বাড়িতে পানি উঠে গেছে। ঘরের জিনিসপত্র কলাগাছের ভেলায় নিয়ে নিরাপদ স্থানে ছুটছেন এক নারী। যশোরের কেশবপুরের মধ্যকুল গ্রাম থেকে শুক্রবার তোলা ছবি -যুগান্তর
২৯ জুলাই ২০১৭, শনিবার, ১০:৪০

ভবদহে আবার কান্না

কয়েক দিনের টানা বর্ষণে ১২০ গ্রামের মানুষ পানিবন্দি * ডুবে গেছে ফসলি জমি মাছের খামার

কয়েক দিনের টানা বর্ষণে বাড়ির উঠোনে হাঁটুপানি। তাই বাধ্য হয়ে বাড়ির পাশের যশোর-কেশবপুর সড়কের ওপর খুপরি ঘর তুলে পরিবার নিয়ে বসবাস করছেন মনোয়ারা বেগম। তিনি কেশবপুর উপজেলার মধ্যকূল গ্রামের বাসিন্দা। জলাবদ্ধতার কারণে গত বছরও তিনি পরিবার নিয়ে আড়াই মাস এই রাস্তায় কাটান। এবার কতদিন থাকতে হবে সেটি তিনি জানেন না। উদ্বিগ্ন মনোয়ারা বেগম জানান, হাবাসপুর, মধ্যকূল গ্রাম পানিতে ভেসে গেছে। দিন দিন পানি আরও বাড়ছে। পানিতে থাকতে থাকতে পা চুলকে ঘা হয়েছে। খাবার পানির অভাব। ছেলেমেয়েরা স্কুলে যেতে পারছে না। ঠিকমতো তিন বেলা খাবারও জুটছে না। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একই গ্রামের রূপালী বেগম বলেন, ‘পানিতে ডুবে মরছি। কেউ দেখার নেই। কেউ কোনো সহযোগিতাও করছে না। আপনারা আমাদের বাঁচান।’ বাড়িতে পানি জামায় রূপালী বেগমও ওই রাস্তায় আশ্রয় নিয়েছেন।


শুধু মনোয়ারা বেগম কিংবা রূপালী বেগম নন, যশোরের মনিরামপুর, কেশবপুর ও অভয়নগর উপজেলার ১২০টির অধিক গ্রামের পানিবন্দি মানুষের আর্তনাদ এটি।

গত বছরের মতো এবারও ভবদহ অঞ্চলে স্থায়ী জলাবদ্ধতার আশঙ্কায় রয়েছেন স্থানীয়রা। প্রতি বছর জলাবদ্ধতা হাজার হাজার মানুষের দুর্ভোগ বয়ে আনলেও নেই কোনো কার্যকর পদক্ষেপ। জোড়াতালি প্রকল্পে কোটি কোটি টাকা ব্যয় হলেও কাজের কাজ কিছু হয়নি। ফলে ফিরে ফিরে আসছে ভবদহের মানুষের দুঃখ। জলাবদ্ধতার শিকার যশোরের অভয়নগর উপজেলার ডহের মশিহাটি গ্রামের সুবোধ মণ্ডল বলেন, ‘প্রতি বছর ভারি বৃষ্টি হলেই দুর্ভোগের সীমা থাকে না। সবকিছু ডুবে যায়। আমাদের রক্ষার আশ্বাস দিলেও বাস্তবায়ন হয় না।’ স্থানীয় ইউপি মেম্বর মৃত্যুঞ্জয় বিশ্বাস জানান, তার ওয়ার্ডের অধিকাংশ মানুষ পানিবন্দি। মাছের ঘের বাড়ি-ঘরের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

