জলাবদ্ধতার পর রাজধানীর সড়কের অবস্থা। মিরপুর ১ নম্বর এলাকার রাস্তা :আবদুল্লাহ আল বাপ্পী
২৯ জুলাই ২০১৭, শনিবার, ১০:৪৫

লণ্ডভণ্ড সড়ক

জলাবদ্ধতার খেসারত

রাজধানীতে জলাবদ্ধতার খেসারত দিচ্ছে সড়কগুলো। দীর্ঘদিন থেকেই ভেঙে থাকা সড়ক কয়েক দিনের বৃষ্টিতে ভেঙেচুরে তছনছ হয়ে গেছে। কোনো কোনো সড়কে পুকুরসদৃশ বড় বড় গর্ত তৈরি হয়েছে। এ ছাড়া সব সড়কই কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব ভাঙাচোরা সড়ক দিয়ে চলতে গিয়ে সব ধরনের যানবাহন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। প্রতিনিয়ত ঘটছে ছোটবড় দুর্ঘটনা। যানজটের অন্যতম কারণও এ সড়ক। সিটি করপোরেশন দু-একটি সড়কে ইটবালু ফেলে কোনো রকমে মেরামত করলেও বেশির ভাগ সড়কই মেরামতহীন থাকছে। এ কারণে নগরবাসীকে চরম দুর্ভোগের শিকার হতে হচ্ছে।
এ বছর আষাঢ়ের আগেই বৃষ্টিপাত শুরু হয়েছে। এরপর বর্ষা মওসুম আসতেই শুরু হয় টানা বৃষ্টিপাত। গত বুধবার স্মরণকালের সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে রাজধানীতে। এতে পুরো রাজধানী পানিতে তলিয়ে যায়। সব সড়কেই ছিল হাঁটু থেকে কোমর সমান পানি। কিছু সড়ক থেকে চার-পাঁচ ঘণ্টা পর পানি সরে গেলেও এখনো কিছু সড়কে পানি জমে রয়েছে। প্রকৌশলীদের মতে পিচের রাস্তার সবচেয়ে বড় শত্রু হলো পানি। এ কারণে পানি জমে অনেক সময় থাকায় বেশির ভাগ সড়কই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আগে যেসব সড়ক ভাঙাচোরা ছিল সেসব সড়কে আরো বড় বড় গর্ত তৈরি হয়েছে। আর যে সড়কে ছিল না সেখানেও গর্ত তৈরি হয়েছে। অনেক সড়ক এবড়োথেবড়ো হয়ে গেছে। কোনো কোনো সড়কে গাড়ি এমনকি পথচারীদের চলাচলও মুশকিল হয়ে গেছে।
কুড়িল বিশ্বরোড থেকে মালিবাগ পর্যন্ত প্রায় ১০ কিলোমিটার সড়ক পুরোটাই নষ্ট হয়ে গেছে। বসুন্ধরা সিটির সামনের মূল সড়কে বড় বড় গর্ত তৈরি হয়েছে। যমুনা সিটির সামনে থেকে নতুন বাজার পর্যন্ত সড়কের পূর্ব পাশে ড্রেনের ময়লা পরিষ্কার করে রাস্তায় রাখা হয়েছে। নতুন বাজার থেকে বাড্ডা পর্যন্ত সড়কের মাঝখানে চার ফুট খুঁড়ে ড্রেনের কাজ চলছে। আরেক পাশে মাটি খুঁড়ে রাস্তায় ফেলে রাখা হয়েছে। এ সড়কের রামপুরা ব্রিজ থেকে মালিবাগ পর্যন্ত অংশ গ্রামের রাস্তার চেয়েও খারাপ। বিটিভির সামনে রাস্তার পূর্ব পাশে ইট-বালু ও কংক্রিটের আবর্জনা ফেলে রাখা হয়েছে। অপর পাশে রাস্তা খুঁড়ে রাখা হয়েছে। আর মাঝখানে যে সরু পিচের রাস্তা রয়েছে তাতেও বড় বড় গর্ত তৈরি হয়ে এবড়োথেবড়ো হয়ে গেছে। হাজীপাড়া সিএনজি স্টেশনের সামনে আগে বড় গর্ত ছিল। সেখানে উত্তর সিটি করপোরেশন সম্প্রতি ইট দিয়ে কিছু অংশ ঠিক করেছে। এতে আগে যে জায়গায় পানি জমতো সেখানে আর পানি জমছে না। কিন্তু তার পাশেই পানি জমে থাকছে। এর আগে-পরের রাস্তাও ভেঙে পুরোপুরি তছনছ হয়ে গেছে। একেকটা গর্ত মনে হয় যেন একটা পুকুর। মালিবাগ চৌধুরী পাড়া ও মালিবাগ রেলগেটের আগের রাস্তায়ও বড় বড় গর্ত তৈরি হয়েছে। মালিবাগ চৌধুরী পাড়া আবুল হোটেলে সামনে থেকে খিলগাঁও পর্যন্ত বাইপাস সড়কে অসংখ্য ছোটবড় গর্ত তৈরি হওয়ায় সড়কটি দিয়ে যানবাহন চলাচল করতে হয় এঁকেবেঁকে।
