২৯ জুলাই ২০১৭, শনিবার, ১০:৩৫

খাদ্যগুদামে লুটপাট চলে প্রকাশ্যেই

জড়িত কর্মকর্তা জনপ্রতিনিধি ও ব্যবসায়ী

সরকারি গুদাম থেকে পাচারের সময় চাল বা গম উদ্ধার_ প্রায় প্রতিদিনই এমন খবর সংবাদ মাধ্যমে প্রচার হয়। গুদাম থেকে খাদ্যশস্য লুটপাটের বিষয় অনেকটাই প্রকাশ্য। অনেক ক্ষেত্রে গুদামে রেখেই হয় বেচাকেনা। খবরের শিরোনাম হওয়া দু-একটি ঘটনা নিয়ে তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। আবার দু'একটি ক্ষেত্রে কমিটি শাস্তির সুপারিশ করে প্রতিবেদনও দেয়। কিন্তু খাদ্যশস্য লুটপাটে জড়িতদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, গুদামকেন্দ্রিক ব্যবসায়ী, জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা পর্যন্ত সরকারি খাদ্যশস্য নিয়ে কারসাজিতে জড়িত। তাদের সহায়তা করেন খাদ্যগুদামের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। খাদ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের দাবি, তারা যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করছেন। এ কারণে আগের তুলনায় খাদ্য বিভাগে অনিয়ম-দুর্নীতি কমেছে।

এ বিষয়ে খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম সমকালকে বলেন, সারাদেশের খাদ্য গুদামগুলো কঠোর নজরদারিতে রয়েছে। গুদাম-সংশ্লিষ্ট কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির তথ্য পাওয়া গেলেই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি অসাধু ব্যবসায়ীদের লাইসেন্স বাতিলসহ তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ বিভিন্ন ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।


খাদ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, বিভিন্ন সংস্থার রেশন এবং গরিব-দুস্থদের জন্য বরাদ্দকৃত খাদ্যশস্যের ডিও জনপ্রতিনিধিরা অনেক ক্ষেত্রেই ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করেন। এই কেনাবেচা ঘিরেই মূলত বড় দুর্নীতি হয়। এসব ক্ষেত্রে তাদের করার কিছুই থাকে না। আবার অনেক খাদ্য কর্মকর্তাও নানা অনিয়মে জড়িয়ে পড়েন। তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও নেওয়া হয়। তবে ফাঁক-ফোকর থাকায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে সব সময় কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া যায় না।


জানা যায়, উপজেলা পর্যায়ে বিভিন্ন সরকারি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন, দুর্যোগ উপলক্ষে ত্রাণ বিতরণ বা সরকারিভাবে খোলা বাজারে খাদ্যশস্য বিক্রি করা হয়। এ ছাড়া বছরজুড়ে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে এর বিপরীতে বরাদ্দ থাকা খাদ্যশস্যের অধিকাংশ সরকারি গুদাম থেকেই সরবরাহ করা হয়। স্থানীয় পর্যায়ে ইউপি চেয়ারম্যান, মেম্বার বা প্রকল্প-প্রধানরা উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার পক্ষে দেওয়া ডিও লেটারের মাধ্যমে সরকারি গুদাম থেকে খাদ্যশস্য উত্তোলন করেন। বরাদ্দ করা খাদ্যশস্য গুদাম থেকে প্রকল্প-প্রধানদের সরাসরি উত্তোলনের কথা থাকলেও তারা অবৈধভাবে ডিও লেটার বিক্রি করেন। ইউপি চেয়ারম্যান, মেম্বার বা প্রকল্প-প্রধানরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রকল্প বাস্তবায়নে শ্রমিকদের খাদ্যশস্য না দিয়ে নগদ টাকা দেন। এ ছাড়া আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন সংস্থাও তাদের রেশন বিক্রি করে নগদ টাকা নেয়। এ কেনাবেচাকে কেন্দ্র করে সরকারি গুদাম ঘিরে শক্তিশালী ব্যবসায়ী চক্র গড়ে উঠেছে। এ চক্রটি বাজারমূল্যের চেয়ে কমে খাদ্যশস্য কিনে তা চড়া দামে সরকারি গুদামেই দেয়। অনেক ক্ষেত্রে গুদামে খাদ্যশস্য রেখেই কেনাবেচা হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ডিও লেটারের মাধ্যমে গুদাম থেকে খাদ্যশস্য তুলে ব্যবসায়ীরা কালোবাজারেও বিক্রি করে।