গোবিন্দপুর গ্রামের বাসিন্দা ভদ্রকান্তি বিশ্বাস বলেন, ‘বাড়িতে পানি উঠেছে। এজন্য টিন খুলে এনে পাশে উঁচু ভিটেয় ছাপড়া ঘর করে পরিবার নিয়ে বসবাস করছি। কতদিন থাকতে হবে জানি না।’ জানতে চাইলে ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির ভারপ্রাপ্ত সদস্য সচিব চৈতন্য পাল বলেন, ‘মুক্তেশ্বরী টেকা, হরি ও শ্রী নদীতে পলি জমে তলদেশ উঁচু হয়েছে। নদীগুলোর পলি অপসারণে কোনো পদক্ষেপ নেই। একই সঙ্গে টাইডাল রিভার ম্যানেজমেন্ট (টিআরএম) বাস্তবায়নের কোনো উদ্যোগ নেই। ফলে ভবদহ অঞ্চলে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘জলাবদ্ধতা নিরসনে নদীগুলোর পলি অপসারণ, বিল কপালিয়ায় টিআরএম চালু ও অবৈধ মাছের ঘের উচ্ছেদ করতে হবে।’

জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তার কার্যালয়ের তথ্যমতে, গত বছর টানা আড়াই মাসের জলাবদ্ধতায় মনিরামপুর, কেশবপুর ও অভয়নগর উপজেলার ১৮২টি গ্রামের দুই লাখ ৬৭ হাজার ৫১১ জন মানুষ পানিবন্দি হয়। জলাবদ্ধতায় ৫৩ কোটি টাকার বাড়িঘর, ১৮ কোটি টাকার মৎস্য, ১৪৪ কোটি টাকার ফসল নষ্ট হয়। এ ছাড়া ২৯৪টি স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সড়ক ও জনপথ বিভাগের ১২ কোটি, এলজিইডির ৭৩ কোটি ৬৭ লাখ টাকার সড়ক নষ্ট হয়। সাপের কামড়ে ১০ জনের মৃত্যু হয়। সব মিলিয়ে ক্ষতি হয় প্রায় এক হাজার কোটি টাকা। গত বছরের জলাবদ্ধতার ক্ষত শুকিয়ে উঠতে পারেনি ভবদহ অঞ্চলের মানুষ। কিন্তু বছর না ঘুরতেই আবারও জলাবদ্ধতার শিকার হল এখানকার হাজার হাজার মানুষ। কয়েক দিনের টানা বর্ষণে মনিরামপুর, অভয়নগর ও কেশবপুর উপজেলার ২২টি ইউনিয়নের ১২০ গ্রামের প্রায় অর্ধ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

ভারপ্রাপ্ত জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আনিসুর রহমান জানান, কয়েক দিনের টানা বর্ষণে তিন উপজেলায় ৭০০ হেক্টর ফসলি জমি ও ৯০০ হেক্টর মৎস্য খামার তালিয়ে গেছে। এ ছাড়াও ২০ কিলোমিটার কাঁচাপাকা রাস্তা, ৩৭৪টি কাঁচাপাকা বাড়িঘর, ২০০ গাছপালা, ২৭টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়বে। জানতে চাইলে যশোর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী প্রবীর কুমার গোস্বামী বলেন, ‘ভবদহের জলাবদ্ধতা নিরসনে এক কোটি টাকা ব্যয়ে আট কিলোমিটার নদী খনন প্রকল্প চলমান রয়েছে। আগামী আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাস নাগাদ প্রকল্প শেষ হবে। নদীগুলোর অবস্থা এখন অনেক ভালো। গত বছরের মতো অবস্থায় নেই। ভারি বর্ষণ ও অমাবস্যার প্রভাবে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। আশা করছি এবার স্থায়ী জলাবদ্ধতা হবে না। সাত দিনের মধ্যে পানি সহনীয় হবে।’ তিনি জানান, সমস্যার স্থায়ী সমাধানে ইতিমধ্যে স্ট্যাডি শেষ হয়েছে। এক মাসের মধ্যে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে প্রকল্প উপস্থাপন করা হবে। স্ট্যাডিতে বিল কপালিয়াসহ ছয়টি টিআরএম বাস্তবায়নের সুপারিশ করা হয়েছে। এ ছাড়াও নদী ও খাল খননের সুপারিশ আছে। একনেকে প্রকল্পটি পাস হওয়ার পর তা বাস্তবায়ন হলে ভবদহ সমস্যার স্থায়ী সমাধান হবে।

 

http://www.jugantor.com/last-page/2017/07/29/143662/