২৯ জুলাই ২০১৭, শনিবার, ১০:৩৪

পাঁচ কারণে কমছে সুন্দরবনের বাঘ

বাঘ দিবস নিয়ে বিশেষ আয়োজন

উদ্বেগজনক হারে কমছে বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনের বাঘ। এর পেছনে যেমন রয়েছে প্রাকৃতিক কারণ, রয়েছে মানবসৃষ্ট কারণও। তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে বন বিভাগ ও স্থানীয় বিশেষজ্ঞরা সুন্দরবনে বাঘ কমে যাওয়ার প্রধান পাঁচটি কারণ চিহ্নিত করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে_ চোরা শিকারিদের বাঘ শিকার, খাদ্য সংকটসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক কারণে লোকালয়ে চলে আসা বাঘ পিটিয়ে হত্যা, বার্ধক্য ও লবণাক্ত পানি পানে লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হওয়া এবং ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে বাঘের মৃত্যু।


বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০০১ থেকে গত ১৬ বছরে বিবিধ কারণে ৪২টি বাঘ মারা গেছে। এর মধ্যে লোকালয়ে এসে পড়ায় স্থানীয় লোকজন পিটিয়ে হত্যা করেছে ১৩টি, বার্ধক্যজনিত কারণে মারা গেছে ৮টি, অসুস্থ হয়ে মারা গেছে ২টি, ঘূর্ণিঝড় সিডরে মারা গেছে ১টি বাঘ। আর এই সময়ে চোরা শিকারিদের হাতে মারা পড়েছে ৮টি বাঘ। এর বাইরে বাঘের ১০টি চামড়া উদ্ধার করা হয়েছে। এ ছাড়া ২০১২ সালের ১১ জুন পাচারের সময় উদ্ধার হয় তিনটি বাঘের বাচ্চা।

সুন্দরবন একাডেমির নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক আনোয়ারুল কাদির সমকালকে বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে বাঘের চামড়া, হাড়, দাঁতসহ অন্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। যে কারণে চোরা শিকারিদের বাঘ শিকার থামছে না। আগে বনদস্যুরা বনজীবীদের কাছ থেকে চাঁদা ও মুক্তিপণ আদায় করলেও বর্তমানে বন্যপ্রাণীও শিকার করছে।

অধ্যাপক আনোয়ারুল কাদির আরও বলেন, বাঘের বিচরণ ক্ষেত্রে হরিণের সংখ্যা কমে গেছে। এ জন্য খাদ্য সংকট দেখা দেওয়ায় নদী-খাল পেরিয়ে বাঘ লোকালয়ে চলে আসছে। তখন স্থানীয় মানুষ পিটিয়ে বাঘ হত্যা করছে। অসুস্থতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং বার্ধক্যজনিত কারণেও কিছু বাঘ মারা যাচ্ছে।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক ড. আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী সমকালকে বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে জোয়ারের সময় নদীর পানির উচ্চতা বাড়ছে। এতে বনভূমি ডুবে যাওয়ার পরিমাণ বাড়ায় কমে যাচ্ছে বাঘের বিচরণ ক্ষেত্র। পাশাপাশি লবণাক্ততা বাড়তে থাকায় প্রয়োজনীয় মিষ্টি পানি না পেয়ে লবণাক্ত পানি পান করে অসুস্থ হয়ে পড়ছে বাঘ। এ ছাড়া নির্বিচারে বন উজাড়, অপরিকল্পিত পর্যটন ও বনের মধ্য দিয়ে ভারী নৌযান চলাচলের কারণে বিরূপ প্রভাব পড়ছে বাঘের বংশবৃদ্ধির ওপর।

বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ২০০৪ সালে পাগ মার্ক বা পায়ের ছাপ গণনা পদ্ধতিতে করা শুমারিতে দেখা গেছে, সুন্দরবনে ৪৪০টি বাঘ রয়েছে। কিন্তু ২০১৫ সালে ক্যামেরা ট্রাপিং পদ্ধতিতে করা শুমারিতে দেখা যায়, সুন্দরবনে রয়েছে মাত্র ১০৬টি বাঘ।

র্যাব, পুলিশ, বন বিভাগ ও বনজীবী সূত্রে জানা গেছে, চোরা শিকারিরা সুন্দরবনে বিভিন্নভাবে রয়েল বেঙ্গল টাইগার হত্যা করছে। কখনও গুলি, কখনও ফাঁদে আটকে বাঘ শিকার করছে তারা। আবার ছাগল বা হরিণ মেরে সেগুলোর শরীরে বিষ মেখে বাঘের খাবার হিসেবে বনে ফেলে রাখা হয়। বিষমাখা এসব মৃত প্রাণী খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ে বাঘ। তখন সেগুলোকে হত্যা করা হয়। ফাঁদে আটকানো বাঘকে অভুক্ত রেখে অথবা বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়। মৃত বাঘের শরীর থেকে চোরা শিকারিরা চামড়া, মাথার খুলি, দাঁত, লিঙ্গ, হাড়সহ অন্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংগ্রহ করে আন্তর্জাতিক চোরাকারবারিদের কাছে চড়া দামে বিক্রি করে দেয়। আন্তর্জাতিক কালোবাজারে বাঘের এসব প্রত্যঙ্গের ব্যাপক চাহিদা।

বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. মদিনুল আহসান জানান, বাঘসহ বন্যপ্রাণী শিকার প্রতিরোধে সুন্দরবনে শিগগিরই 'স্মার্ট প্যাট্রোলিং' শুরু হচ্ছে। অসুস্থ বাঘের চিকিৎসায় খুলনায় একটি 'ওয়াইল্ড লাইফ রেসকিউ সেন্টার' স্থাপন করা হয়েছে। এ ছাড়া লোকালয়ে চলে আসা বাঘ রক্ষায় সুন্দরবন সংলগ্ন গ্রামগুলোতে ৪৯টি ভিলেজ টাইগার রেসপন্স টিম গঠন করা হয়েছে।

র্যাব-৬ এর অধিনায়ক খোন্দকার রফিকুল ইসলাম বলেন, বাঘ শিকার ও এর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পাচার বন্ধে তারা নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছেন। শিকারিদের তৎপরতা আগের তুলনায় বর্তমানে কম বলে তিনি দাবি করেন।

http://bangla.samakal.net/2017/07/29/312240