৩ আগস্ট ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ১০:১৪

অ্যাকসেঞ্চার চলে যাচ্ছে কেন?

মার্কিন বহুজাতিক তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান অ্যাকসেঞ্চারের বাংলাদেশ ছাড়ার কারণ মোবাইল ফোন অপারেটর গ্রামীণফোনের সঙ্গে ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব। ২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশে এসেছিল গ্রামীণফোনের সঙ্গে চুক্তি করে। চুক্তির শর্ত ছিল, গ্রামীণফোন ও তার মূল বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান টেলিনরের তথ্যপ্রযুক্তি (আইটি) বিষয়ক সব কাজ করবে অ্যাকসেঞ্চার। কিন্তু চার বছর পরে এসে চুক্তি বাড়াতে গ্রামীণফোনের অনাগ্রহের কারণে বাধ্য হয়ে বাংলাদেশ থেকে চলে যাচ্ছে অ্যাকসেঞ্চার।

ব্যবসা গুটিয়ে নেওয়ার ঘোষণা ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠানটিতে কর্মরত ৫৫৬ কর্মীকে জানিয়ে দিয়েছে অ্যাকসেঞ্চার বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ। কর্মীদের দেনা-পাওনা মিটিয়ে আগামী ৩০ নভেম্বরের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে চলে যাওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে এখন কাজ করছে প্রতিষ্ঠানটি।
খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এ ঘটনায় আইটি খাতে বাইরের বিশ্বে ভাবমূর্তি-সংকটে পড়বে বাংলাদেশ। কারণ অ্যাকসেঞ্চার একটি ‘ফরচুন ৫০০’ তালিকাভুক্ত কোম্পানি। এ রকম একটি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ছেড়ে গেলে ভবিষ্যতে যেসব বহুজাতিক কোম্পানি এ দেশে বিনিয়োগ করতে আসবে তাদের কাছে ভুল বার্তা যাবে।
যুক্তরাষ্ট্রে আয়ের দিক থেকে এগিয়ে থাকা ৫০০ কোম্পানি নিয়ে দেশটির ম্যাগাজিন ফরচুনপ্রতিবছর যে তালিকা প্রকাশ করে সেটিকে বলা হয় ফরচুন ৫০০। বিশ্বের ১২০টি দেশে বর্তমানে অ্যাকসেঞ্চারের কার্যক্রম আছে। ২০১৬ সালে প্রতিষ্ঠানটির আয়ের পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ২০০ কোটি মার্কিন ডলার।
২০১৩ সালে গ্রামীণফোনের মূল বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান টেলিনরের মাধ্যমে বাংলাদেশে আসে অ্যাকসেঞ্চার। তখন গ্রামীণফোনের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান জিপিআইটির ৫১ শতাংশ শেয়ার কিনে নেয় প্রতিষ্ঠানটি। নতুন কোম্পানির নাম হয় অ্যাকসেঞ্চার কমিউনিকেশনস ইনফ্রাস্ট্রাকচার সলিউশনস লিমিটেড (এসিআইএসএল)। নতুন গঠিত কোম্পানির ৪৯ শতাংশ শেয়ার নিজের কাছে রেখে দেয় গ্রামীণফোন। এর আগে ২০১০ সালে গ্রামীণফোনের আইটি বিভাগে কর্মরত ২৭০ কর্মীকে নিয়ে জিপিআইটি নামের আলাদা একটি কোম্পানি তৈরি করা হয়। সেটিই ২০১৩ সালে এসে এসিআইএসএলে পরিণত হয়।
