৩ আগস্ট ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ১০:০৩

চট্টগ্রাম বন্দর

বেসরকারি আইসিডিতে অন্তহীন ভোগান্তি

চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য খালাসে ব্যবসায়ীদের সময় ও অর্থ সাশ্রয় করতে অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল বেসরকারি কনটেইনার ডিপোর (আইসিডি)। চার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করে এরই মধ্যে গড়ে তোলা হয়েছে ১৮টি আইসিডি। রফতানি কার্যক্রমের প্রায় শতভাগ ও ৩৭ ধরনের আমদানি পণ্য এখন ওঠানামা হয় আইসিডি দিয়ে। বন্দরের কার্যক্রম পরিচালনায় এমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও যথাযথ নজরদারি নেই আইসিডির ওপর। তাই নীতিমালাও মানছে না তারা। ব্যবসায়ীরা বলছেন, স্পর্শকাতর স্থাপনা হলেও আইসিডিতে নেই পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি। কোনোটিতে নেই সীমানাপ্রাচীরও। নিরাপত্তা না থাকায় বেসরকারি আইসিডির খালি কনটেইনারে ঢুকে পড়ছে মানুষ।

গত সোমবারও একটি আইসিডির কনটেইনার থেকে উদ্ধার করা হয়েছে বাবুল ত্রিপুরা নামের এক ব্যক্তিকে। আইসিডিতে খালাস হওয়া পণ্যে এখন ব্যবসায়ীদের সময় লাগছে বেশি। বাড়ছে খরচও। আইসিডির কার্যক্রমে বিরক্ত হয়ে সোমবার ঢাকায় অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে সব আইসিডির লাইসেন্স বাতিল করতে বলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।

২০১৬ সালের জুনে তৈরি হওয়া নতুন নীতিমালায় বন্দর থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে নতুন আইসিডি স্থাপন করতে বলা হয়। এ ছাড়া ১০ একর জায়গাজুড়ে থাকা আইসিডিতে কী পরিমাণ যন্ত্রপাতি থাকতে হবে, নিরাপত্তা নিশ্চিতে কী কী ব্যবস্থা নিতে হবে ইত্যাদি বিষয় তুলে ধরে শর্তাবলি ঠিক করা হয়। এসব শর্ত না মানলে লাইসেন্স স্থগিত রাখারও সুপারিশ করে নীতিমালা প্রণয়ন কমিটি। বন্দর, কাস্টমসহ ব্যবহারকারী বিভিন্ন পক্ষের প্রতিনিধিরা ছিলেন এ কমিটিতে। তবে নীতিমালা তৈরির এক বছর পরও তা বাস্তবায়নে নেওয়া হয়নি কার্যকর কোনো উদ্যোগ। আইসিডির 'লাইসেন্স প্রদান ও নবায়নে' কাস্টম কর্তৃপক্ষ এবং 'অনাপত্তি সনদ' প্রদানে বন্দর কর্তৃপক্ষ দায়িত্বশীল থাকলেও এটির মান উন্নয়নে যথাযথ নজরদারি নেই তাদেরও। অবশ্য শর্ত পূরণ না করায় ১৮টি আইসিডির মধ্যে এসএপিএল, বিএম ও ইনকনট্রেড আইসিডির লাইসেন্স এবার নবায়ন করেনি কাস্টম কর্তৃপক্ষ।

বিজিএমইএর সাবেক প্রথম সহসভাপতি নাসির উদ্দিন চৌধুরী বলছেন, 'দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানগুলো আরও আগে কার্যকর ভূমিকা নিলে বন্দরের সংকট এত তীব্র হতো না। আইসিডিতে খালাস হওয়া পণ্যে অর্থ ও সময় সাশ্রয় হলে তা পুরো সেক্টরে ইতিবাচক প্রভাব ফেলত।' সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের প্রথম যুগ্ম সম্পাদক কাজী মাহমুদ ইমাম বিলু বলেন, 'যন্ত্রপাতির সংকট থাকায় আইসিডিতে পণ্য নিতে গেলে এখন অপেক্ষা করতে হচ্ছে দিনের পর দিন। কিছুদিন আগে ১৯টি কনটেইনার বন্দর থেকে আইসিডিতে নিতে ২০ দিন অপেক্ষা করতে হয়েছে। বিভিন্ন সংস্থার ভাড়া বাবদ এতে আমদানিকারককে বাড়তি পরিশোধ করতে হয়েছে প্রায় সাত লাখ টাকা। অথচ সময় ও অর্থ সাশ্রয় করতেই অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল আইসিডির।

