৪ আগস্ট ২০১৭, শুক্রবার, ১০:৪৮

সড়ক দুর্ঘটনা

ড. আব্দুস সাত্তার

দুর্ঘটনা কী তা বাংলাদেশের সবাই বোঝেন। বোঝেন যারা বুঝমান। আকস্মিক বিপদ, যার ওপর কারো কোনো হাত নেই, এরূপ ঘটনাকেই দুর্ঘটনা বলে। যেমন বিমান দুর্ঘটনা। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিমান দুর্ঘটনা ঘটে। ঘটে প্রাণহানিও। ইঞ্জিন বিকল হওয়া কিংবা অন্য কোনো জটিলতার কারণেও ঘটে দুর্ঘটনা। এরূপ দুর্ঘটনার প্রকৃত কারণ জানা যায় ব্ল্যাকবক্সের মাধ্যমে। যদি সেই ব্ল্যাকবক্স উদ্ধার করা সম্ভব হয়। কখনো কখনো বিমান চালকের অসতর্কতার কারণেও দুর্ঘটনা ঘটে, এমন নজিরও আছে। তবে এসব দুর্ঘটনার সঠিক কারণ ব্ল্যাকবক্সের মাধ্যমে জানা যায় বলে মনগড়া অবাস্তব আলোচনা হয় না। কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে এমন কোনো ব্যবস্থা না থাকার কারণে দুর্ঘটনার প্রকৃত কারণ জানা যায় না। ফলে অনেকে দুর্ঘটনা সম্পর্কে অনুমানে কথা বলতে থাকেন। বাংলাদেশের সড়ক দুর্ঘটনা সম্পর্কে টকশোগুলোতে বিজ্ঞ এবং অভিজ্ঞজনেরা উপভোগ্য মজার মজার তথ্য উপস্থাপন করতে থাকেন। তাদের আলোচনা শুনলে মনে হয় তারা ভিন্ন গ্রহের মানুষ। কারণ তারা পাণ্ডিত্যপূর্ণ যেসব কথাবার্তা বলতে থাকেন, তাতে দুর্ঘটনাবিষয়ক বাস্তবতার সাথে মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। তারা তাত্ত্বিক এবং কাল্পনিক কথাবার্তা বলতে থাকেন। তাদের আলোচনা শুনলে মনে হয় তারা কোনো দিন বাসে যাতায়াত করেননি। বাসে যাতায়াত করলে বুঝতে পারতেন বেশির ভাগ দুর্ঘটনার কারণ ড্রাইভারদের বেপরোয়া গাড়ি চালানো। অন্য বাসের সাথে নানামুখী অশুভ প্রতিযোগিতাও অন্যতম কারণ। অথচ আমাদের দেশের বিজ্ঞ আলোচকেরা এসব বিষয় আলোচনায় আনেন না। রাস্তার স্বল্পতা, অপ্রশস্ততা, ভাঙাচোরা রাস্তা, আঁকাবাঁকা রাস্তা, প্রয়োজনীয় লেন না থাকা, লক্কড়ঝক্কড় মার্কা গাড়ি, ফিটনেসবিহীন গাড়ি, বিনা লাইসেন্সে গাড়ি চালানো ইত্যাকার বিষয়কে দুর্ঘটনার জন্য দায়ী করে আলোচনা করতে থাকেন। প্রকৃত অর্থে এগুলো দুর্ঘটনার জন্য এতটা দায়ী নয়, যতটা প্রচার করা হয়। যেমনÑ রাস্তার স্বল্পতা যানজটের জন্য দায়ী হতে পারে দুর্ঘটনার জন্য নয়। পৃথিবীর বহু দেশে রাস্তার স্বল্পতা আছে। অপ্রশস্ততার ক্ষেত্রেও একই কথা। ভাঙাচোরা রাস্তায় বরং ড্রাইভার সাবধানে গাড়ি চালান, যাতে কোনোরূপ দুর্ঘটনায় পড়তে না হয়। তবে আঁকাবাঁকা রাস্তা দুর্ঘটনার জন্য অনেকাংশে দায়ী।
এ ধরনের রাস্তায় অসাবধান হলেই দুর্ঘটনার সম্ভাবনা বাড়ে। তা ছাড়া নতুন ড্রাইভার যারা রাস্তার বাঁক সম্পর্কে অবহিত নন তাদের জন্য দুর্ঘটনার ঝুঁকি বেশি। রাস্তার লেনের স্বল্পতাও খুব বেশি দায়ী নয় দুর্ঘটনার জন্য। কোন লেন দিয়ে কোন ধরনের গাড়ি চলবে সে বিষয়ে চালক বা ড্রাইভারেরা অজ্ঞই বলা যায়। আবার যারা জানেন তারা কোনো নিয়ম মানেন না। যেদিক দিয়ে খুশি চালান। বাংলাদেশে তো আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে প্রভাবশালীরা জট এড়াতে রাস্তার উল্টা দিক দিয়েও গাড়ি চালান। অ্যাম্বুলেন্সগুলোতো হরহামেশাই এ কাজ করে। এ সব গাড়ির ড্রাইভারেরাই বরং দুর্ঘটনার অধিক ঝুঁকি সৃষ্টি করে থাকেন। এবার আসা যাক লক্কড়ঝক্কড় মার্কা গাড়ি এবং ফিটনেস প্রসঙ্গে। লক্কড়ঝক্কড় মার্কা গাড়ি কিংবা ফিটনেসবিহীন গাড়ি কি দুর্ঘটনার জন্য দায়ী? সম্ভবত না। কারণ গাড়ি যতই পুরান হোক না কেন ড্রাইভার কিংবা মালিক পক্ষ রাস্তায় চলাচলের যোগ্য করে তবেই গাড়ি নামান। আমার অন্তত এ ধরনের কোনো অভিজ্ঞতা নেই। দুর্ঘটনা তো দূরের কথা, রাস্তায় বিকল হয়ে পড়ে থাকতেও দেখা যায় না। যন্ত্রপাতির জন্য নতুন পুরাতন যেকোনো গাড়িই যেকোনো সময় বিকল হতে পারে। শুধু পুরাতন গাড়িই বিকল হবে এমন নয়। ফিটনেস তো নতুন পুরাতন সব গাড়ির জন্যই প্রযোজ্য। সুতরাং ফিটনেস থাকা না থাকার ওপর দুর্ঘটনা বা বিকল হওয়া নির্ভর করে না। ফিটনেস না থাকার অর্থ হচ্ছেÑ সরকারের প্রাপ্য অর্থ না দেয়া। এগুলো দেখার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের। ফিটনেস না থাকলেই গাড়ি দুর্ঘটনা ঘটাবে এমন নয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছেÑ তাহলে দুর্ঘটনা ঘটে কেন? উত্তরে বলা যায়Ñ দুর্ঘটনা ঘটে ড্রাইভার বা চালকের জন্য, অদক্ষ এবং অনভিজ্ঞ ড্রাইভারের জন্য। বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালানোর জন্য, ড্রাইভারের অসহিষ্ণু আচরণের জন্য। অশুভ প্রতিযোগিতার জন্য নিয়ম না মানার জন্য। অর্থাৎ মূলত দুর্ঘটনা ঘটে ড্রাইভার বা চালকের জন্য। অনেকের নিশ্চয়ই স্মরণে আছে এয়ারপোর্টের রাস্তায় যখন ডিভাইডার ছিল না তখন প্রায়ই দুর্ঘটনায় মানুষ প্রাণ হারাত। কারণ ওই ড্রাইভারদের অসহিষ্ণু ও অশুভ প্রতিযোগিতা। কোনো বাসস্ট্যান্ডের কাছাকাছি হলেই কে কার আগে গিয়ে স্ট্যান্ডে থাকা যাত্রী উঠাবে সেই প্রতিযোগিতায় মেতে উঠত ড্রাইভারেরা। ফলে সামনের বাস পেছনের বাসকে আগে যেতে দেবে না এবং পেছনের বাস সামনের বাসের আগে যাবেই এরূপ প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটাত। গতি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারায় এ ক্ষেত্রে কোনো কোনো বাস উল্টে রাস্তায় পড়ে যেত। ফলে মর্মান্তিক হতাহতের ঘটনা ঘটত। সে সময় এরূপ দুর্ঘটনা প্রায়ই ঘটত। দুর্ঘটনা ঘটার এটা এক ধরনের চিত্র। অন্য চিত্র হচ্ছেÑ যাত্রী উঠানো অবস্থায় আগে থেকে বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থাকা বাসের দরজা বন্ধ করে গা ঘেঁষে অন্য বাসের দাঁড়ানো। যাতে যাত্রী উঠানোরত বাস আর যাত্রী উঠাতে না পারে। ফলে আগে দাঁড়ানো বাসে ওঠার চেষ্টায়রত কোনো কোনো যাত্রী দুই বাসের মধ্যে পিষ্ট হয়ে আহত বা নিহত হতেন। আমার এক প্রতিবেশী এভাবেই পিষ্ট হয়ে এয়ারপোর্টে নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া আমার অফিসের বয়স্ক মালি আজিমপুর চৌরাস্তায় বাসে উঠতে গিয়ে দুই বাসের চাপায় পিষ্ট হয়ে দীর্ঘ দিন ভুগে চিকিৎসা শেষে সুস্থ হয়েছেন। এমন দুর্ঘটনা সারা দেশে অহরহই ঘটছে, যার খবর জানা যায় না। অথচ ড্রাইভারেরা এহেন অশুভ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত না হলে সহজেই অনাকাক্সিত এ ধরনের দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব।
