৩ আগস্ট ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ১০:০১

গণজাগরণের কোনো বিকল্প নেই

‘কাবিখা কোথায় যায় কারা খায়’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন মুদ্রিত হয়েছে বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকায়। ২৪ জুলাই তারিখে মুদ্রিত প্রতিবেদনে বলা হয়, সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলায় টিআর, কাবিখা, কাবিটা ও কর্মসৃজন প্রকল্পের কাজ না করেই টাকা উত্তোলনের অভিযোগ উঠেছে। এমনকি প্রকল্পের কাজ অসম্পূর্ণ রেখেই টাকা ভাগ-বাটোয়ারা করছেন সংশ্লিষ্ট জনপ্রতিনিধিরা। এসব প্রকল্পের কাজের মান নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। নামে প্রকল্প থাকলেও বাস্তবে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না অনেক প্রকল্প। বিশ্বনাথ উপজেলার খাজাঞ্চি ইউনিয়নে ২০১৬-২০১৭ অর্থ বছরে ৩০টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে ৩৬ লাখ ৯৩ হাজার ৭৭৬ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। কিন্তু এখানে অনেক প্রকল্পের কাজ শেষ না করেই অধিকাংশ টাকা তোলা হয়েছে। এছাড়া বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলা যুবলীগের যুগ্ম সম্পাদক বাদশা আলমগীরের বিরুদ্ধে ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ (টিআর নগদ অর্থ) প্রকল্পের কাজ না করে তিন লক্ষাধিক টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। মাঝিরা ইউনিয়নের প্যানেল চেয়ারম্যান উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা তারেক হোসেন সুমন এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন। ওই যুবলীগ নেতা স্থানীয় সংসদ সদস্য এ্যাডভোকেট আলতাব আলীর কাছ থেকে এসব প্রকল্প বাগিয়ে নেন বলে জানা গেছে।