বুধবারের বৃষ্টিতে হাঁটুপানি জমে যায় ধানমন্ডি মিরপুর সড়কে। এ সড়কের ২৭ নম্বর থেকে আসাদগেট পর্যন্ত অংশ ভেঙেচুরে গেছে। এ ছাড়া আসাদগেট থেকে কল্যাণপুর অংশের বিভিন্ন স্থানে ছোট বড় গর্ত তৈরি হয়েছে। কল্যাণপুর থেকে গাবতলী পর্যন্ত সড়কটির অবস্থা আরো ভয়াবহ। বিভিন্নস্থানে অসংখ্য বড় বড় গর্ত তৈরি হয়েছে। অনেক স্থানে রাস্তার অর্ধেকজুড়েই বড় গর্ত। এ সড়ক দিয়ে সব সময় দূরপাল্লার যানবাহন চলাচল করে। এ ছাড়া বিভিন্ন রুটের অসংখ্য গণপরিবহন চলাচল করে এ সড়ক দিয়ে। ফলে ব্যাপক ভোগান্তির শিকার হতে হয় যাত্রীদের। ভাঙা সড়ক দিয়ে গাড়ি চলার সময় এত ঝাঁকি লাগে যে যাত্রীদের শরীর ব্যথা হয়ে যায়।
সাতরাস্তা থেকে মহাখালী সড়কটির অবস্থাও খুবই শোচনীয়। বিশেষ করে মহাখালী বাস টার্মিনাল ও নাবিস্কো এলাকার রাস্তার অবস্থা অত্যন্ত করুণ।
মতিঝিল থেকে কমলাপুরগামী টয়নবী সার্কুলার রোডের চৌরাস্তার মোড়ে রাস্তা ভেঙে বড় বড় গর্ত তৈরি হয়েছে। সাদেক হোসেন খোকা কমিউনিটি সেন্টারের সামনে তৈরি হয়েছে অসংখ্য গর্ত। টিটিপাড়া থেকে খিলগাঁও ফাইওভারগামী বিশ্বরোডে দীর্ঘদিন থেকেই অসংখ্য খানাখন্দ তৈরি হয়েছে। পিচ উঠে বড় বড় গর্ত তৈরি হয়েছে। সাম্প্রতিক বৃষ্টির কারণে অবস্থার আরো অবনতি হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার দক্ষিণ সিটি করপোরেশন সেখানের কিছু বড় গর্তে ইট-বালু ফেললেও অবস্থার খুব বেশি উন্নতি হয়নি। খিলগাঁও ফাইওভার থেকে মালিবাগ রেলগেটগামী সড়কেও অসংখ্য বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। খিলগাঁও ফাইওভার থেকে বাসাবো হয়ে নন্দীপাড়া পর্যন্ত সড়ক চলাচলের প্রায় অনুপযুক্ত হয়ে গেছে। অসংখ্য ছোট বড় গর্ত দিয়ে চলতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে যেতে হচ্ছে যাত্রীদের। বৃষ্টি হলে এ সড়কের বিভিন্ন স্থানে পানি জমে যায়। বাসাবো ওয়াসা রোডের অবস্থাও শোচনীয়। বিভিন্ন স্থানে পানি জমে বড় বড় গর্ত তৈরি হয়েছে। আবার অনেক স্থানে রাস্তা দেবে গর্ত তৈরি হয়েছে। উত্তর গোড়ান, সিপাহিবাগ, মুগদা, মাণ্ডাসহ আশপাশের এলাকার সড়কগুলোর অবস্থা খুবই নাজুক। কোথাও রাস্তায় বড় গর্ত আবার কোথাও পানি জমে রয়েছে। বৃষ্টি হলেই গুলিস্তান থেকে বঙ্গভবনগামী সড়কের হানিফ ফাইওভারের নিচের রাস্তায় হাঁটুপানি জমে যায়। এ কারণে ওই সড়কটিও ভেঙেচুরে গেছে।
রামপুরা ব্রিজ থেকে ডেমরাগামী সড়কের মেরাদিয়া বাজার পর্যন্ত অংশ ভেঙেচুরে একাকার গেছে। মালবাহী ভারী গাড়ি চলার কারণে সড়কের সিটি করপোরেশন অংশে বড় বড় গর্ত তৈরি হয়েছে। বৃষ্টি হলেই এসব গর্তে পানি জমে যাচ্ছে। এতে ওই সড়কে চলাচলকারী যানবাহন প্রায়ই দুর্ঘটনায় পড়ছে। গত বুধবারের বৃষ্টিতে মিরপুর-১০ থেকে শ্যাওড়াপাড়া অংশ পানিতে তলিয়ে যায়। কাজীপাড়া অংশে এ পানি এখনো কিছুটা রয়েছে। এ সড়কে মেট্রোরেলের কাজের জন্য রাস্তার দ্ইু পাশে বড় নালা খুঁড়ে রাখা হয়েছে। এ ছাড়া রাস্তার মাঝেও ছোট বড় গর্ত তৈরি হয়েছে। এতে ওই সড়কে দিনরাত যানজট লেগেই থাকছে।
আসাদগেট এলাকার বাসিন্দা রবিউল ইসলাম বলেন, এবারের বর্ষা মওসুমে ধানমন্ডি এলাকার সড়কে জলাবদ্ধতার কারণে মিরপুর মূল সড়কের বড় বড় গর্ত তৈরি হয়েছে। প্রধান কয়েকটি সড়কসহ এলাকার অলিগলির সড়কও ভেঙেচুরে একাকার হয়ে গেছে। খানাখন্দ সৃৃষ্টি হয়েছে। সম্প্রতি সিটি করপোরেশন এসব সড়ক সংস্কার করলেও জলাবদ্ধতার কারণে আবারো তা ভেঙে গেছে।
