২৯ জুলাই ২০১৭, শনিবার, ১০:৪২

প্রযুক্তির আসক্তিও ফল বিপর্যয়ের কারণ

এইচএসসির ফল ২০১৭

বুলবুলের ফুফাত ভাই সেলিমের ছেলে এবার এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয়। পরীক্ষার ফল প্রকাশের দিন বুলবুল সেলিমকে ফোন দেন রেজাল্ট জানতে কিন্তু সেলিম ফোন ধরেন না। বুলবুল বুঝে নেন হয়তো তার ছেলে রেজাল্ট খারাপ করেছে সে কারণে ফোন ধরছেন না। কিন্তু বুলবুল ধারণাও করতে পারেননি ফল এত খারাপ হবে। ফল প্রকাশের দুই দিন পর বুলবুল আবার ফোন করলে সেলিম জানান, তার ছেলে ফেল করেছে। বুলবুল বিস্ময়ের সাথে এর কারণ জানতে চায়। সেলিম তাকে তীব্র ক্ষোভের সাথে জানান, আরে বলিস না। সারা দিন মোবাইল, ফেসবুক, ইন্টারনেট, টিভি, খেলা আর বন্ধুবান্ধব এসব নিয়ে থাকত। আমি তো আর অত লক্ষ্য করতে পারিনি। ব্যবসায়পাতি নিয়ে আছি। এখন শুনি সে ঠিকমত কাসও করেনি। অথচ তুই বল, আমাদের কি কোনো সমস্যা আছে? তার তো পড়াশুনা ছাড়া আর কোনো কাজ ছিল না। তাহলে সারা বছর সে কী করেছে? এখন তার নামে যেসব বিষয় জানতে পারছি তা বলার মতো নয়। ছেলেটা মনে হচ্ছে নষ্ট হয়ে গেছে। তোর ভাবীকেও মানত না।
সেলিম দুঃখের সাথে বুলবুলকে জানান, ছেলের কারণে লজ্জায় মুখ দেখাতে পারছি না। ছেলে ফেল করবে এটা তো কল্পনাও করতে পারিনি।
বুলবুল এ প্রতিবেদককে জানান, সেলিমের ছেলের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট চেক করে যেসব পোস্ট দেখতে পেয়েছেন তাতে তিনিও বিস্মিত। কি সব আবোল তাবোল লেখা তার কোনো আগামাথা তিনিও ধরতে পারেননি। এ ছাড়া রয়েছে অনেক আপত্তিকর বিষয়। তিনি বলেন, ছেলেমেয়েরা এসব কী লিখছে আর কীই বা বিনিময় করছে কিছু বুঝে আসে না। তাদের ভাষা, কথাবার্তা, ছবি দেখে সুস্থ স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না অনেককে। অথবা পরিবর্তনটা খুব বেশি হয়ে গেছে, যার সাথে আমরা তাল মেলাতে পারছি না। আমরা ঠিক না তারা ঠি ক কোনটা যে সঠিক তা নিয়ে আমি নিজেও মাঝে মধ্যে হতবুদ্ধি হয়ে যাই। আমাদের চিন্তাভাবনা তো এ রকম ছিল না। আমরাও তো এ বয়স পার করে এসেছি।
ছেলেমেয়েদের প্রযুক্তি আসক্তি এবং এর সাথে সর্বশেষ প্রকাশিত এইচএসসির ফল বিপর্যয়ের কোনো সম্পর্ক আছে কিÑ না জানতে চাইলে শিক্ষক অভিভাবকেরা যা বলেছেন তা উদ্বেগজনক। গ্রামের একজন অভিভাবক জানান, তার ছেলে জেলা শহরের ভালো একটি কলেজে পড়েছে। শহরে মেস ভাড়া করে থেকেছে। প্রতি মাসে নিয়মিত টাকা পাঠানো হয়েছে। কখনো কোনো সমস্যায় রাখা হয়নি তাকে। যখন যে প্রয়োজনের কথা জানিয়েছে, সাথে সাথে পূরণ করেছি। কিন্তু এরপরও সে কোনো মতে পাস করেছে। অথচ এসএসসিতে সে জিপিএ ৫ পেয়েছিল। খারাপ ফলের জন্য ছেলেকে দোষী সাব্যস্ত করে অনুতপ্ত এ অভিভাবক জানান, তার বন্ধুবান্ধবদের কাছে খোঁজ নিয়ে জেনেছি, আসলে সে ঠিকমতো পড়াশুনা করেনি। বন্ধুবান্ধব নিয়ে আড্ডা আর মোবাইল ইন্টারনেট নিয়ে সে বেশির ভাগ সময় ব্যস্ত থাকত। নিয়মিত খেলা দেখত। তাকে দূরে রাখা ঠিক হয়নি। এর চেয়ে বাড়িতে থেকে গ্রামের কলেজ পড়লেই মনে হয় ভালো হতো। মোবাইল আর ইন্টারনেট আসক্তিই তার সর্বনাশ করেছে বলে মনে হচ্ছে।
অনেক শিক্ষক অভিভাবক জানিয়েছেন, তাদের মতে অনেকের ফল খারাপের পেছনে রয়েছে প্রযুক্তি আসক্তি। মোবাইল ইন্টারনেট আর টিভির প্রতি অতিরিক্ত আসক্তি অনেকের বড় ধরনের সর্বনাশের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মনে করেন তারা। ফলে ছেলেমেয়ের চাহিদামতো মোবাইল, ল্যাপটপ, আইপ্যাড কিনে দিয়ে অনেকে এখন হায় হায় করছেন।
মোবাইল, ইন্টারনেট, ফেসবুক, ইনস্টগ্রামসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, টিভিতে প্রচারিত খেলা, টিভি নাটক, সিনেমা ছেলেমেয়েদের প্রচুর সময় কেড়ে নিচ্ছে বলে জানিয়েছেন অনেকে। মোবাইল আর ফেসবুকের কারণে ছেলেমেয়েদের গড়ে উঠেছে বন্ধুত্বের বিশাল জগত। তাদের সাথে সম্পর্ক রক্ষা, যোগাযোগ করা প্রভৃতি কারণে অনেক সময় ব্যয় করতে হয়। অনেকের পড়াশুনায় কোনো মনোযোগ নেই। ইন্টারনেট, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সূত্র ধরে অনেকে জড়িয়ে পড়ছে নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে। অনেকে জড়িয়েছে নানা ধরনের অসামাজিকতায়। অনেকে হয়ে পড়ছে মাদকাসক্ত। নষ্ট হচ্ছে অনেকের জীবন। কেউ কেউ জড়িয়ে পড়ছে ত্রিমুখী, চতুর্মুখী প্রেম পরকীয়ার সম্পর্কে। এ নিয়ে বন্ধুবান্ধবের মধ্যেও অনেক সময় ঘটছে সঙ্ঘাত হানাহানি। এসবের রেশ ধরে ঘটছে নানা অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা। ঘটছে আত্মহত্যা ও খুনের মতো চাঞ্চল্যকর ঘটনা। মোবাইল ইন্টারনেট আর ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগের সূত্র ধরে এইচএসসি পড়–য়া কোনো কোনো শিক্ষার্থীও জড়িয়ে পড়েছে প্রেম পরকীয়া এমনকি খুনের মতো ঘটনায়।
সম্প্রতি রাজধানীর মিরপুর ১০ নম্বর সেকশনে এ ধরনের একটি চাঞ্চল্যকর খুনের ঘটনা ঘটে। দুই সন্তানের জননী লাভলী বেগমের সাথে পরকীয়ার সম্পর্ক হয় নৌবাহিনী কলেজের একাদশ শ্রেণীর ছাত্র তানভির আহমেদের। একপর্যায়ে লাভলী তানভিরকে দিয়ে স্বামীকে খুন করায়। লাভলীর স্বামীকে খুন করতে তানভিরকে সহায়তা করে তার অপর দুই বন্ধু সাদমান ও জিসান। সাদমান ঢাকা কমার্স কলেজে আর জিসান সরকারি বিজ্ঞান কলেজের একাদশ শ্রেণীর ছাত্র। লাভলীর সাথে তানভিরের পরিচয় হয়েছিল মোবাইলে। এ ছাড়া কয়েক দিন আগে মেধাবী এক তরুণ গ্রেফতার হয়েছে ফেসবুকে এক মহিলাকে প্রতারণার কারণে।
অনেকে জানিয়েছেন, তাদের কোনো কোনো ছেলেমেয়ে বাথরুমেও মোবাইল নিয়ে যায়। মোবাইল থেকে তারা মুহূর্তের জন্যও বিচ্ছিন্ন হয় না। তাদের প্রযুক্তি আসক্তি এতটা, মনে হয় মোবাইল ফেসবুক ছাড়া তারা বাঁচবে না। এটাই তাদের জীবন।
শিক্ষক-অভিভাবকেরা জানান, মোবাইল, ল্যাপটপ, কম্পিউটার, টিভি, ইন্টারনেটে সময় কাটানোর এখন রয়েছে হাজারো উপাদান। মোবাইল ইন্টারনেট এখন অনেকের জন্য নেশায় পরিণত হয়েছে। কখনো ফেসবুক, কখনো গেম, কখনো ভিডিও কথাবার্তা, কখনো খেলা। অনেকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পার করছে খারাপ ভিডিও দেখে।