সপ্তাহ তিনেক আগে আমি আজিমপুর থেকে গেটলক এক বাসে উঠেছি। বাসটি যখন বিশ্বরোডের সামনে তখন অন্য একটি বাস অভারটেক করতে গিয়ে আমাদের বাসে সামান্য ধাক্কা দিয়েছে। আর যায় কোথায়। আমাদের বাসের ড্রাইভার ধাক্কা দেয়া ওই বাসকে শায়েস্তা করার জন্য যেনতেন উপায়ে ওই বাসের গায়ে ধাক্কা দেয়ার চেষ্টা চালাতে লাগল। বেপরোয়া গাড়ি চালানোর ফলে যাত্রীরা ড্রাইভারকে সতর্ক করে সাবধানে গাড়ি চালাতে বললেন। কিন্তু ড্রাইভার নিবৃত হলো না। জসীমউদ্দীন রোডে গিয়ে সুযোগ পেয়ে এমনভাবে সেই বাসকে আমাদের বাস ধাক্কা মারল যে, অল্পের জন্য মারাত্মক দুর্ঘটনা থেকে আমরা রক্ষা পেলাম। যাত্রীরা প্রচণ্ড ুব্ধ হয়ে ড্রাইভারকে বকাঝকা করতে থাকলেন। রাস্তার ক্রসিংয়ে বাস থামলে কয়েকজন যাত্রী ড্রাইভারকে তার আসন থেকে টেনে হিঁচড়ে নামিয়ে কিলঘুষি মেরে রক্তাক্ত করে ফেললেন। ড্রাইভারের আর গাড়ি চালানোর অবস্থায় থাকল না। অগত্যা বাস থেকে নেমে হেঁটে গন্তব্যে যেতে হলো। ড্রাইভার অস্থিরচিত্ত না হলে অনাকাক্সিত এ ঘটনা ঘটত না।
এমন অবস্থা প্রায়ই ঘটতে দেখা যায়। এমনও দেখা যায় যাত্রী তোলার জন্য বাসস্ট্যান্ডে দীর্ঘ সময় ধরে দাঁড়িয়ে আছে। নড়ছে না। যাত্রীরা বিরক্ত হচ্ছেন, গাড়ি ছাড়তে বলছেন। ড্রাইভার কানেই তুলছেন না। তার ইচ্ছামতো যাত্রী তুলছেন এবং চালাচ্ছেন। অথচ যখন কোনো যাত্রী নির্দিষ্ট স্থানে নামতে চাইছেন তখন আর বাস থামাচ্ছেন না। চলন্ত বাস থেকেই নামিয়ে দিচ্ছেন। ধাক্কা দিয়ে নামানোর মতো। এভাবে নামতে গিয়েও অনেক যাত্রী রাস্তায় পড়ে আহত হচ্ছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাসের চাকায় পিষ্ট হয়ে হাত-পা খোয়াচ্ছেন এমন কি জীবন দিচ্ছেন। কিন্তু ড্রাইভারদের সে বিষয়ে কোনো সতর্কতা অবলম্বন করতে দেখা যায় না। তাদের অবহেলার জন্য আইনি ব্যবস্থা নিতেও দেখা যায় না। ফলে তারা আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠেন এবং যাত্রীদের ও আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখান। অথচ গাড়িচালক বাস ট্রাক বা অন্য কোনো যান চালক একটু সতর্ক হলে, ধীরস্থির হলে, সহিষ্ণু হলে এবং আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হলে দুর্ঘটনার মাত্রা অনেক কমে যেতে পারে।
দুর্ঘটনার ফলে যে, শুধু যাত্রীরাই মারা যান কিংবা ক্ষতিগ্রস্ত হন এমন নয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ড্রাইভার ও হেলপারেরাও মারা যান। এভাবে মৃত ব্যক্তিদের পরিবারই ধ্বংস হয়ে যায়। ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ক্ষতিগ্রস্ত হন বাস বা যানের মালিক পক্ষও। সুতরাং এ বিষয়গুলো স্মরণে রেখে সব পক্ষ সচেতন এবং ধৈর্যশীল হলে দুর্ঘটনার মাত্রা আপনা আপনিই কমে যাবে। দুর্ঘটনা কমানোর জন্য পুলিশ কিংবা আইন আদালতকে হয়রান পেরেশান হতে হবে না। বিদেশে রাস্তায় কোনো পুলিশকেই দেখা যায় না। অথচ আমাদের দেশে পুলিশ রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে প্রাণপণ চেষ্টা করেও রাস্তায় নিয়মশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে পারছে না। অথচ বিদেশে হাঁটা, যাত্রীসহ সবাই রাস্তার লাল, সবুজ এবং হলুদ বাতির নির্দেশ মেনে চলছে না। সবাই একটু সচেতন হলে, দায়িত্বশীল হলে আমরাও গর্ব করে বলতে পারব আমাদের দেশের যান এবং হেঁটে চলা সবাই লাল, সবুজ এবং হলুদ বাতির নির্দেশ মেনে চলেন। এ নির্দেশ পালন করার জন্য পুলিশকে হয়রান পেরেশান হতে হয় না। সবই চলে স্বাভাবিক নিয়মে।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/241199