রামপুরার বাসিন্দা কামাল উদ্দিন বলেন, প্রতিদিন রামপুরা, খিলগাঁও হয়ে যাত্রাবাড়ী অফিসে যায়। দৈনিক যাতায়াতের এ সড়কে এবারের বর্ষায় বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। ব্যক্তিগত গাড়িতে চলাচল করলেও একটু পরপর গর্তের কারণে পুরো শরীর ব্যথা হয়ে যায়। সিটি করপোরেশন প্রতি বছর সড়ক সংস্কার করে, আবার এসব সড়ক ভেঙেচুরে একাকার হয়ে যায়।
কুড়িল ফাইওভারের সড়কেও গর্ত : বৃষ্টিতে বিভিন্ন সড়কের পাশাপাশি কুড়িল ফাইওভারের সড়কও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গতকাল দেখা যায়, ওই ফাইওভারের বিভিন্ন লেনে প্রায় শতাধিক ছোট গর্ত তৈরি হয়েছে। পিচ ঢলাই উঠে এসব গর্ত তৈরি হয়েছে। এতে যেকোনো সময় দুর্ঘটনার আশঙ্কা করছেন চালকেরা।
রাজধানীর সড়কগুলো এভাবে ভেঙেচুরে গেলেও মেরামতে কার্যকর কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না দুই সিটি করপোরেশনের। বৃষ্টির পানি জমে তিগ্রস্ত সড়কগুলো সাময়িকভাবে ইট, বালু, খোয়া দিয়ে সংস্কার করা হচ্ছে। সাময়িক সংস্কার করা এসব সড়ক উঁচু-নিচু হওয়ায় পরিবহন চলাচলে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তা ছাড়া সংস্কার করা এসব খানাখন্দ বেশি দিন টিকছেও না। ফলে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের এসব সড়ক কিছু দিন পরপর সংস্কার করতে হচ্ছে।
ঢাকা দণি সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী ও সড়ক উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক মো: আসাদুজ্জামান নয়া দিগন্তকে বলেন, বৃষ্টির কারণে কিছু রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখনো বৃষ্টি মওসুম চলায় ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তার সঠিক পরিসংখ্যন তৈরি করা সম্ভব হয়নি। তবে যে রাস্তাগুলো অনেক আগে মেরামত করা সেগুলোই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে তিনি জানান। যেসব রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেগুলো মেরামত করা হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, ইট-বালু দিয়ে ভরাট ছাড়াও মিক্স ম্যাটেরিয়াল দিয়ে ঢালাই করা হচ্ছে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন নয়া দিগন্তকে বলেন, অতিবৃষ্টি ছাড়াও ভারী যানবাহন চলাচলের কারণে রাস্তা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ঢাকার রাস্তা ৫ থেকে ১০ টনের গাড়ি চলাচলের উপযুক্ত হলেও ৪০ থেকে ৫০ টনের গাড়িও চলাচল করছে। এ কারণে রাস্তা দ্রুত নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী কুদরত উল্লাহ নয়া দিগন্তকে বলেন, বর্তমানে বৃষ্টির মওসুম চলছে। এ কারণে স্থায়ীভাবে মেরামত করা যাচ্ছে না। তবে যেসব রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেগুলো সাময়িকভাবে ইট-বালুর খোয়া দিয়ে ভর্তি করে দেয়া হচ্ছে। বর্ষাকাল শেষ হলে তারপর স্থায়ীভাবে সড়ক মেরামত করা হবে। তিনি আরো বলেন, রামপুরা সড়কে ঢাকা ওয়াসা খোঁড়াখুঁড়ি করছে, তাদের কাজ শেষ না হলে আমরা কাজ করতে পারছি না। এ সড়কে আমাদের আগেই প্রকল্প নেয়া হয়েছে। আগামী তিন মাসের মধ্যে এ সড়ক ভালো হয়ে যাবে। একইভাবে ধানমন্ডির রাপা প্লাজা থেকে গাবতলী পর্যন্ত সড়ক উন্নয়নের জন্য প্রকল্প তৈরি করে ঠিকাদার নিয়োগ করা হয়েছে জানিয়ে কুদরতউল্লাহ বলেন, বৃষ্টি মওসুম শেষ হলেই এ সড়কে কাজ শুরু হবে।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/239662