেম্বরে ফলিত রসায়ন ও কেমিকৌশল বিভাগে নিয়মবহির্ভূতভাবে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। বিভাগ সূত্র জানায়, কয়েক মাস আগে ছুটিজনিত শূন্য পদের বিপরীতে চারটি অস্থায়ী প্রভাষক পদে আবেদন নেওয়া হয়। স্নাতকোত্তর শেষ না হওয়া সত্ত্বেও তিনজনকে শর্ত শিথিল করে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া বিজ্ঞপ্তিতে চারটি পদের বিপরীতে নেওয়া হয়েছে ৯ জনকে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন চালু হওয়া ‘মুদ্রণ ও প্রকাশনা বিদ্যা’ বিভাগে নিয়োগ পাওয়া চারজন শিক্ষকেরই ন্যূনতম যোগ্যতা নেই। সূত্র জানায়, শিক্ষক নিয়োগে ন্যূনতম যোগ্যতা হিসেবে প্রার্থীদের এসএসসি ও এইচএসসিতে জিপিএ ৫-এর মধ্যে ন্যূনতম ৪.২৫ এবং স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে উভয় পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণি অথবা সিজিপিএ ৪-এর মধ্যে ন্যূনতম ৩.৫০ থাকার বাধ্যবাধকতা দেওয়া হয়েছিল। তবে নিয়োগ পাওয়া চারজনের দুজনের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় জিপিএ ৫-এর মধ্যে ছিল ৩.৭০। অন্য দুজন স্নাতক সম্মানে সিজিপিএ ৩.৪৫ ও ৩.৪৭ পেয়েছেন।
জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে গত ২১ জুন বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা পদের চেয়ে অতিরিক্ত তিনজনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির নেতার মেয়েও রয়েছেন। ওই শিক্ষককে পেছনের সারি থেকে নেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করা হলেও প্রভাবশালী শিক্ষকের মেয়ে হওয়ায় সেটি বৈধতা দেওয়া হয়েছে। নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের দুজনের বিপরীতে নেওয়া হয়েছে সাতজনকে। ফিন্যান্স বিভাগেও বিজ্ঞাপিত পদের চেয়ে একজন বেশি নেওয়া হয়েছে; অথচ সেটি বিভাগের সিঅ্যান্ডডি কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে ছিল না।
চারুকলা অনুষদের শিল্পকলা ইতিহাস বিভাগে কোনো বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই নিয়োগের জন্য প্রার্থী ঠিক করা হয়। গত ২৬ এপ্রিল সিন্ডিকেট সভায় সেটি অনুমোদন পেয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ বোর্ডের প্রধান ও উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. নাসরীন আহমাদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘শিক্ষক নিয়োগে একটি শর্ত দেওয়া থাকে; কিন্তু এটাই বেদবাক্য না। ভালো ফলধারী কিংবা সর্বোচ্চ ফলধারীকে নিয়োগ দেওয়া হবে সেটি কোথাও বলা হয়নি। বিভিন্ন যোগ্যতা দেখেই নিয়োগ দেওয়া হয়। যারা ভালো ফলধারী, অনেকেই গুছিয়ে কথা বলতে পারে না। আবার অপেক্ষাকৃত কম ফলধারীরা গুছিয়ে কথা বলতে পারে। কারো কারো প্রকাশনাও থাকে, তাদেরকে নেওয়া হয়। ’
বিজ্ঞপ্তির অতিরিক্ত নেওয়ার বিষয়ে ড. নাসরীন আহমাদ বলেন, ‘বিজ্ঞাপন দেওয়ার প্রক্রিয়া করতে সময় লাগায় এই সময়ের মধ্যে আরো শিক্ষক নেওয়ার প্রয়োজন হয়। এ জন্য নতুন করে বিজ্ঞপ্তি না দিয়ে বেশি নেওয়া হয়। ’


http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2017/08/04/527566