৩ আগস্ট ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ৯:৫৫

গদ্যকার্টুন

ছাগল মরিয়া প্রমাণ করিল সে মরে নাই

ছাগলের কথা ভুলিয়াই গিয়াছিলাম। ছাগল যে আছে, এই তথ্য মনে করিবার কোনো প্রসঙ্গ ছিল না। ছাগলও ছিল, কাঁঠালপাতাও নিশ্চয়ই ছিল, কিন্তু চারদিকে এত পাগল যে ছাগলের কথা ভাবিবার অবকাশই পাইতেছিলাম না। অবশেষে ছাগল মরিল এবং প্রমাণিত হইল, এই দেশে ছাগল মরে নাই, মরিবে না, ছাগল আছে, ছাগল থাকিবে, তাহারা ছাগসংগীত প্রচার করিবে।
ছাগল যে ছাগল তাহার উৎকৃষ্ট প্রমাণ যে সে মরিবার আর কোনো টাইম পাইল না। তাহার স্থান-পাত্র-কালজ্ঞান নাই। ওহে ছাগল, তুমি কি জানিতে না তোমাকে দান হিসেবে দুস্থ ব্যক্তিকে দিয়াছেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ। তোমার সাত পুরুষের ভাগ্য যে প্রাণিমন্ত্রী স্বয়ং তোমাকে সহস্র প্রাণীর মধ্য হইতে বাছাই করিয়াছেন দান করিবার জন্য, আর প্রদত্ত হইবার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তুমি মরিয়া গেলে! ব্যাটা ছাগল, মরিবার সময় জানে না, কাহার হাত হইতে কাহার ঘরে গিয়া মরিতে হয়, সেই বোধ তাহার হইল না। দিনে গিয়াছ গরিবের ঘরে, রাতেই তোমার ভ্যাভ্যালীলা সাঙ্গ হইল। মরিবার আগে তোমার হুঁশ হইল না যে তুমি যেমন তেমন ছাগল নহ! প্রাণিমন্ত্রী তোমার দড়ি ধরিয়াছেন, তুমি তেমনি ছাগল।
বাঘে ছুঁইলে এক ঘা, মন্ত্রী ছুঁইলে দুই ঘা, কিন্তু মন্ত্রীর চ্যালা ছুঁইলে? বত্রিশ ঘা। এখন বোঝো। মরিয়াও তুমি শান্তি পাইলে না। সংবাদমাধ্যমে খবর হইল, ছাগল মারা গিয়াছে। আর সেই খবর এক কমবুঝ সাংবাদিক ফেসবুকে শেয়ার করিয়া দিল। অমনি প্রমাণ হইয়া গেল, ছাগল মরে নাই।
আরেক সাংবাদিক ফেসবুক-শেয়ারারের বিরুদ্ধে আইসিটি আইনের ৫৭ ধারায় মামলা ঠুকিয়া দিল। কত যদুমধু কত বড় বড় কারণে মামলা করিতে চাহিয়া মামলা করিতে পারে না, থানা-পুলিশ, আদালতের বারান্দায় ঘুরিয়া স্যান্ডেল ক্ষয় করে, কাহারও বা ঘরে কেহ আগুন দিয়াছে, কাহারও বা জমি বেদখল হইয়াছে, কাহারও সন্তান নিখোঁজ, সেই সব মামলা নথিভুক্তই হইতে চাহে না, কত মামলার আসামি পুলিশের অনুষ্ঠানে ফুলের মালা গলায় পরে, কেহ তাহাদের রোম স্পর্শ করে না, কিন্তু এই মামলা তো মানুষ লইয়া নহে, এই মামলা ছাগল লইয়া, কাজেই তাহার গুরুত্ব অপরিসীম, মর্যাদা ভীষণ। ফেসবুকে খবর শেয়ারকারী সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করিতে তাই বিন্দুমাত্র কালক্ষেপণ হইল না। পুলিশের পা রকেটের বেগে নড়িল, হাত ঝড়ের বেগে ছুটিল, সাংবাদিক গ্রেপ্তার হইলেন। হুঁ হুঁ। ইহাকেই বলে ৫৭ ধারা। ছাগল দিল কে, পাইল কে, মরিল কে, মান গেল কার, ব্যথা পাইল কাহার হৃদয়, মামলা করিল কে, গ্রেপ্তার হইল কে। ইহার নাম ৫৭ ধারা। ইহা ঝড়ের মতো বেগসম্পন্ন, আগুনের মতো লেলিহান, লোহার মতো শক্ত, কোরামিনের মতো কার্যকর। অব্যর্থ, অদ্বিতীয়, সফলতা শতভাগ, বিফলে মূল্য ফেরত।
