৩ আগস্ট ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ১০:২১

সিইসির প্রথম সংলাপেই বেকায়দায় আ’লীগ

দেশের বিশিষ্ট নাগরিকদের সাথে নির্বাচন কমিশনের সংলাপের পর বড় ধরণের বেকায়দায় পড়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। মুখে দলটির সিনিয়র নেতারা যাই বলুক না কেন নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকার এবং মেজিস্ট্রেসি ক্ষমতাসহ সেনা মোতায়েনের দাবি নিয়ে একঘরে দলটি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নির্বাচন কমিশনের আহ্বানে যারা সংলাপে অংশ নিয়েছেন তাদের অধিকাংশই ক্ষমতাসীন দলের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সমর্থক। যারা নিজেদের নিরপেক্ষ হিসেবে দাবি করেন তারাও অতীতে সরকারি দলের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। ফলে তাদের কাছ থেকে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার এবং সেনা মোতায়েনের দাবি উঠায় এটি এখন গণদাবিতে পরিণত হয়েছে। ফলে দেশে-বিদেশে সবাই বলছেন, চলমান রাজনৈতিক সংকট নিরসনে সব দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচন প্রয়োজন। সেজন্যে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের বিকল্প নেই। তারা আরও বলছেন, ৩১ জুলাই দেশের বিশিষ্ট নাগরিকদের সাথে নির্বাচন কমিশনের সংলাপে প্রমাণিত হয়েছে রাজনৈতিক সংকট নিরসনে বিরোধী দলসমূহের দাবি যৌক্তিক। ইসির সংলাপে বিশিষ্ট নাগরিকগণ নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার, মেজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দিয়ে সেনাবহিনী মোতায়েন, নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা বৃদ্ধি, সকলের জন্যে লেভেলপ্লেয়িং ফিল্ড তৈরিসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দাবি তুলে ধরেছেন।
সূত্র মতে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের এখনো দেড় বছর বাকি। ইতোমধ্যে নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা ইস্যুতে রাজনীতি জমে উঠেছে। এবারও এটি নিয়ে দুই মেরুতে অবস্থান নিয়েছে দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। দুই দলের পাল্টাপাল্টি বক্তব্যে উত্তপ্ত রাজনীতির মাঠ। কেউ ছাড় দিতে নারাজ। চলছে কথার লড়াই। আক্রমণ, পাল্টা আক্রমণ। গত কয়েক বছর বিএনপি ‘সহায়ক সরকারের’ অধীনে নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছে। এ জন্য প্রয়োজনে সংবিধান সংশোধন চায় দলটি। এই দাবির সাথে অনেক আগে থেকেই একমত ছিল বিদেশীরাও। জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারতসহ প্রভাবশালী দেশগুলোও বাংলাদেশের হারানো গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে নবার অংশগ্রহণে নির্বাচনের পক্ষে মত দিয়ে আসছে। এজন্য তারা বাংলাদেশকে সহায়তা দিতেও প্রস্তুত। এবার এর সাথে যোগ হয়েছে দেশের বিশিষ্ট নাগরিকদের সমর্থনও। তারা বলছেন, নির্বাচনকে নিরপেক্ষ করকে সহায়ক সরকারের কোনো বিকল্প নেই। এছাড়া সেনাবাহিনী মোতায়েন করে তাদের মেজিস্ট্রেসি ক্ষমতাও দেয়ার কথা বলেছেন তারা। বিপরীতে আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, বিষয়টি মীমাংসিত। সংবিধান অনুযায়ীই নির্বাচনকালীন সরকার গঠিত হবে। নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান থাকবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে কিছুদিন আগে আওয়ামী লীগ সম্পাদক ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনেই সহায়ক সরকার গঠন করা হবে। তার এ বক্তব্যে সরকারের পক্ষ থেকে নমনীয়তার কিছুটা ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। কেউ কেউ আবার এটিকে রাজনৈতিক বক্তব্য বলেও মত দিচ্ছেন।
নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে সর্বশেষ দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বয়কট করে বিএনপি। সেই নির্বাচনে ১৫৩ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। যা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল ঘটনা। এতে দেশের ভাবমূর্তি খর্ব হয়। ফলে সর্বত্র সমালোচনার ঝড় উঠে। জানা গেছে, নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে দশম সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের যে অবস্থান ছিল তাতে কোনো পরিবর্তন হয়নি। গত নির্বাচনের মতোই আগামী নির্বাচনেও নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থায় সংবিধানে নির্ধারিত পদ্ধতি বহাল রাখতে দৃঢ় অবস্থানে দলটি। সূত্র জানিয়েছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে যে মন্ত্রিসভা রয়েছে সেই মন্ত্রিসভাই ছোট করে নির্বাচনকালীন মন্ত্রিসভা গঠন করা হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই নির্বাচনকালীন মন্ত্রিসভার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করবেন। অন্যদিকে বিএনপিসহ দেশের প্রায় সব কটি দল ও বিশিষ্ট নাগরিকরা বলছেন, নির্বাচনকালীন সরকারের বিষয়টি এখনো অমীমাংসিত। বিষয়টির সুরাহা না হওয়ায় রাজনীতিতে চাপা অস্থিরতা বিরাজ করছে। নির্বাচন নিয়ে জনমনে অনিশ্চয়তা আছে। এ জন্য সব দলের সঙ্গে আলোচনা করে সহায়ক সরকারের ফর্মুলা ঠিক করতে হবে।
এ বিষয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, জনগণ সহায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে বাধ্য করাবে। তিনি বলেন, লন্ডন সফর শেষে দেশে ফিরে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের ফর্মুলা দিবেন। এরপর তিনি জেলা সফরে বের হবেন। মূলত সহায়ক সরকারের প্রতি জনমত তৈরিতে তিনি বিভিন্ন জেলায় পথসভা ও জনসভা করবেন। রাজধানীতেও গণসংযোগসহ মহাসমাবেশ করার পরিকল্পনা রয়েছে। এভাবে দলটি সহায়ক সরকার ইস্যুতে চূড়ান্ত আন্দোলনের দিকে যাবে।
সুশীল সমাজের সাথে নির্বাচন কমিশনের অনুষ্ঠিত সংলাপের বিষয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, আমরা পত্র-পত্রিকায় যা দেখেছি, সুশীলসমাজের প্রতিনিধিরা বলেছেন যে, সহায়ক সরকার ছাড়া অর্থাৎ একটা নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে না। তারা বলে এসেছেন, সেনা বাহিনী মোতায়েন ছাড়া, তাদেরকে ম্যাজেস্ট্রেসি ক্ষমতা ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে না। তারা পরিস্কার করে বলেছেন, প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলকে নির্বাচনে আনতে হবে এবং তাদের জন্য লেভেল প্ল্যায়িং ফিল্ড করতে হবে। আমরা শুধু পুনরায় বলতে চাই, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি যে নির্বাচন করেছেন, সেই নির্বাচন আপনাদেরকে এদেশের মানুষ আর করতে দেবে না। সেই নির্বাচনই হবে যেখানে বিএনপিসহ সকল দল অংশগ্রহণ করতে পারবে এবং নিরপেক্ষভাবে নির্বাচন পরিচালনা করা হবে।
নির্বাচন কমিশনের ডাকে সংলাপে অংশ নেয়া রাজনৈতিক বিশ্লেষক প্রফেসর ড. তারেক শামসুর রেহমান বলেন, সংলাপে আমরা প্রায় সবাই বলার চেষ্টা করেছি, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের প্রাথমিক শর্ত হচ্ছে রাজনৈতিক দল, বিশেষ করে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মাঝে ‘আস্থা ও বিশ্বাসের’ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা, যা নির্বাচন কমিশনের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। এ ‘আস্থা ও বিশ্বাসের’ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা না হলে তা সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে। ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’-এর ব্যাপারে সিইসির এর আগের বক্তব্য সংলাপে সমালোচিত হয়েছে। সিইসি বলেছিলেন, ‘নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে তার করার কিছু নেই।’ এটা অনাকাক্সিক্ষত এবং ‘সবার জন্য সমান সুযোগ’ সৃষ্টি করার দায়িত্ব যে নির্বাচন কমিশনের, এ কথাও তাকে সংলাপে স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়। এর প্রতিত্যুত্তরে সিইসি অবশ্য কোনো কথা বলেননি। কোনো যুক্তিই তিনি খ-ন করেননি। তিনি প্রতিটি বক্তব্যের ‘নোট’ নিয়েছেন এবং কখনও কখনও এর ব্যাখ্যাও চেয়েছেন। তিনি বলন, সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১২৬, ৫৫(২) ও ৫৬(৪) প্রয়োগ করে স্বয়ং নির্বাচন কমিশন ‘সহায়ক সরকারের’ ভূমিকা পালন করতে পারে, এমন অভিমতও দিয়েছেন কেউ কেউ। মোদ্দাকথা, সংলাপে অংশ নেয়া প্রায় সবার অভিমত হচ্ছে, নির্বাচন কমিশন তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালন করুক।