চট্টগ্রাম বন্দরে গত ২৪ জুলাই অনুষ্ঠিত বৈঠকে নৌপরিবহন সচিব অশোক মাধব রায় বলেন, 'বন্দরের কার্যক্রম গতিশীল রাখতে বড় ভূমিকা পালন করতে হবে আইসিডিকে। কিন্তু তারা লাইসেন্সের শর্ত অনুযায়ী যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করছে না।' তবে তার এ বক্তব্যে দ্বিমত পোষণ করে একই বৈঠকে বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপোর (বিকডা) সভাপতি নুরুল কাইয়ুম খান বলেন, 'কারও থেকে কোনো সহায়তা না নিয়েই বেসরকারি আইসিডি প্রতি মাসে গড়ে ৪৫ হাজার টিইইউএস রফতানি কনটেইনার ও ২৬ হাজার আমদানি কনটেইনার হ্যান্ডল করছে। নীতিমালা তৈরির নামে যেসব অযৌক্তিক শর্ত চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, সেগুলো বাতিল করা হোক।'

বন্দরের ওপর চাপ কমাতে ১৯৯৫ সালে কার্যক্রম শুরু হয় আইসিডির। ২০ বছর পর ২০১৬ সালে নীতিমালা তৈরি হয় আইসিডির জন্য। তবে নীতিমালায় যেসব শর্ত যুক্ত করা হয়েছে, তাতে আপত্তি জানিয়ে আগেই পত্র দিয়ে রেখেছে বিকডা। নীতিমালার শর্ত মানতেও তাই আর তাগাদা অনুভব করছে না তারা। অথচ ব্যবসায়ীরা বলছেন, আইসিডি ও বন্দরের মধ্যে সমন্বয়হীনতা থাকায় তাদের পণ্য আমদানির খরচ বাড়ছে। আইসিডিতে পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি না থাকার অভিযোগও করছে তারা প্রতিনিয়ত।

এ প্রসঙ্গে বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম খালেদ ইকবাল বলেন, 'এখন রফতানির পাশাপাশি ৩৭টি আমদানি পণ্যও খালাস করা হচ্ছে আইসিডিতে। তাদের সক্ষমতা থাকলে আমরা পণ্যের সংখ্যা আরও বাড়িয়ে বন্দরের চাপ কমাতাম।' কাস্টমস কমিশনার এ এফ এম আবদুল্লাহ খান বলেন, 'নতুন নীতিমালা অনুযায়ী স্ক্যানার, ফর্ক লিফট, ট্রাক্টর ট্রেইলারসহ হ্যান্ডলিংয়ের যাবতীয় সরঞ্জামও থাকতে হবে তাদের। কিন্তু ১৮টি আইসিডির কোনোটিতেই নেই স্ক্যানার। এ জন্য তিনটি আইসিডির লাইসেন্স নবায়ন করিনি আমরা।'

নীতিমালায় ২০ কিলোমিটার উল্লেখ থাকলেও অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বন্দরের ৫ কিলোমিটারের মধ্যেই নির্মিত আইসিডিগুলো হচ্ছে_ এছাক ব্রাদার্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, চিটাগং কনটেইনার লিমিটেড, কিউএনএস কনটেইনার সার্ভিস লিমিটেড, ট্রান্স কনটেইনার লিমিটেড ও কেঅ্যান্ডটি লজিস্টিক লিমিটেড, সি ফারের লিমিটেড, ফিসকো বাংলাদেশ লিমিটেড ও সামিট এলিয়েন্স পোর্ট লিমিটেড। ৬ থেকে ১০ কিলোমিটারের মধ্যে রয়েছে_ ওশান কনটেইনার লিমিটেড, গোল্ডেন কনটেইনার লিমিটেড, শফি মোটরস, ইনকনট্রেড লিমিটেড। অন্য আইসিডিগুলোর মধ্যে ইকবাল এন্টারপ্রাইজ, পোর্ট লিংক লজিস্টিক সেন্টার লিমিটেড ও কেডিএস লজিস্টিক লিমিটেড যথাক্রমে ১৪, ১৫ ও ১৯ কিলোমিটার দূরে নির্মিত হয়েছে। বন্দরের ১০ কিলোমিটারের মধ্যে আছে নতুন নির্মিত হওয়া আইসিডি ইনকনট্রেড লিমিটেড ও গোল্ডেন কনটেইনার লিমিটেড। এ প্রসঙ্গে বিকডার সচিব রুহুল আমিন সিকদার বলেন, 'নীতিমালা তৈরির আগেই বন্দরের ১০ কিলোমিটারের মধ্যে ১৩টি আইসিডি নির্মিত হয়েছে। অবাস্তব শর্তাবলি যুক্ত করায় ফাইলবন্দি হয়ে আছে নীতিমালা।' স্ক্যানার না থাকলেও প্রতিটি আইসিডিতে প্রয়োজনের অতিরিক্ত সরঞ্জাম রয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।

 

http://bangla.samakal.net/2017/08/03/313587