২৯ জুলাই ২০১৭, শনিবার, ১০:৩১

ঢেলে সাজাতে হবে পানি ব্যবস্থাপনা

ড. আইনুন নিশাত : পানি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ

আমরা জলাবদ্ধতা, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, অস্বাভাবিক জোয়ার, ফ্লাশ ফ্লাড ইত্যাদি নামে বিভিন্ন ধরনের বন্যাকে বুঝিয়ে থাকি। বিভিন্ন ধরনের বন্যার জন্য ভিন্ন ভিন্ন ব্যবস্থাপনা আছে। তবে এ সমস্যা সমাধানের পদ্ধতি সব ক্ষেত্রে একই। প্রথমে জানা দরকার বন্যা কী। একটি স্থান পানিতে ডুবে যদি ক্ষয়ক্ষতি হয় তবেই তাকে বন্যা বলে। এক্ষেত্রে দুটি বিষয় রয়েছে- এক. পানিতে ডুবে যাওয়া। দুই. ক্ষয়ক্ষতি হওয়া। প্রথমটি প্রাকৃতিক অর্থাৎ পানি আসা। তবে পানি জমে যাওয়ার ক্ষেত্রে মানুষের ভূমিকা আছে। দ্বিতীয়টি ক্ষতি- পানিতে ডুবে বাড়িঘর, রাস্তাঘাট ও ফসলের ক্ষতি হয়। ক্ষতির পরিমাণ নির্ভর করে কী ফসল, কতদিন ডুবে থাকে তার ওপর। প্রতিটি বন্যার কারণ ও ক্ষতি বিশ্লেষণ করে তার জন্য প্রয়োজনীয় প্রতিরোধ ও সুরক্ষার ব্যবস্থা নিতে হবে।


রাজধানীর জলাবদ্ধতার কারণ কী সেদিকে আলোকপাত করা যাক। রাজধানীর জলাবদ্ধতার অন্যতম কারণ পানি নিষ্কাশনে বড় ধরনের সমস্যা বিদ্যমান থাকা। রাজধানীর পশ্চিমে তুরাগ-বুড়িগঙ্গা নদীর তীরগুলো উঁচু ও মজবুত। টঙ্গী ব্রিজ থেকে আশুলিয়া-চাঁদবাড়ি-মিরপুর ব্রিজ, সেখান থেকে মিটফোর্ড-বুড়িগঙ্গা পর্যন্ত বেড়িবাঁধ দেয়া আছে। এর ফলে তুরাগ ও বুড়িগঙ্গা নদীর পানি রাজধানীর ভেতরে প্রবেশ করতে পারছে না। অতিবৃষ্টির পর রাজধানীর পানি গোড়ান-চাঁদবাড়ি এলাকা দিয়ে বাইরে বের করা হচ্ছে। এ কারণে রাজধানীর পশ্চিমাঞ্চল বন্যামুক্ত। কিন্তু পূর্বাংশে বালু নদীতে বাঁধ না হওয়ায় এ অংশে বর্ষার সময় পানি চলে আসে। ওই স্থানে বসবাসকারীরা এটিকে স্বাভাবিক ভেবে প্রস্তুত থাকে। ফলে ক্ষয়ক্ষতি খুব একটা হয় না। গত কয়েকদিন প্রচুর বৃষ্টিপাতের পর রাজধানীর পানি বের হতে পারেনি। পানি জমে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়েছে। তাহলে প্রথমত প্রশ্ন হল- এ বৃষ্টিপাত কি অস্বাভাবিক? উত্তর হল, না। শ্রাবণের প্রথম ও দ্বিতীয় সপ্তাহে ভারি বৃষ্টিপাত হয় এবং পানি জমে। আমরা লক্ষ্য করেছি গত চার-পাঁচ দিন তা-ই হয়েছে। ফলে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় যে পানি জমেছে এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। এ অবস্থায় আমাদের পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থাপনার দিকে বিশেষ দৃষ্টি দিতে হবে। রাজধানীর পানি নিষ্কাশনে অব্যবস্থাপনার প্রধান কারণ- প্রাকৃতিক খাল হয় দখল হয়েছে, ভরাট হয়েছে, নতুবা খালের ওপর বক্স-কালভার্ট বানিয়ে তার ওপর রাস্তা বানানো হয়েছে। এসবের কারণে অধিক বৃষ্টিপাতে রাজধানীর জমে যাওয়া পানি সময়মতো নিষ্কাশিত হচ্ছে না।