অতএব, হে ছাগল, তুমি মরিয়া প্রমাণ করিয়াছ, ছাগল মরে নাই। ছাগলেরা মরে না। ছাগলেরা মরিবে না। ছাগলেরা আছে। নানারূপেই আছে। ইশপের গল্পে পড়িয়াছি, একদিন এক নেকড়ে এক গর্তে পড়িয়া গেল। তাহার আর উঠিবার উপায় নাই। তখন সে অপেক্ষা করিতে লাগিল ছাগলের জন্য। একসময় সত্যি সত্যি এক ছাগল গর্তের কাছে আসিলে নেকড়ে বলিল, ভাই ছাগল, নিচে আইসো, দেখো, কত সুন্দর পানি এইখানে। আইসো, পানি পান করো, জীবন ধন্য করো। ছাগল কিছু না ভাবিয়া নিচে লাফ দিয়া পড়িল। নেকড়ে ছাগলের ঘাড়ে পা দিয়া গর্ত হইতে বাহির হইয়া আসিল। বিদায় লইবার আগে সে ছাগলকে উপদেশ দিতে ভুলিল না। বলিল, লুক বিফোর ইউ লিপ, লাফ দিবার আগে দেখিয়া লইও।
আমরা এই কথা কাহাকে বলি। আমরা তো লাফাইবার আগে চারদিকে দেখি, এক পা ফেলিবার আগে দেখি, নিজের ঘরে বসিয়াও চমকিয়া উঠি। কাহার মানে খোঁচা লাগিল, কাহার মানে টোল পড়িল, কাহাকে আঘাত দিয়া ফেলিলাম, কাহাকে আবার নীতিভ্রষ্ট করিয়া বসিলাম। আছেই তো ৫৭ ধারা।
ইশপ আরেক ছাগলের গল্প বলিয়া গিয়াছেন। তাহার বন্ধুত্ব ছিল নেকড়ের সহিত। একদিন সে এক জলাশয়ের ধারে গিয়া পানিতে নিজের প্রতিবিম্ব দেখিল। হায় হায়, আমার কী সুন্দর শিং, লম্বা দাড়ি, তেলচিক্কন নধরকান্তি, নেকড়ের চাইতে আমি ঢের বেশি সুদর্শন, আমি কেন নেকড়েকে এত দিন উত্তম ভাবিয়া আসিয়াছি—সে বলিল। নেকড়ে তাহা শুনিয়া ফেলিল। বলিল, ‘ছাগল, তুমি কী কহিলে?’
‘কিছুই বলি নাই।’
‘অবশ্যই বলিয়াছ। কেন আমি উত্তম, তাহা এবার আমি প্রমাণ করিব। আইসো।’
নেকড়ে ছাগলকে খাইয়া ফেলিল।
এই দেশে বন্ধুবেশী নেকড়েরা এখন বন্ধুবেশী ছাগলের উপর ঝাঁপাইয়া পড়িবে। নেকড়ের আছে নখর আর দন্ত, আর উহাদের আছে ৫৭ ধারা। এই ৫৭ ধারা আবার কোনো কোনো মন্ত্রীর খুবই প্রিয়। ওই মন্ত্রীরা জানেন, জনগণকে যাহাই খাওয়ানো হইবে, তাহাই খাইবে।
ভাই ছাগল, তুমি আর মরিয়ো না। তুমি মরিলে কেহ না কেহ নিউজ করিবে, কাহারও না কাহারও মানে লাগিবে, কেহ না কেহ ৫৭ ধারার কোপ বসাইয়া দিবে।
এক ছাগল এক আঙুরগাছের পাতা খাইতেছিল। আঙুর গাছ বলিল, ‘খাইতেছ খাও, কিন্তু দুই দিন পরে যখন তুমি কসাইয়ের ছুরির নিচে যাইবে, তখন আমার লতাপাতা হইতে শিশির ঝরিবে, একমাত্র আমিই তোমার শোকে কাঁদিব।’
আঙুরগাছ একেবারেই ভেজিটেবল, তাহার ব্রেন নাই। থাকিলে সে ইহা বলিত না। চাপিয়া যাইত। এখন ৫৭ ধারার যুগ, এখন এক ফোঁটা অশ্রু ঝরাইলেও কাহারও মানহানি ঘটিতে পারে, কেহ নীতিভ্রষ্ট বোধ করিতে পারে, আর তিনি যদি ক্ষমতাবানের চ্যালা-চামুন্ডা, নেতার হাতা হইয়া থাকেন, তাহা হইলে আইন কেবল তাহার নিজের গতিতে চলিবে না, আলোর গতিতে ছুটিবে।
এক ছাগলের মৃত্যু এত ছাগলকে জাগাইয়া তুলিল। ছাগল মরিয়া প্রমাণ করিল, ছাগলেরা মরে নাই।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।

http://www.prothom-alo.com/opinion/article/1275076/