চুক্তি অনুযায়ী অ্যাকসেঞ্চার বাংলাদেশে এত দিন গ্রামীণফোনের আইটিবিষয়ক সব ধরনের কাজ করে আসছিল। এশিয়ায় কার্যক্রম থাকা আরও তিনটি দেশ মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও পাকিস্তানে আইটি-সহায়তার কাজ অ্যাকসেঞ্চারের মাধ্যমে দিত টেলিনর। এ ছাড়া নরওয়েসহ ইউরোপের আরও কয়েকটি দেশে টেলিনরের ব্যবসা-সহায়ক বিভিন্ন কাজ (বিজনেস প্রসেস আউটসোর্সিং) করা হতো অ্যাকসেঞ্চার বাংলাদেশ থেকে। কর্মীদের মধ্যে ২০০ জন শুধু গ্রামীণফোনের আইটিবিষয়ক কাজ করতেন, বাকি ৩৫৬ জন টেলিনরের অন্য বাজারের কাজ দেখাশোনা করতেন।
দুই কোম্পানি সূত্রে জানা গেছে, যে মূল্যে অ্যাকসেঞ্চার গ্রামীণফোনকে আইটি সেবা দিত সেখান থেকেই সমস্যার শুরু। শুরুতে কাজ পাওয়ার আশায় অ্যাকসেঞ্চার অপেক্ষাকৃত কম মূল্যে আইটি কাজ করলেও পরে আর কম দামে কাজ করতে রাজি ছিল না। আবার অ্যাকসেঞ্চার তাদের কাজের জন্য যে মূল্য চাচ্ছিল গ্রামীণফোন তা দিতে রাজি হচ্ছিল না। এ অবস্থায় গ্রামীণফোন তাদের আইটি কাজ দেওয়ার জন্য উন্মুক্ত দরপত্র ডাকে। সেখানে অ্যাকসেঞ্চারের চেয়ে কম দর দিয়ে কাজ পায় ভারতের বহুজাতিক আইটি প্রতিষ্ঠান উইপ্রো।
গ্রামীণফোনের বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত চার বছরে অ্যাকসেঞ্চারের কাছে প্রতিষ্ঠানটি ৫৩৪ কোটি টাকার আইটি সেবা নিয়েছে। এর মধ্যে ২০১৩ সালে ১২৬ কোটি, ২০১৪ সালে ১৪১ কোটি, ২০১৫ সালে ১৪৮ কোটি ও ২০১৬ সালে ১১৯ কোটি টাকা পেয়েছে অ্যাকসেঞ্চার। তিন বছর ধরে বাড়লেও গত বছর থেকে গ্রামীণফোন থেকে অ্যাকসেঞ্চারের আয় কমতে শুরু করে।
এসব বিষয়ে জানতে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে গ্রামীণফোনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। ই-মেইলের উত্তরে লিখিতভাবে প্রতিষ্ঠানটি জানায়, এশিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি অনুযায়ী বিভিন্ন কার্যক্রম পুনর্বিন্যাস করতে অ্যাকসেঞ্চার, টেলিনর গ্রুপ ও গ্রামীণফোন একসঙ্গে কাজ করছে। এ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে অ্যাকসেঞ্চার টেলিনর ও গ্রামীণফোনকে যেসব সেবা দিত সেগুলো অভ্যন্তরীণভাবে ও নতুন আইটি প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে করানো হবে। এখানে বহুজাতিক আইটি প্রতিষ্ঠান উইপ্রোর কথা বলা যেতে পারে, যারা গ্রামীণফোনের মাধ্যমে বাংলাদেশে কার্যক্রম শুরুর উদ্যোগ নিয়েছে।
অ্যাকসেঞ্চারের কাজ অন্য প্রতিষ্ঠানকে দেওয়ার বিষয়ে অপারেটরটি জানায়, গ্রামীণফোনের সঙ্গে অ্যাকসেঞ্চারের পাঁচ বছর মেয়াদি চুক্তির শেষ দিকে তা নবায়ন অথবা নতুন প্রতিষ্ঠান খুঁজে পেতে সম্প্রতি কোটেশন আহ্বান (আরএফকিউ) করা হয়। গত তিন বছর অ্যাকসেঞ্চারকে বাংলাদেশে কার্যকর ও টেকসই ব্যবসা হিসেবে দাঁড় করাতে সব পক্ষের চেষ্টার কোনো অভাব ছিল না।
বাংলাদেশ থেকে অ্যাকসেঞ্চারের চলে যাওয়া এ দেশের আইটি খাতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে কি না—এমন প্রশ্নে গ্রামীণফোন বলেছে, অ্যাকসেঞ্চারের বাংলাদেশ থেকে চলে যাওয়া তাদের জন্য যেমন হতাশার, তেমনি তাদের মাধ্যমে উইপ্রোর এ দেশে আসা একই রকম উৎসাহের।