সূত্র মতে, নাগরিক সমাজের সংলাপে পঞ্চদশ সংশোধনীর আগের মতো জাতীয় সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করার দাবি ওঠে। যুক্তি দেখানো হয়, সংসদীয় সরকার পদ্ধতিতে পৃথিবীর কোথাও সংসদ বহাল রেখে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের নজির নেই। অনেকটা একদলীয় দশম সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল সংসদের মোট আসনের তিন-চতুর্থাংশের বেশি আসন পেয়েছে এবং এসব সংসদ সদস্যের অনেকে মন্ত্রী হয়েছেন, তাই সংসদ সদস্য ও মন্ত্রীরা ক্ষমতায় থাকলে একাদশ সংসদ নির্বাচনে সব দলের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করা কমিশনের পক্ষে প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে।
সাবেক সচিব আবদুল লতিফ মন্ডল বলেন, স্বাধীনতার প্রথম দু’দশকের সাধারণ নির্বাচনগুলো সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ না হওয়ায় জনগণ নির্বাচন ব্যবস্থার ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেন। নির্বাচন ব্যবস্থার ওপর জনগণের আস্থা হারিয়ে ফেলা এবং রাজনীতিকদের পরস্পরের মধ্যে অবিশ্বাস সৃষ্টি হওয়া থেকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের দাবির সূত্রপাত হয়। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার সময়কালে অনুষ্ঠিত ৪টি সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠিত হওয়ায় জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হয়। ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকার নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের দাবিতে প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ ২৮টি সমমনা দল ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করলে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অধীনে অনেকটা ওই দলের একক অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত এ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দেশের গণতন্ত্র দুর্বল হয়ে পড়ে। শুধু দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন নয়, ক্ষমতাসীন সরকারের বিগত ও বর্তমান কার্যকালে অনুষ্ঠিত স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের নির্বাচনগুলোও সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠিত হয়নি। এতে জনগণ নির্বাচন ব্যবস্থার প্রতি ফের আস্থা হারিয়ে ফেলেন। তাই একাদশ সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে কমিশনকে একদিকে নির্বাচন ব্যবস্থার ওপর আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে এবং অন্যদিকে কমিশনের নিজের ভাবমূর্তি উদ্ধার করতে হবে।
নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সভাপতি এম হাফিজ উদ্দিন খান বলেন, নির্বাচন কমিশন যে রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজের সংলাপ ইত্যাদি করার উদ্যোগ নিয়েছে, তাও তো নির্বাচনী আইনে লেখা নেই। নির্বাচনী আইনে আছে, নির্বাচন কমিশন তফসিল ঘোষণা করবে এবং নির্বাচন পরিচালনা করবে। নির্বাচনকে অবাধ ও সুষ্ঠু করতে তারা যদি রাজনৈতিক দলগুলোর জবাবদিহিতা আদায় করতে পারে, তবে নির্বাচনী পরিবেশ তৈরি করার জন্য সরকারকে কেন বলতে পারবে না। তিনি বলেন, কেউ নির্বিঘেœ নির্বাচনী প্রচারণা চালাবে। আর কেউ ভয়ে ঘরে বসে থাকবে। তাহলে কিভাবে নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে?
নির্বাচন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. তোফায়েল আহমদ বলেন, নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টিসহ সব রাজনৈতিক দলের জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। কারণ রাজনৈতিক দলগুলো কমিশনে নিবন্ধিত। সেই রাজনৈতিক দলগুলোকে সরকার সভা-সমাবেশ করতে দিচ্ছে না, তার জন্য কমিশন উচ্চ আদালতের নিদের্শনা নিতে পারে। তা না করতে পারলে শুধু রোডম্যাপ ঘোষণা দিয়ে কিছুই হবে না।

 

http://www.dailysangram.com/post/294473-