৪ আগস্ট ২০১৭, শুক্রবার, ১০:৪৮

নির্বাচন কমিশনের কার্যকারিতা

ড. আবদুল লতিফ মাসুম

উত্তরাধিকার আকস্মিকভাবে অর্জন করা যায় না। এটি হচ্ছে একটি বৃক্ষের বেড়ে ওঠার মতো। আপনি যদি চানÑ তিন দিনের মধ্যে বড় রকমের সেগুন কাঠের ফার্নিচার তৈরি করে দিতে হবে, তাহলে হয়তো বা সম্ভব। কিন্তু যদি বলা হয়, তিন দিনে সেগুন গাছ বড় করে দিতে হবে তা আসলেই অসম্ভব। যেকোনো প্রতিষ্ঠানের কার্যকারিতা তার নিয়মকানুন, নির্দিষ্ট কার্যাবলি ও প্রায়োগিক বাস্তবতার ওপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশে নির্বাচন কমিশনের কার্যকারিতা ও অনুরূপ বিধিবদ্ধতাও অতীতের উত্তরাধিকারের ওপর নির্ভর করে। সাংবিধানিক উত্তরাধিকারের কথা যদি বলা হয়, তাহলে স্বীকার করতেই হবে, বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন ক্ষেত্রে শক্ত সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা নিয়ে অগ্রসর হয়। সংবিধানের সপ্তম ভাগের ১১৮ থেকে ১২৬ অনুচ্ছেদ পর্যন্ত সুবিস্তৃতভাবে নির্বাচন কমিশনের প্রতিষ্ঠা, দায়দায়িত্ব ও কার্যকারিতা বিবৃত হয়েছে। অনুচ্ছেদ ১১৮ এর চতুর্থ ধারায় বলা হয়েছে, ‘নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকিবে এবং কেবল এই সংবিধান ও আইনের অধীন হইবেন’। যারা সংবিধানের প্রণেতা, তারা নিশ্চয় তত্ত্বগতভাবে নির্বাচন কমিশনকে স্বকীয় ও স্বাধীন করতে চেয়েছেন। কিন্তু সাংবিধানিক বিধানাবলি যারা প্রাথমিক অবস্থায় প্রয়োগ করেছেন তারা তত্ত্বকথার বাহুল্য দেখালেও বাস্তবে তার বিপরীতটি করেছেন।
বাংলাদেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭৩ সালে। বিধিমোতাবেক প্রেসিডেন্ট বিচারপতি ইদ্রিসকে ১৯৭২ সালের ৭ জুলাই প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে মনোনীত করেন। তিনি ১৯৭৭ সালের ৭ জুলাই পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। এর পর ২০১৭ সাল পর্যন্ত আরো ১১ জন বিশিষ্ট ব্যক্তি প্রধান নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পালন করেন। তাদের ব্যক্তিত্ব, কার্যকাল এবং সার্বিক দায়িত্ব পালনের বিষয়াদি যদি বিশ্লেষণ করা হয় তাহলে তা অতি উজ্জ্বল ইতিহাস বহন করে না। প্রথম থেকেই স্বাধীনতার পরিবর্তে অধীনতার সংস্কৃতি নির্বাচন কমিশনকে পেয়ে বসে। ১৯৭৩ সালের নির্বাচনের কথা যদি উল্লেখ করা যায় তা খুব সুখকর নয়। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সদ্য তখন দেশ স্বাধীন হয়েছে। তারা সর্বদলীয় জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠার দাবি নাকচ করেছে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্যতার মাপকাঠি ধরলে আওয়ামী লীগের প্রাধান্য অস্বীকার করার উপায় নেই। তাদেরই তখন জয়জয়কার। এর মধ্যে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ, ন্যাপ-মোজাফ্ফর, ন্যাপ-ভাসানী এবং কমিউনিস্ট পার্টি নির্বাচনে অংশ নেয়। সংসদীয় ৩০০ আসনের মধ্যে তারা ২৯২টি আসন লাভ করে। ক্ষমতাসীন দলের এত বিশালত্ব সত্ত্বেও সামান্য বিরোধিতা কেউ এরা সহ্য করতে পারেনি। তখন এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে, যা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অবৈধ হস্তক্ষেপ ছিল নির্বাচনী ফলাফল নিজেদের পক্ষে নেয়ার ব্যাপারে। অসংখ্য ঘটনা ’৭৩ এর নির্বাচনকে কলঙ্কিত করে। কী এমন হতো যদি আরো ২০-৫০টি আসন বিরোধীরা পেত। এটা প্রমাণ করে যে, আওয়ামী লীগ আজ যা করছে তাদের তা করার উত্তরাধিকার রয়েছে। সেই সময়ে ভালো মানুষ হিসেবে পরিচিত বিচারপতি ইদ্রিস এসব অন্যায়ের বিরুদ্ধে ‘টুঁ-শব্দ’টি করেননি। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে যে ‘পোষক-পোষ্য’ প্যাট্রন-কায়েন্ট সম্পর্ক বহমান রয়েছেÑ এসব ঘটনা তারই প্রমাণ। সরকার যা বলবে তাই শুনতে হবেÑ এ রকম একটি ‘মিথ’ আগে থেকেই তৈরি হয়ে আছে।
বাংলাদেশ জাতি রাষ্ট্রের নির্বাচন সংস্কৃতিতে বড় ধরনের একটি মাইলফলক রচিত হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। এর ইতিহাস-ভূগোল ঘেঁটে পরিসর বাড়াতে চাই না। এটা সবাই স্বীকার করেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে গৃহীত তিনটি নির্বাচনÑ ১৯৯১, ১৯৯৬ ও ২০০১ কমবেশি অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ছিল। যদিও এসবের বিরুদ্ধে প্রধান রাজনৈতিক দু’টি দলের ‘সূক্ষ্ম ও স্থ’ূল কারচুপি’র অভিযোগ ছিল। এ নির্বাচনগুলো গ্রহণযোগ্য হতে পেরেছে এই কারণে যে, এর উৎসমূল তত্ত্বাবধায়ক সরকারে নিহিত ছিল। সরকারি আদেশে চলার যে মিথ তৈরি হয়েছে সেই সরকারই যখন নিরপেক্ষ ছিল তখন নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষ থাকা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। ২০১৩ সালের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে যে সর্বনাশ সাধিত হয় তা সবার জানা কথা। এখন বিপর্যস্ত নির্বাচনব্যবস্থাকে আগের গ্রহণযোগ্যতায় নিয়ে যাওয়াটাই নির্বাচন কমিশনের প্রধান চ্যালেঞ্জ। বর্তমান নির্বাচন কমিশন তাদের বক্তৃতা, বিবৃতি ও ঘোষিত রোডম্যাপের মাধ্যমে মানুষকে বিশ্বাস করাতে চাচ্ছে যে তারা একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন উপহার দিতে চায়। যদিও প্রধান বিরোধী দল বিএনপি কমিশন সম্পর্কে কঠিন কঠিন কথা বলছেÑ তবুও নির্বাচন কমিশন ‘সবার আস্থা অর্জনের জন্য কাজ করছে’। এরই একটি অংশ হিসেবে ৩১ জুলাই বাংলাদেশের সিভিল সোসাইটির সাথে নির্বাচন কমিশন-ইসি সংলাপে মিলিত হয়।
দ্বিদলীয় ধারায় ক্ষয়িষ্ণু বাংলাদেশের সিভিল সোসাইটি গরিষ্ঠতার ভিত্তিতে সেখানে একটি সমন্বিত মতামত তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছে। যদিও সেখানে দু-চারজন বশংবদ বুদ্ধিজীবী ছিলেন, সাধারণ গরিষ্ঠতায় তারা কোণঠাসা হয়েছেন। বুদ্ধিজীবীদের এই সমন্বিত মতামতকে বিএনপিসহ সব মহল স্বাগত জানিয়েছে। মনীষী প্লেটো বলেছেন, ‘Collective wisdom is much more than a philosopher king’। সেখানে যেসব বিষয় সুপারিশ এসেছে তা হলোÑ ক. নিয়মিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হিসেবে সেনা মোতায়েন। সিভিল সোসাইটির পর্যবেক্ষণ হচ্ছেÑ নির্বাচন নিয়ে প্রার্থী, পোলিং এজেন্ট, ভোটার সবার মনে আতঙ্ক রয়েছে। আতঙ্ক দূর করতে সেনাবাহিনীকে ‘আইন ও শৃঙ্খলা রক্ষাকারী’ বাহিনীর সংজ্ঞায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। প্রসঙ্গত, জনপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (Peoples Representative Order-RPO, 1972) এ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংজ্ঞায় পুলিশ, আর্মড পুলিশ, র্যাব, আনসার, বিজিবি ও কোস্টগার্ডের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এতে সেনাবাহিনী বা সশস্ত্রবাহিনীর কথা নেই। ২০০৯ সালে আরপিও সংশোধনীতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংজ্ঞা থেকে সশস্ত্রবাহিনীকে বাদ দেয়া হয়। বর্তমান আইন অনুযায়ী সশস্ত্রবাহিনী ‘স্ট্রাইকিং ফোর্স’, তারা ক্যাম্পে অবস্থান করবে প্রয়োজনে তাদের ডাকা যাবে। সেনাবাহিনী সম্পর্কে আওয়ামী লীগের ‘নিরপেক্ষতা ভীতি’ থাকার কারণে সে সময় আওয়ামী লীগ এ ব্যবস্থাটি করেছিল। এত দিনে পদ্মা, মেঘনা, যমুনায় অনেক পানি গড়িয়ে গেছে। সংলাপ-পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ‘সকল বিতর্কের ঊর্ধ্বে সেনাবাহিনীকে রাখার যুক্তিতে নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের বিরোধিতা করেছেন’। সঙ্গতভাবেই পর্যবেক্ষকেরা মন্তব্য করতে পারেন যে, তাহলে এত দিনে সমীকরণে কি কোনো পরিবর্তন ঘটেনি? খ. সংলাপে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক বা সহায়ক সরকারের বিষয়টি আলোচনায় আসে। গরিষ্ঠ অংশগ্রহণকারীরা সহায়ক সরকারের প্রয়োজনীয়তার কথা ব্যক্ত করেন। তারা নির্বাচনের আগে একটি নিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠার স্বার্থে বর্তমান সংসদ ভেঙে দেয়ার সুপারিশ করেন। এর পক্ষে তারা যুক্তি দেখান যে, সংসদ বহাল থাকলে বর্তমান সংসদ সদস্যরা বিশেষ সুবিধা পাবেন এবং প্রভাব বিস্তার করার সুযোগ পাবেন। সরকারসমর্থিত সাবেক রাষ্ট্রদূত ওয়ালিউর রহমান অবশ্য সহায়ক সরকারের তীব্র বিরোধিতা করেন। গ. সুশীলসমাজের প্রতিনিধিরা ভাবমর্যাদা পুনরুদ্ধারে নির্বাচন কমিশনকে সক্রিয় হতে এবং আগামী সংসদ নির্বাচনকে ভয়মুক্ত ও অংশগ্রহণমূলক করতে নিজেদের সক্ষমতা প্রমাণ করার পরামর্শ দিয়েছেন। সংলাপে অংশ নেয়া ব্যক্তিদের অনেকে বলেছেন, এর আগে কাজী রকীবউদ্দিন কমিশনের কার্যকলাপে নির্বাচন নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে আস্থার সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে, সেই আস্থা পুনরুদ্ধার করতে হবে। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ইসিকে শক্তভাবে কাজ করতে হবে। সংলাপে আরো মতামত দেয়া হয় যে, সব দলকে ভোটে আনতে হবে। এ জন্য সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরি করতে হবে। তারা আরো বলেন, নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনের স্বাধীন ভূমিকা মানুষের কাছে দৃশ্যমান করতে হবে ও প্রমাণ করতে হবে। কেউ কেউ এ নির্বাচন কমিশনকে সক্ষমতা বাড়ানোর পরামর্শ দেন। ঘ. সম্প্রতি রোডম্যাপ ঘোষণা করার সময় সিইসি বলেছিলেন, তফসিল ঘোষণার আগে নির্বাচন কমিশনের করার কিছুই নেই। সিভিল সোসাইটির অনেকে এ মন্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশ করেন। তারা গুরুত্বের সাথে বলেন যে, প্রধান নির্বাচন কমিশনের ওই ধারণা গ্রহণযোগ্য নয়। এখন থেকে ইসির অনেক কিছু করার সুযোগ আছে বলে তারা মন্তব্য করেন। ঙ. ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ‘না’ ভোট ছিল। ২০০৯ সালে বিধানটি বাতিল করা হয়। এখন প্রধান দুটি দল কেউই ‘না’ ভোট রাখাকে জরুরি মনে করে না। না ভোটের পক্ষে যুক্তি হলো বড় দলগুলো অনেক ক্ষেত্রে এমন ব্যক্তিদের মনোনয়ন দেয় যাদের পেশিশক্তি আছে এবং কালো টাকার মালিক। সে ক্ষেত্রে ভোটারদের এ ধরনের প্রার্থীকে ভোট না দেয়ার সুযোগ থাকতে হবে। সংলাপে আরো অনেক বিষয়ের অবতারণা ঘটে।
সিভিল সোসাইটির সাথে সংলাপ করে নির্বাচন কমিশন একটি ভালো কাজ করেছে। অতীতে দেখা গেছে এ ধরনের সংলাপ শুধু লোক দেখানো বা প্রচারনির্ভর হয়েছে। নাগরিক সাধারণ অনুধাবন করে যে, নির্বাচন কমিশনের সৎ উদ্দেশ্য থাকলেও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য তিনটি শক্তির ওপর এর কার্যকারিতা নির্ভরশীল। প্রথমত সরকারের সদিচ্ছা। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির অনিবার্যতায় তৃতীয় পক্ষের তত্ত্বাবধান ছাড়া নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার নয়। সুতরাং যে নামেই হোক, তত্ত্বাবধায়ক সরকার, সহায়ক সরকার বা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অর্জনে নির্বাচন কমিশনকে আইনগত না হলেও নৈতিক ভূমিকা পালন করতে হবে। নির্বাচনের কার্যকারিতা যে দুটো বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল তা হলোÑ আমলাতন্ত্র এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। বর্তমান সরকার দুটোকেই শক্তভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে। নির্বাচন কমিশন যদি সত্যি সত্যি এর কার্যকারিতা প্রমাণ করতে চায়, তাহলে এই দুটো শক্তি নিয়ন্ত্রণে কমিশনকে শক্ত ও সাহসী হতে হবে। নির্বাচন অনুষ্ঠানের দিন ভোটকেন্দ্র যাতে সরকারি ও বেসরকারি কোনো শক্তি বা গোষ্ঠী দখল করতে না পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে। এসব কিছু করতে পারলেই নির্বাচন কমিশন তার কার্যকারিতা প্রদর্শনে সক্ষম হবে। সে ক্ষেত্রে জনগণ নির্বাচন কমিশনের ওপর আস্থা রাখতে চায়। কমিশনের কার্যকারিতা নিশ্চিত হলে, তারা জনগণের সতত সাহসী অভিনন্দন ও কৃতজ্ঞতা অর্জন করবে।
লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
Mal55ju@yahoo.com

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/241201