৩ আগস্ট ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ১০:১৭

ষোড়শ সংশোধনী বাতিল ইতিবাচক

বিশেষজ্ঞদের অভিমত

দেশের বিশিষ্ট আইন বিশেষজ্ঞ ও সংবিধান বিশারদরা বলেছেন, সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল রায় বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য ইতিবাচক। প্রধান বিচারপতি রায়ে যে মতামত দিয়েছেন তা যথার্থই হয়েছে। নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগকে পৃথক করার ব্যাপারে এর কোনো বিকল্প ছিল না বলে মনে করেন তারা। তাদের মতে, রায়ের পর বিচার বিভাগ নিয়ে দেশবাসীর মধ্যে স্বস্তি ফিরে এসেছে। সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল উচ্চ আদালতের বিচারকদের স্বাধীনতা রক্ষায় যে একটি সঠিক সিদ্ধান্ত, এই রায়ে তাই প্রমাণ হয়েছে। তাই বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সম্পর্কে সবাইকে অধিকতর সতর্ক হওয়া প্রয়োজন।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ও সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি প্রবীণ আইনবিদ অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, ষোড়শ সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেয়া রায় বহাল রেখে আপিল বিভাগ যে রায় দিয়েছেন বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে এটা অত্যন্ত ইতিবাচক সিদ্ধান্ত। নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগকে পৃথক করার ব্যাপারে এর কোনো বিকল্প ছিল না। চতুর্থ সংশোধনী দ্বারা উচ্চ আদালতকে সম্পূর্ণভাবে নির্বাহী বিভাগের কর্তৃত্বে আনা হয়েছিল। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বিচার বিভাগের স্বাধীনতার লক্ষ্যে রাষ্ট্রপতি থাকা অবস্থায় রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা খর্ব করে বিচার বিভাগের মর্যাদা ও স্বাধীনতা রক্ষার জন্য সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল করেন। সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল উচ্চ আদালতের বিচারকদের স্বাধীনতা রক্ষায় যে একটি সঠিক সিদ্ধান্ত, এই রায়ে তা-ই প্রমাণ হয়েছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক আইন উপদেষ্টা ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন বলেন, চতুর্থ সংশোধনী কোনো শাসনতান্ত্রিক সংশোধনী ছিল না। বৈপ্লবিক পরিবর্তন হিসেবে শাসনতন্ত্রে পরিবর্তন করা হয়েছে। তাই চতুর্থ সংশোধনীর শাসনতান্ত্রিক বৈধতা থাকার কথা নয়। শাসনতন্ত্রের অনুচ্ছেদ ১১৬ তে নি¤œ আদালত সম্পর্কে সকল ক্ষমতা সুপ্রিম কোর্টের ওপর ন্যস্ত ছিল। প্রধান বিচারপতি তাই নতুন কিছু বলেননি। প্রধান বিচারপতি যে মতামত প্রকাশ করেছেন তা যথার্থই হয়েছে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সম্পর্কে সবাইকে অধিকতর সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। কেউ কেউ বলবেন প্রধান বিচারপতি রাজনৈতিক কথা বলেছেন। আমার কথা হলো যদি শাসনতন্ত্রের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক কথা হয় তা হলে শাসনতন্ত্রের রক্ষক হিসেবে সুপ্রিম কোর্টকেও বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য রাজনৈতিক বক্তব্য রাখতে হবে।
সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ের বিরুদ্ধে সরকার রিভিউ না করলে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল কার্যকর হয়ে যাবে। তিনি বলেন, ষোড়শ সংশোধনী বাতিল ও সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল নিয়ে সর্বসম্মত রায় এসেছে। এতে আগের সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ফিরে এসেছে। সাংবিধানিক পদে যারা আছেন তাদের বিষয়ে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলে তদন্ত হবে। আইনে আছে বিচার বিভাগ সেই তদন্ত করবে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল পুনঃস্থাপনের বিষয় নয়। বাদ দেয়া বিধান প্রতিস্থাপন করা। এজন্য আমি অ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্যের সাথে দ্বিমত পোষণ করি। তিনি আরো বলেন, আমরা পঞ্চদশ সংশোধনীর পর সংবিধান প্রিন্ট করেছিলাম। একইভাবে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল সংবিধানে পুনঃস্থাপন হবে।
১১৬ অনুচ্ছেদের বিষয়ে তিনি বলেন, সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ যে অবস্থায় আছে সে অবস্থায় থাকবে। এ বিষয়ে রায়ে যা বলা হয়েছে তা বিচারকের অভিমত। ভবিষ্যতে ১১৬ অনুচ্ছেদ নিয়ে আপিল বিভাগের এই অভিমতের ওপর ভিত্তি করে রিট করা যাবে। তা হলে এটা বিবেচনায় আসবে।
অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, মার্শাল ল’ আমলে সংবিধানের ৯৬ ধারা সংশোধন করে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের যে বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল সেটিকে আবার পুনঃস্থাপন করা হলো। রায়ের ভেতরে যাই বলা থাকুক না কেন রায়ের সমাপনীতে কি বলা আছে সেটি দেখতে হবে। অর্ডার অব দ্য কোর্ট কোনটা, সেখানে কিন্তু ১১৬ অনুচ্ছেদ সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি। আমি বলবো এটা একজন জাজের অভিমত হতে পারে; কিন্তু যেহেতু রায়ের শেষাংশে, যেটাকে অর্ডার অব দ্য কোর্ট আমরা বলি সেখানে ১১৬ অনুচ্ছেদ সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি।
