২৯ জুলাই ২০১৭, শনিবার, ১০:৩৮

খসে পড়ছে পলেস্তারা, ভেঙে পড়েছে বিদ্যুতের খুঁটি

এক বছর যেতে না যেতেই খসে পড়তে শুরু করেছে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের নতুন ভবনের পলেস্তারা। একটু বৃষ্টি হলেই ভবনের ভেতরের দেয়াল ভিজে স্যাঁতসেঁতে হয়ে ওঠে। কয়েকটি ভবনের দরজা-জানালা বেঁকে গেছে। ভেঙে পড়ছে বিদ্যুতের খুঁটিও।
এই পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন কারা প্রশাসন। কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ ইফতেখার উদ্দীন প্রথম আলোকে বলেন, ভবনগুলো ব্যবহার করতে গিয়ে দেখা গেছে নির্মাণকাজ খুবই নিম্নমানের। অবকাঠামোগত ত্রুটি বন্দীদের নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
১৫ জুলাই এই প্রতিবেদক কারাগারে গেলে সেখানকার কর্মকর্তারা স্পর্শকাতর নয়, এমন স্থান ঘুরিয়ে দেখান। দেখা যায়, প্রশাসনিক ভবনের দেয়ালের পলেস্তারা খসে পড়ায় সেখানে নতুন করে সিমেন্টের আস্তর দেওয়া হয়েছে। একই অবস্থা বন্দীদের বসবাসের তিনটি ভবন ও কারারক্ষীদের একটি ব্যারাকেরও।
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জ্যেষ্ঠ কারা তত্ত্বাবধায়ক মো. জাহাঙ্গীর কবির প্রথম আলোকে বলেন, পাঁচটি ভবনের খসে পড়া পলেস্তারা এবং মূল দেয়ালের বিভিন্ন স্থানে ফাটলের জায়গায় আস্তর দেওয়া হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, বৃষ্টি হলেই ভবনের দেয়াল ভেতর থেকে ভিজে ওঠে। কারারক্ষী ব্যারাকের জানালা ভেঙে পড়েছিল, সেগুলো মেরামত করা হয়েছে। মাস দুয়েক আগে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তিনটি আবাসিক ভবনে ঢোকার তিনটি লোহার গেট ভেঙে পড়েছিল। সেগুলো গণপূর্ত অধিদপ্তর মেরামত করে দিয়েছে। নির্মাণে নিম্নমানের উপকরণ ব্যবহার করায় বন্দীদের দুটি ভবন এখনো বুঝে নেওয়া হয়নি।
কারা কর্মকর্তারা বলেন, বন্দীদের দুটি ভবনের জানালা-দরজা ঠিকমতো লাগানো যায় না। কিছু দরজা বাঁকা হয়ে গেছে। ফাঁসির মঞ্চে ওঠার সিঁড়ি এত খাড়া ও অপ্রশস্ত যে তার ওপরে ওঠা যায় না। বন্দীদের সাক্ষাৎকার ঘর খুবই অপ্রশস্ত। সেখানে একসঙ্গে একাধিক ব্যক্তি কথা বলতে থাকলে তা ঠিকমতো শোনা যায় না। নিরাপত্তার জন্য কারাগার চত্বরে ২৬০টি বৈদ্যুতিক খুঁটি আছে। গত ৩ এপ্রিল সামান্য ঝোড়ো বাতাসে সাতটি খুঁটি ভেঙে পড়ে। এর আগেও তিনটি খুঁটি পড়ে যায়। আবার ভেঙে পড়া খুঁটিগুলো বদলে যেসব খুঁটি বসানো হয়েছে, সেগুলোও নিম্নমানের। অল্প দিনেই এতে জং ধরেছে। কয়েকটি খুঁটি লোহার পাইপ দিয়ে ঠেকা দিয়ে রাখা হয়েছে।
অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক কর্নেল ইকবাল হাসান ৫ এপ্রিল স্বরাষ্ট্র ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়ে উন্নত মানের খুঁটি বসাতে বললেও তা করা হয়নি। ওই চিঠিতে বলা হয়, এ অবস্থায় প্রাণহানিসহ বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কা আছে, নিরাপত্তাঝুঁকি তো আছেই।
গণপূর্ত মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ৪০৬ কোটি টাকার এই স্থাপনা নির্মাণের দায়িত্বে ছিল গণপূর্ত অধিদপ্তর। নিম্নমানের নির্মাণকাজের অভিযোগ ওঠার পর গণপূর্ত অধিদপ্তর এই প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী উৎপল কুমারকে প্রকল্প থেকে সরিয়ে নেয়। গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় নির্মাণে অনিয়ম-ত্রুটি ধরার জন্য পাঁচ সদসে্যরে একটি কমিটি গঠন করেছে। ১৯ জুলাই তদন্ত কমিটির সদস্যরা কারাগারে যান।