প্রশ্ন হল, এসব সমস্যা সম্পর্কে আমরা কি অবগত? এর জবাব হল, আমরা খুব ভালোভাবেই অবগত। সম্প্রতি জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ডের অনুদান এবং বিশ্বব্যাংকের তত্ত্বাবধানে প্রতিটি ওয়ার্ড ধরে পানি নিষ্কাশন সমস্যার সমাধান চিহ্নিত করা হয়েছে। কোন্ খালকে কোথায় কীভাবে পুনরুজ্জিত করা হবে ও করা দরকার সেটা এ সংক্রান্ত রিপোর্টে বলা আছে। বিশ্বব্যাংকের ওয়েবসাইটে গিয়ে যে কেউ চাইলে এই রিপোর্ট দেখতে পারেন। এর বাইরে রাজধানীর জলাবদ্ধতা দূরীকরণে ঢাকা ওয়াসা যেসব মহাপরিকল্পনা হাতে নিয়েছে, সেগুলোর বাস্তবায়নে বাধা কোথায়? অর্থের অভাব? সম্ভবত তা নয়। মূল সমস্যা প্রাতিষ্ঠানিক। জলাবদ্ধতা, পানি নিষ্কাশন সমস্যা- এগুলোর সমাধানের দায়িত্ব কার? বিভিন্ন খবরের কাগজে দেখলাম মেয়রদের দিকে অভিযোগের আঙ্গুল। অথচ এসব সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব ওয়াসা ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের- যেসব সংস্থার ওপর মেয়রদের কোনো প্রভাবই নেই।

নগরীর বিভিন্ন অংশের গত কয়েকদিনের জলাবদ্ধতার চিত্র গণমাধ্যমে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করা হয়েছে। কিন্তু একটু দক্ষিণের ডিএনডি এলাকার অবস্থা প্রচারিত হতে দেখিনি। দুই মাসের বেশি সময় ওই এলাকা পানিতে ডুবে আছে। আমার ধারণা ডিএনডি এলাকার পরিস্থিতি আরও জটিল আকার ধারণ করবে। বিষয়টি দেখার দায়িত্ব পানি উন্নয়ন বোর্ডের।

শিমরাইল নামক স্থানে পানি উন্নয়ন বোর্ডের একটি পাম্পিং স্টেশন রয়েছে। সেটা ঠিকমতো কাজ করলে তো ডিএনডিতে পানি থাকার কথা নয়। যেসব খাল দিয়ে ডিএনডিতে পানি পৌঁছানোর কথা, সেগুলো হয় দখল অথবা সরু হয়ে গেছে, অর্থাৎ পাম্প স্টেশনে পানি পৌঁছাচ্ছে না। এজন্যই ওই এলাকার জলাবদ্ধতা মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। একসময় নানাবিধ ফসল উৎপাদনের জন্য ডিএনডি বাঁধ দেয়া হয় ওই এলাকায়, এখন বসতিই বেশি। ওই এলাকার মানুষদের যে কী অবস্থা তা ভুক্তভোগী ছাড়া আর কেউ সহজে বুঝতে পারবে না।

এবার আসি চট্টগ্রাম প্রসঙ্গে। জলাবদ্ধতা নামক বন্যা চট্টগ্রামে নতুন কিছু নয়। দীর্ঘদিনের অবহেলা-অব্যবস্থাপনার কারণেই চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা প্রতিবছর বড় ভোগান্তি হয়ে আসছে। এ বছর একসঙ্গে কয়েকটি কারণে চট্টগ্রামে জলাবদ্ধতা-বন্যা সমস্যা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। এর সঙ্গে অস্বাভাবিক জোয়ার তো রয়েছেই। চট্টগ্রামে জলাবদ্ধতার প্রথম কারণ অতিবৃষ্টি, দ্বিতীয় কারণ কাপ্তাই লেক থেকে পানি ছেড়ে দেয়া- কাপ্তাই ড্যামের নিরাপত্তার কারণে অতিরিক্ত পানি ছেড়ে দিতে হয়। তৃতীয় কারণ অমাবস্যা-পূর্ণিমাতে স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি মাত্রার জোয়ার। এর সঙ্গে যোগ হচ্ছে নিন্মচাপের প্রভাব এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধির বিষয়টি।