একজন অভিভাবক জানান, তার ছেলের রয়েছে খেলা দেখার নেশা। সারা বছর থাকে কোনো-না-কোনো খেলা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এ অভিভাবক বলেন, খেলা মাঝে মাঝে আমিও দেখি। বিশেষ করে বাংলাদেশের সাথে বিদেশের যখন খেলা হয় তখন দেখি। কিন্তু আমার ছেলে সারা বছর কী সব খেলা দেখে। দেশের সব ঘরোয়া আয়োজন এমনকি বিদেশের নানা ধরনের ঘরোয়া খেলাও দেখে। এসব দেখার কোনো মানে আছে বলে মনে হয় না। কিন্তু টিভিতে এখন অনেক দেশের ঘরোয়া খেলাও প্রচার করে এবং অনেকে প্রচুর সময় ব্যয় করে এসব খেলা দেখে।
অনেকে জানিয়েছেন খেলার সাথে ভয়ঙ্কর আকারে ছড়িয়ে পড়েছে জুয়া। এমনকি ছোটখাটো কাব পর্যায়ের খেলা নিয়েও এখন জমে উঠে জুয়া। এর সাথে জড়িয়ে পড়ছে অনেক কিশোর ও তরুণ।
মোবাইল, কম্পিউটারের পাশপাশি টিভি নাটক, সিনেমা, নাচ গানের প্রতিও আসক্ত হয়ে পড়েছে অনেক শিক্ষার্থী। অনেকের বাসায় পড়াশুনার উপযুক্ত পরিবেশ নেই বলেও জানা গেছে। সব সময় বাসার কেউ না কেউ কোনো না কোনো অনুষ্ঠান দেখে। কেউ নাটক, কেউ সিনেমা, কেউ নাচ গান আর কেউ বা দেখে খেলা। এসব মনোযোগ নষ্ট করছে অনেক শিক্ষার্থীর।
গ্রামের একটি সরকারি কলেজের একজন শিক্ষক জানান, ২৫ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী কাসে আসে না। পড়াশুনায় তাদের কোনো মনোযোগ নেই। বইয়ের সাথে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই। পড়াশুনার ধরন সম্পর্কে কিছু জানে না। অনেকে আছে ভর্তি হওয়ার পর সারা বছর কাস না করে শুধু পরীক্ষা দেয়। তারা ফেল করবে না তো করবে কী? শতকরা ৭০ দিন কাসে উপস্থিত থাকার নিয়ম থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এ শিক্ষক বলেন, তুলনামূলক কম হলেও গ্রামেও ছড়িয়ে পড়েছে প্রযুক্তির কুফল। অনেকের মনোযোগ নষ্টের পেছনে দায়ী মোবাইল ফেসবুকসহ ইন্টারনেট প্রযুক্তি।
যশোর অঞ্চলের নামকরা একটি কলেজের এক শিক্ষক জানান, এখন ছেলেমেয়েদের পড়ার সময় কই। সারা দিন তো তারা আছে মোবাইল ফেসবুক নিয়ে। তিনি বলেন, এচএসসি পর্যন্ত ছেলেমেয়েদের কোনো অবস্থায়ই স্মার্ট ফোন, অ্যান্ড্রয়েট জাতীয় ফোন দেয়া উচিত নয়। ছেলে মেয়েদের এসব থেকে অবশ্যই দূরে রাখা উচিত অভিভাবকদের।
আরেকজন শিক্ষক জানান, এ বয়সে যেসব ছেলেমেয়েকে ইন্টারনেট আর ফেসবুকের নেশায় পেয়েছে তার জীবন শেষ।
প্রযুক্তির যে জোয়ার চলছে তাতে ছেলেমেয়েদের এসব থেকে কিভাবে দূরে রাখবেন তা নিয়ে চিন্তিত অনেক অভিভাবক।
প্রযুক্তির প্রভাব আর প্রসারে সঙ্গদোষের সব উপাদান এখন ছেলেমেয়েদের হাতের মুঠোয় চলে এসেছে। সচেতন বা অচেতনে মা-বাবাই সন্তানদের হাতে তুলে দিচ্ছেন মাল্টিমিডিয়া মোবাইল, স্মার্টফোন, প্যাড, আইপড, কম্পিউটার, ল্যাপটপ ও ইন্টারনেট সংযোগ। এসবের বদৌলতে বেশির ভাগ শিক্ষার্থীর হাতের মুঠোয় এখন অশ্লীল নাচগান এবং রাজ্যের সব পর্নো ভিডিওর সমাহার। কাসে বসেও পর্নোগ্রাফি দেখার ভয়ানক খবর বেরিয়েছে। গ্রামেও শিক্ষার্থীরা কাস ফাঁকি দিয়ে আড়ালে আবডালে বসে মোবাইলে খারাপ ভিডিও দেখার খবর বেরোচ্ছে নিয়মিত। ধ্বংসাত্মক পরিণতি জানার পর অনেক মা বাবা আছড়ে ভাঙছেন সন্তানের মোবাইল।


http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/239653