কারা অধিদপ্তরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ওই দিন পরিদর্শনের সময় তদন্ত কমিটির সদস্যরা বন্দীদের একটি ভবনের দেয়ালে হাতুড়ি দিয়ে সামান্য আঘাত করেন। এ সময় পলেস্তারা খসে পড়তে থাকে। কমিটির সদস্যদের ধারণা, সিমেন্ট ও বালু নিম্নমানের।
জানতে চাইলে তদন্ত কমিটির প্রধান গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. আফজাল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘তদন্ত করছি, শেষ হোক তারপর বলতে পারব কী কী অনিয়ম হয়েছে।’ কবে নাগাদ তদন্ত শেষ হবে, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সভা করেছি, আবারও সরেজমিনে যাব, তারপর প্রতিবেদন জমা দেব।’
২০০৬ সালে কেরানীগঞ্জের রাজেন্দ্রপুরের তেঘরিয়ায় অবস্থিত ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার নির্মাণের এই প্রকল্পটি নেওয়া হয়েছিল। ২০১১ সালের জুনে এটি শেষ হওয়ার কথা ছিল। ১৯৪ একর জমিতে এই স্থাপনা নির্মাণে ব্যয় ধরা হয় ৪০৬ কোটি টাকা। গত বছরের ১০ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এর উদ্বোধন করেন। এরপর গত বছরের ২৯ জুলাই পুরান ঢাকার নাজিমুদ্দিন রোড থেকে সব বন্দীকে নতুন কারাগারে নেওয়া হয়। নতুন কারাগারে বর্তমানে বন্দী আছেন প্রায় সাত হাজার।
কারা প্রশাসনের কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন, নতুন ভবনে বন্দী আনার পর থেকেই তাঁরা লক্ষ করেন, কোনো কিছুই ঠিকমতো কাজ করছে না। কারা অধিদপ্তর দুই দফা পরিদর্শন করে প্রথমে ৭২ ধরনের এবং পরে ৩৬ ধরনের ত্রুটি ও সমস্যা চিহ্নিত করে। এরপর গত বছরের ১ আগস্ট এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য কারা কর্তৃপক্ষ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন দেয়। এরপর চলতি বছরের মে মাসে তদন্ত কমিটি করে মন্ত্রণালয়।
কারা অধিদপ্তর সূত্র জানায়, কারাগারের ৩০টি ভবন নির্মাণ করেছে ২০টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। আরও নয়টি ভবন নির্মাণাধীন।
এর মধ্যে কারা প্রশাসনিক ভবন, হাই সিকিউরিটি সেল, চারটি আবাসিক ভবনসহ বেশ কিছু স্থাপনা তৈরি করেছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান খান অ্যান্ড সামস। নির্মাণে অনিয়মের ব্যাপারে জানতে চাইলে এই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল কাশেম প্রথম আলোকে বলেন, কারাগার চালুর দুই বছর আগেই ভবনগুলো নির্মাণ করা হয়। এরপর এগুলো অব্যবহৃত অবস্থায় ছিল। এ কারণে হয়তো ভবন থেকে পলেস্তারা খসে পড়ছে।
কারাগার প্রকল্পের পরিচালক, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব শামসুল আলম ছোটখাটো ত্রুটির কথা স্বীকার করেন। তিনি প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, ‘নির্মাণে বড় ধরনের কোনো ত্রুটি হয়নি। যেসব ত্রুটি নজরে আসছে, গণপূর্তকে বলে দিলেই তারা সমাধা করে দিচ্ছে।’ তাহলে সামান্য বাতাসে কেন বিদ্যুতের খুঁটি ভেঙে পড়ছে? জবাবে তিনি বলেন, ‘অনেক দিন আগে বসানো তো, পড়তেই পারে।’


http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/1269456/