গ্রামীণফোন মনে করে, অ্যাকসেঞ্চারের চলে যাওয়াকে বাংলাদেশের ব্যর্থতার প্রতীক হিসেবে দেখা উচিত নয়। বরং এ দেশে আসতে আগ্রহী অন্যান্য আইটি কোম্পানির জন্য কী ধরনের মেধাবী মানবসম্পদ আছে তার উদাহরণ হিসেবে দেখা উচিত।
গ্রামীণফোনের এমন যুক্তির সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সভাপতি মোস্তাফা জব্বার প্রথম আলোকে বলেন, অ্যাকসেঞ্চার বাংলাদেশ থেকে চলে গেলে ভাবমূর্তির বড় ধরনের একটা সংকট তৈরি হবে। আরও যেসব প্রতিষ্ঠান বা বিনিয়োগকারী বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে চায় বা সরাসরি আসতে চায়, তারা দ্বিতীয়বার ভাববে। বাংলাদেশ যতই সফটওয়্যার ও সেবাপণ্য রপ্তানি করুক না কেন, এই ঘাটতি পুষিয়ে নেওয়া কঠিন হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ ফাহিম মাশরুর বেসিস সভাপতির সঙ্গে একমত পোষণ করে বলেন, অ্যাকসেঞ্চারের চলে যাওয়া আইটিতে বাংলাদেশের ব্র্যান্ডিংকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। এতে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বাইরের বিশ্বে ভাবমূর্তি-সংকটে পড়বে বাংলাদেশ।
এদিকে চাকরি হারানো ও নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তায় আছেন অ্যাকসেঞ্চারের ৫৫৬ জন কর্মী। প্রতিষ্ঠানটির কর্মীদের সংগঠন অ্যাকসেঞ্চার এমপ্লয়িজ ইউনিয়ন বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক শাহীন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ভবিষ্যতে যেসব আইটি কোম্পানি বাংলাদেশে আসতে চাইবে তারা টেলিনর ও অ্যাকসেঞ্চারের দ্বন্দ্বের বিষয়টি মনে রাখবে না। তাদের বিবেচনায় থাকবে অ্যাকসেঞ্চারের বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার বিষয়টি। দেশের আইটি খাতের ভবিষ্যতের জন্য অ্যাকসেঞ্চারের মতো কোম্পানি যাতে চলে না যায়, সে জন্য সরকারের উদ্যোগ নেওয়া উচিত।
এ বিষয়ে জানতে অ্যাকসেঞ্চার বাংলাদেশের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে প্রতিষ্ঠানটি ই-মেইলের মাধ্যমে জানায়, দ্বিপক্ষীয় চুক্তি অনুসারে এশিয়া ও ইউরোপে বেশ কিছু কার্যক্রম পুনর্বিন্যাসে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে যাচ্ছে টেলিনর গ্রুপ ও অ্যাকসেঞ্চার। এর ফলে টেলিনরকে বর্তমানে দেওয়া এসিআইএসএলের কিছু সুনির্দিষ্ট সেবা স্থানান্তরিত হবে, কিছু তৃতীয় পক্ষের কাছে। এর অংশ হিসেবে এসিআইএসএলের কিছু কর্মী তৃতীয় পক্ষের হয়ে কাজ করারও সুযোগ পাবেন। অন্তর্বর্তী সময়ে সব কর্মীকে যথাযথ সহায়তা দেবে এসিআইএসএল।
অ্যাকসেঞ্চারের কর্মীদের চাকরির বিষয়ে গ্রামীণফোন প্রথম আলোকে জানায়, বাংলাদেশে তাদের লক্ষ্য হচ্ছে গ্রাহকের স্বার্থ ক্ষুণ্ন না করে ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখা। একই সঙ্গে অ্যাকসেঞ্চারে কর্মরতদের মধ্যে যতজন সম্ভব ততজন কর্মীর চাকরির সুযোগ সৃষ্টি করা। উইপ্রোর সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে গ্রামীণফোন সেটি করতে পেরেছে বলে মনে করে।

 

http://www.prothom-alo.com/economy/article/1275116/