উল্লেখ্য যে, শুধু একটি ঘটনাই নয়, গ্রামীণ দরিদ্র মানুষের দুর্দশা লাঘবে সরকারের টিআর (টেস্ট রিলিফ), কাবিখা (কাজের বিনিময়ে খাদ্য) কর্মসূচিতে বরাদ্দ অর্থের অর্ধেকই চলে যায় প্রভাবশালীদের পেটে। যাদের জন্য প্রকল্প বরাদ্দ করা হচ্ছে তাদের উন্নয়ন না হয়ে উন্নয়ন হচ্ছে যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে সেই দলের কতিপয় নেতা এবং স্থানীয় কিছু অসাধু কর্মকর্তার। তাই এখন জনমনে প্রশ্ন, টিআর-কাবিখা কারা নেয়, কী করে? প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয়, বরাদ্দকৃত অর্থের ৬০ থেকে ৭০ শতাংশেরই কোনো কাজ হয় না। অনেক সময় শতভাগই গায়েব করে দেয়া হয়। টিআর ও কাবিখার বরাদ্দে উন্নয়নের নামে উপজেলা পর্যায়ে গড়ে উঠেছে ‘লুটে খা’ সিন্ডিকেট। নানা কৌশলে প্রশাসনের যোগসাজশে এ লুটপাট ও দুর্নীতি এখন ওপেন-সিক্রেট।
শুধু ‘লুটে খা’ সিন্ডিকেট নয়, ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে রয়েছে ‘আকাশ-বাতাস’ নামে আরও একটি সিন্ডিকেট। ওই সিন্ডিকেটের মূল হোতা এক প্রভাবশালী ব্যক্তির এলাকার বাসিন্দা হওয়ায় তার দাপটে তটস্থ থাকেন মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরের কর্মকর্তারা। এছাড়া তারা বিভিন্ন এমপির ভুয়া ডিও দিয়েও কোটি কোটি টাকার প্রকল্প হাতিয়ে নিচ্ছেন, যা অনেকটাই ওপেন-সিক্রেট। গ্রামীণ উন্নয়ন ও দরিদ্র মানুষের দুর্দশা লাঘবের অর্থ লুটপাট হচ্ছে একশ্রেণীর দুর্নীতিবাজ রাজনীতিক ও কতিপয় অসাধু কর্মকর্তার উদ্যোগে। এসব মেনে নেয়া যায় না। এদের দৌরাত্ম্য বন্ধের দায় সরকার ও প্রশাসনের ওপরই বর্তায়। সেই দায়িত্ব তারা পালন করেন কিনা সেটাই এখন দেখার বিষয়।
গ্রামীণ উন্নয়নের অর্থ যেভাবে লুটপাট হচ্ছে তাতে উপলব্ধি করা যায় সুশাসনের ঘাটতি এবং রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের দৌরাত্ম্য। দৌরাত্ম্যে রাশ না টানায় ওরা এখন বর্বর হয়ে উঠেছে। সম্প্রতি আমরা লক্ষ্য করেছি, রিপোর্টের ওপর চারজনের ছবি এবং ছবির ওপর একটি শব্দ ‘বর্বরতা’। গত ৩০ জুলাই পত্রিকান্তরে প্রকাশিত রিপোর্টটির শিরোনাম ছিল ‘ক্যাডার দিয়ে তুলে নিয়ে ছাত্রী ধর্ষণ।’ বিবরণে উল্লেখ করা হয়, বাড়ি থেকে ক্যাডার দিয়ে তুলে নিয়ে গিয়ে এক ছাত্রীকে ধর্ষণ করেছেন বগুড়া শহর শ্রমিক লীগের আহ্বায়ক তুফান সরকার। বগুড়ার এই প্রভাবশালী নেতা শুধু ধর্ষণ করেই ক্ষান্ত হননি, বিষয়টি ধামাচাপা দিতে দলীয় ক্যাডার ও এক নারী কাউন্সিলরকে ধর্ষণের শিকার মেয়েটির পেছনে লেলিয়ে দেন। ২৮ জুলাই বিকেলে তারা কিশোরী ও তার মাকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে চার ঘণ্টা ধরে নির্যাতন চালান। এরপর দু’জনেরই মাথা ন্যাড়া করে দেন। বগুড়ার পুলিশ সুপার মো. আসাদুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, কিশোরী ও তার মায়ের প্রতি যে আচরণ করা হয়েছে, তা মধ্যযুগীয় বর্বরতাকেও হার মানায়। এটা মানবাধিকারের চরম লংঘন। এর পেছনে যত বড় রাঘববোয়ালই থাকুক না কেন, কেউ রক্ষা পাবে না।
পুলিশ সুপারের এমন বক্তব্যকে আমরা স্বাগত জানাই। কারণ তার বক্তব্যে পুলিশের কর্তব্যবোধ ‘দুষ্টের দমন শিষ্টের পালন’-এর চেতনা স্পষ্ট হয়েছে। তবে দুঃখের বিষয় হলো, অনেক ক্ষেত্রেই পুলিশের এমন চেতনা লক্ষ্য করা যায় না। পুলিশ জানায়, উক্ত ঘটনায় কিশোরীর মা বাদী হয়ে শুক্রবার রাতে শ্রমিক লীগ নেতা তুফান সরকার, তার স্ত্রী আশা সরকার, আশা সরকারের বোন বগুড়া পৌরসভার সংরক্ষিত ওয়ার্ডের নারী কাউন্সিলর মার্জিয়া আক্তারসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে ধর্ষণ ও নির্যাতনের অভিযোগে দু’টি মামলা করেছেন। পুলিশ রাতেই শ্রমিক লীগ নেতা তুফান সরকারসহ কয়েকজনকে গ্রেফতার করেছে। তবে নারী কাউন্সিলর ও তার মা-বোন আত্মগোপন করেছেন। এদিকে নির্যাতিত মা-মেয়েকে অসুস্থ অবস্থায় বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক মোতালেব হোসেন বলেন, মেয়েটির শরীরের সাত-আট স্থানে রড বা লাঠির আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। মাথা ন্যাড়া করে দেয়া হয়েছে। ডাক্তারি পরীক্ষায় ধর্ষণের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যাবে।
দেশে দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতি যেন ক্রমেই প্রসারিত হচ্ছে। নইলে তুফান সরকারের মত মানুষ কী করে শ্রমিক লীগের আহ্বায়ক হয়? আর নারী কাউন্সিলর হয়ে মার্জিয়া আক্তার কী করে ধর্ষকদের পক্ষ নিয়ে কিশোরী ও তার মাকে নির্যাতন করে? তারা ক্যাডার পাঠিয়ে তুলে এনে কিশোরী ও তার মাকে শুধু নির্যাতন করেই ক্ষান্ত হননি, সাদা কাগজে সই নিয়ে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বগুড়া ছেড়ে যেতে বলেন। আর না গেলে অ্যাসিড দিয়ে ঝলসে দেয়ার হুমকি দেন। এমন দৌরাত্ম্যকে নিয়ন্ত্রণ না করলে মানুষ সমাজে বসবাস করবে কীভাবে? পুলিশ তো ঘটনা জেনেছেন, আসামীদের গ্রেফতার করেছেন, মামলাও হয়েছে। এখন দেখার বিষয় হলো, ঘটনা যৌক্তিক পরিণতির দিকে যায় কিনা। তবে আমরা আশা করি আলোচ্য ঘটনায় নির্যাতিত কিশোরী ও তার মা সুবিচার পাবেন এবং পুলিশ দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনের ক্ষেত্রে উজ্জ্বল উদাহরণ সৃষ্টি করবেন।
অতীতেও আমরা লক্ষ্য করেছি, যখন একটি অপরাধের ঘটনা মিডিয়ায় ফলাও করে প্রচার করা হয় তখন সমাজে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। এমন বাস্তবতায় সরকার ও প্রশাসন নড়েচড়ে বসে। অপরাধীর বিচারও হয়। কিন্তু তারপর? আবার লক্ষ্য করা যায় আগের চালচিত্র। এখানে বলার মতো কথা হলো, বিদ্যুৎ কেন্দ্রে লাইন থাকলে বাতি জ্বলবেই। আর ক্ষমতার কেন্দ্রে দুর্বৃত্তদের প্রশ্রয় থাকলে তারা জ্বলে উঠবেই। রাজনীতির লক্ষ্য যদি হয় ক্ষমতা দখল তাহলে এক তুফান জেলে গেলে আরো বহু তুফান পাওয়া যাবে। এরা ক্ষমতার সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহৃত হবে, আবার ক্ষমতায় ভাগও বসাবে এবং তরা সমাজে চালাবে নানা অনাচার। বর্তমান সময়ে তুফানদের সৃষ্টি আসলে রাজনীতির সাথে জড়িয়ে গেছে। বলা চলে সংকটের মূলে রয়েছে আদর্শহীন ভ্রষ্ট রাজনীতি। তাই সংকটের সুরাহায় প্রয়োজন আদর্শভিত্তিক গণবান্ধব রাজনীতি।

 

http://www.dailysangram.com/post/294492-