গত ৬ মাসে চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকা থেকে বস্তাভর্তি সরকারি চাল জব্দ করে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। জব্দকৃত চাল পাচারের উদ্দেশ্যে সরকারি খাদ্য গুদাম থেকে বের করা হয়েছিল বলে মামলায় উল্লেখ করা হয়। সর্বশেষ ১৭ জুলাই তিন হাজার ৩৬৬ বস্তা সরকারি চাল জব্দ করে র্যাব। চাল পাচারে জড়িত থাকার অভিযোগে হালিশহর কেন্দ্রীয় খাদ্য গুদামের (সিএসডি) ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা প্রণয়ন চাকমা ও চার ট্রাকচালককে আটক করা হয়। এ ঘটনায় দায়ের মামলায় বলা হয়_ কালোবাজারির উদ্দেশ্যে খাদ্য গুদামের কয়েকজন কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ী সরকারি চাল পাচার করছিল।


এদিকে খাদ্য গুদামের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, জব্দকৃত ওই চালের সঙ্গে খাদ্য গুদামের কর্মকর্তাদের কোনো যোগসাজশ ছিল না। গত জুনে স্থানীয় চেয়ারম্যান ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তাদের রেশনের চাল বিক্রি করে। ব্যবসায়ীরা তাই নিয়ে যাচ্ছিল। প্রয়োজনীয় দলিলাদি উপস্থাপনের পরই ব্যবসায়ীদের চাল দেওয়া হয়েছিল। তবে তারিখ নিয়ে একটা বিভ্রান্তি ছিল। একই সঙ্গে তারা জানান, চট্টগ্রামের পৃথক দুই সিএসসিতে কর্মরত দুই কর্মকর্তার অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের জের ধরেই চাল জব্দের ঘটনাটা ঘটে।

স্থানীয় একাধিক ব্যবসায়ী জানান, র্যাব-পুলিশ-আনসার সদস্যদের অধিকাংশই রেশনের চাল সিএসডি থেকেই বিক্রি করেন। এটা ওপেন সিক্রেট। চট্টগ্রামের হালিশহরের এ চাল আটকের ঘটনায় দায়ের করা মামলার আসামি ব্যবসায়ী সাহাবউদ্দিন সওদাগর। তিনি র্যাব সদস্যদের বিক্রি করা রেশনের চাল কিনেছিলেন।


সাহাবউদ্দিন সওদাগর র্যাবের রেশনের চাল কেনার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, আমি সরাসরি কিনেছি_ বললে ভুল হবে। অন্য একজন ব্যবসায়ীর মাধ্যম হয়ে ওই চাল নিয়েছি। তিনি বলেন, আমরা সিএসডিকেন্দ্রিক ব্যবসা করি। সংস্থাগুলো বেশিরভাগ সময় রেশনের চাল বিক্রি করে, আর আমরা তা কিনে নিই। ইউপি চেয়ারম্যানরাও অনেক ক্ষেত্রে তাদের নামে আসা বরাদ্দের একটা অংশ বিক্রি করেন। কিন্তু পরে র্যাব-পুলিশ কেন হয়রানি করে, তা বুঝতে পারি না।

জানুয়ারিতে বরিশালের বাবুগঞ্জের এক ইউপি চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে সরকারি উন্নয়ন বরাদ্দে থাকা খাদ্যশস্য নানা কৌশলে লোপাটের অভিযোগ করেন ওই ইউপির সদস্যরা। তারা বরিশাল জেলা প্রশাসক বরাবর দেওয়া এক স্মারকলিপিতে চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে চাল বিক্রি করার অভিযোগও তোলেন। গত রোববার বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা নারী ভাইস চেয়ারম্যানদের অনেকেই সংশ্লিষ্ট এলাকার চেয়ারম্যানদের বিরুদ্ধে একই অভিযোগ করেন।

http://bangla.samakal.net/2017/07/29/312241