খবরে কাগজে দেখলাম আগ্রাবাদে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা নৌকায় চড়ে অফিসে যাচ্ছেন। তাদের গাড়ির ড্রাইভাররা মাঝির কাজ করছেন। জলাবদ্ধতা ও মাত্রাতিরিক্ত পানি জমে যাওয়ার কারণেই এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। প্রশ্ন হল, অতিরিক্ত পানি আসার যে কারণগুলো উপরে বললাম, এগুলো কি খুব অস্বাভাবিক? আমার মতে, মোটেই না। চট্টগ্রামের পানি নিষ্কাশন সংক্রান্ত যে কোনো পরিকল্পনায় এগুলো মনে রাখতে হবে। ঢাকার মতো সেখানেও দখল ও বন্ধ হয়ে যাওয়া খাল উদ্ধার, জোয়ারের পানি যেন না ঢুকে সেজন্য উপকূলীয় বাঁধ ভালোভাবে নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে এবং ভেতরের পানি নিষ্কাশনে পাম্প স্টেশন স্থাপন করে ভালোভাবে দেখাশোনা করতে হবে। তবে সবার আগে প্রয়োজন জোনিং করা। আমি যদি নিচু জায়গায় গিয়ে বাড়ি করি তাহলে তো বর্ষায় সেটা ডুবে যাবেই। এজন্য জোনিংয়ের মাধ্যমে বাণিজ্যিক আবাসিক এলাকাকে বন্যামুক্ত করতে হবে।

এবার আসি সিরাজগঞ্জ এলাকায় বন্যার বিষয়ে। দেশের প্রতিটি টিভি চ্যানেল ও খবরের কাগজে সিরাজগঞ্জ-কাজীপুর এবং তৎসংলগ্ন এলাকা এবং যমুনার চরে তীব্র আকারের বন্যা হয়েছে বলে হইচই করা হচ্ছে। এ বিষয়ে আমি পুরোপুরি বিস্মিত। আমার মতে, সেখানে কোনো বন্যা হয়নি। এখন পর্যন্ত ওই এলাকায় পানির উচ্চতা অত্যন্ত স্বাভাবিক এবং বন্যাও স্বাভাবিক। চর ডুববে স্বাভাবিক, বাঁধের নদীর মধ্যবর্তী স্থানের প্লাবন ভূমিটি ডুবে যাবে এটিও স্বাভাবিক ঘটনা। কাজেই যারা ওই স্থানে ঘরবাড়ি করেছেন তাদের বাড়ি বর্ষার পানিতে ডুববে, এটাকে বন্যা বলা ঠিক নয়। নদ-নদী ও প্রকৃতি প্রকৃতির কাজ করছে। মানুষকে প্রকৃতির স্বাভাবিক গতি-প্রকৃতি বিবেচনায় নিয়ে সে অনুযায়ী প্রস্তুতি নিতে হবে। ঘরবাড়ি তৈরি ও নিষ্কাশন ব্যবস্থা প্রকৃতিকে মাথায় রেখে করতে হবে।

শুরুতে বন্যার যে সংজ্ঞা দিয়েছি সে সংজ্ঞা অনুযায়ীই এখানে বন্যা হচ্ছে। এতে মানুষের ক্ষতি হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ক্ষতির জন্য নদী ও পানিকে দায়ী করতে পারছি না। চরাঞ্চলে বাঁধ দ্বারা রক্ষিত নয় এমন স্থানে যারা বাড়িঘর করবে, তাদের উচিত স্বাভাবিকভাবে পানির প্রবাহ যেমন হয় তার থেকে উপরের স্থানে ভিটি স্থাপন করা। গ্রামবাংলায় এটিই প্রথা ছিল- প্লাবন ভূমিতে বাড়ি হতো না, হতো উঁচু স্থানে। পানির জন্য পুকুর কাটা হতো।

কিছু কাগজে পড়লাম, বন্যার পানির কারণে আউশ ধান ও পাটের ক্ষতি হচ্ছে। বিষয়টি আমার কাছে অবাকই লাগল। বন্যার পানিতে পাটের ক্ষতি হওয়ার তো কথা নয়। আর দেশীয় প্রজাতির আউশ ধান লাগালে পানির সঙ্গে সঙ্গে সেগুলো বাড়বে। উচ্চ ফলনশীল ধান (হাইব্রিড) হলে ক্ষতি হবে। আমার জানা মতে, এখনও প্রধান প্রধান বাঁধগুলো কার্যকর আছে। এগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে। এ কাজের দায়িত্বপ্রাপ্ত পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। তবে এক পাউবোর ওপর দায়িত্ব দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলে চলবে না। স্থানীয় সরকার অর্থাৎ ইউনিয়ন পরিষদকেও এগিয়ে আসতে হবে। বাঁধ ভাঙনে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হন, ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব তাদেরই দিতে হবে। অর্থাৎ সময় এসেছে বাংলাদেশে জলাবদ্ধতা, বন্যা ও পানি উন্নয়ন ব্যবস্থাপনাকে ঢেলে সাজানোর।

ড. আইনুন নিশাত : পানি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ

 

http://www.jugantor.com/sub-editorial/2017/07/29/143706/