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, এখন ওনারা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল রেস্টর করেছেন। কিন্তু আমার বক্তব্য হলো সংবিধানের যেকোনো ধারা যেটা সংশোধন করা, বাদ দেয়া সবটাই সংসদের ব্যাপার। কোর্ট যদি নিজেই রেস্টর (পুনঃস্থাপন) করে দেন তাহলে সংসদের থাকার কোনো দরকার হয় না, তাই না! আমার কথা হলো সুপ্রিম কোর্ট যেকোনো সংবিধানের যেকোনো সংশোধনকে অবৈধ ঘোষণা করতে পারেন। কিন্তু সংবিধানের কোনো ধারা পুনঃস্থাপন বা রেস্টর করা আমার বিবেচনায় সংসদের কাজ।
সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন বলেন, এটা একটা ঐতিহাসিক রায়। এই রায়ে বিচারকদের কোড অব কন্ডাক্ট এবং সংবিধানের ১১৬ ও ৯৬ অনুচ্ছেদ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। যে রায় দিয়েছেন তার জন্য নিঃসন্দেহে আমাদের বিচার বিভাগ প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য। এই রায়ের ফলে বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে, জনগণ অন্তত এই আশাটুকু বুকে ধারণ করবে। তিনি বলেন, আইন মন্ত্রণালয় স্বাধীন বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠায় নি¤œ আদালতের শৃঙ্খলা বিধানের দায়িত্ব তাদের হাতে রেখে জনগণের স্বাধীন বিচার বিভাগ প্রাপ্তির অধিকার ুণœ করতে চাচ্ছে। আমাদের নির্বাহী বিভাগ কি এক অদৃশ্য কারণে বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথকীকরণে অনীহা প্রকাশ করে আসছে।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, অ্যাটর্নি জেনারেল ’৭২-এর সংবিধানে ফিরে যেতে না পারায় দুঃখ প্রকাশ করেছেন। আমি বলবো ’৭২-এর সংবিধানে প্রথম আঘাত আজকের সরকারই করেছে। তারাই কিন্তু চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে ’৭২-এর সংবিধান পরিবর্তন করেছেন অথচ অ্যাটর্নি জেনারেল বলছে আমরা ’৭২-এর সংবিধানের ফিরে যেতে পারলাম না। এটা কি তিনি ইচ্ছা করে বলছেন, না অনিচ্ছাকৃতভাবে বলছেন। আমার মনে হয় ওনি সব জেনেশুনে এভাবে কথা বলছেন। তিনি বলেন, আপিল আদালতের নির্দেশনায় কোথায় ’৭২-এর সংবিধানের বরখেলাফ হলো। ’৭২-এর সংবিধানে কি বলা আছে, সেখানে ১১৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, বিচার বিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিদের এবং বিচারবিভাগীয় দায়িত্ব পালনরত ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ (কর্মস্থল নির্ধারণ, পদোন্নতি দান, ছুটি মঞ্জুরি ) ও শৃঙ্খলা বিধান সুপ্রিম কোর্টের ওপর ন্যস্ত থাকিবে। এই সংবিধানের কোথাও বলা নেই সংসদের হাতে থাকবে। তাহলে কেন বিতর্ক সৃষ্টি করা হচ্ছে। সরকার যেসব বেআইনি কাজ করছে বিচার বিভাগ স্বাধীন থাকলে তা করতে পারবে না। সরকার চায় না বিচার বিভাগ স্বাধীন থাকুক।
এ বিষয়ে বিএনপির আইন সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেন, পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে ৯৬ অনুচ্ছেদকে পরিশীলিত ও জবাবদিহিমূলক এবং অধিকতর গ্রহণযোগ্য করা হয়েছে; কেন না চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে ৯৬ অনুচ্ছেদ : রাষ্ট্রপতিকে এককভাবে ক্ষমতাশালী করে, যা বিচার বিভাগের জন্য মারাত্মক হুমকি স্বরূপ ছিল। অতপর পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে প্রধান বিচারপতি এবং জ্যেষ্ঠ দুই বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলে সুপারিশের ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতি সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা পান। এটা অধিকতর স্বচ্ছ বলে আমরা মনে করি। রাষ্ট্রের অ্যাটর্নি জেনারেল যে কথা বলেছেন আমার মনে হয় তিনি তার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। রায়ের আলোকে বিচার বিভাগ নিয়ে দেশবাসীর মধ্যে স্বস্তি ফিরে এসেছে। আমরা দেখেছি ষোড়শ সংশোধনীর সময় পার্লামেন্টে যে ধরনের অপরিশীলিত ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন ‘তুই কেডা’ এতে বোঝা যায় বিচারক অপসারণের ক্ষমতা যদি সংসদের হাতে থাকত তাহলে শুধু বিচার বিভাগ নয় এ জাতির ভাগ্যে নির্মম ও নিন্দনীয় অধ্যায় সূচিত হতো।
তিনি বলেন, ১১৬ অনুচ্ছেদ সংশোধন সময়ের দাবি। কারণ এ অনুচ্ছেদের আলোকে যদিও রাষ্ট্রপতি সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত নেয়ার পূর্বে প্রধান বিচারপতির সাথে পরামর্শ করা বাধ্যতামূলক। কিন্তু এখনো শোনা যায় প্রধান বিচারপতির সাথে পরামর্শ দূরের কথা প্রধান বিচারপতিকে না জানিয়েই রাষ্ট্রপতি বিচার বিভাগ সম্পর্কে নানাবিধ পদক্ষেপ নিয়ে থাকেনÑ যা সংবিধান পরিপন্থী।

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/240936