২ আগস্ট ২০১৭, বুধবার, ১০:১৫

এক বছরে ৭০ হাজার কোটি টাকার ঋণ নবায়ন

চাপ সৃষ্টি হচ্ছে ব্যাংক ব্যবস্থার ওপর

ব্যাংকের ঋণ নবায়ন বেড়েই চলছে। শুধু গত বছরেই ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়েছে ৭০ হাজার কোটি টাকার, যা মোট ঋণের সাড়ে ১০ শতাংশ। ঋণ নবায়ন বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংক ব্যবস্থার ওপর চাপ সৃষ্টি হচ্ছে বলে মনে করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য দেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক সূত্র জানিয়েছে, গত কয়েক বছরে দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থায় চলছে ঋণ নবায়নের হিড়িক। কোনো রকম নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে কিছু ব্যাংক ঋণ নবায়ন করে চলছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী, কোনো খেলাপি ঋণ নবায়ন করতে হলে খেলাপি ঋণের কমপক্ষে ১৫ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিতে হয়। তবে গত কয়েক বছর ধরে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এ নিয়ম মানা হয়নি। আর এটি করা হয়েছে অনেকটা বাংলাদেশ ব্যাংকের মৌখিক নির্দেশে। যেমন, বছর দুয়েক আগে বছরের শেষ প্রান্তে এসে বলা হয়, যেকোনো উপায়ে খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনতে হবে। এ জন্য যেসব ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেশি ওই সব ব্যাংকে এ অনুমোদন দেয়া হয়। এ নির্দেশনা পেয়ে ছুটির দিনেও সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদের বৈঠক ডেকে কোনো রকম ডাউন পেমেন্ট না নিয়েই ঋণ নবায়ন করার সুযোগ করে দেয়া হয় খেলাপিদের। এর পরের বছর ঋণ পুনর্গঠনের নামে বড় বড় ঋণ খেলাপিদের বিশেষ ছাড় দেয়া হয়। এ জন্য ওই সময় ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ থেকে এ-সংক্রান্ত একটি সার্কুলার জারি করা হয়। এতে বলা হয়, ৫০০ কোটি ও এক হাজার কোটি টাকার ওপরে ঋণ খেলাপিরা মাত্র ২ ও ১ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে ঋণ নবায়নের সুযোগ পাবেন। একই সাথে সুদের হারেও বিশেষ ছাড় দেয়া হয়। এ নির্দেশনার পর ১৪টি ব্যবসায়ী গ্রুপের প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ নবায়ন করা হয়। এ ভাবেই ঋণ নবায়নের মহোৎসব চলে ব্যাংকিং খাতে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়ায় স্ট্যাবিলিটি বিভাগ থেকে সর্বশেষ প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাম্প্রতিক সময়ে ঋণ নবায়নের কারণে ব্যাংক ব্যবস্থার ওপর চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। গত ডিসেম্বর শেষে ঋণ নবায়ন হয়েছে মোট বকেয়া ঋণের সাড়ে ১০ শতাংশ। ডিসেম্বর প্রান্তিকে ব্যাংকিং খাতে মোট বকেয়া ঋণ ছয় লাখ ৭৩ হাজার ৭২০ কোটি টাকা। এর সাড়ে ১০ শতাংশ হলো ৭০ হাজার ৭৪০ কোটি টাকা। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে নবায়ন হওয়া ঋণের ৭৫ দশমিক ৮ শতাংশ হলো অশ্রেণীকৃত। সে হিসাবে ৫৩ হাজার ৬২১ কোটি টাকা হলো অশ্রেণীকৃত। বাকি প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকাই খেলাপি।
দেশের প্রথম প্রজন্মের একটি ব্যাংকের এমডি জানিয়েছেন, তৈরি পোশাক খাতের শিল্প স্থাপনে একজন উদ্যোক্তাকে কয়েকটি ব্যাংক মিলে প্রায় শত কোটি টাকা ঋণ দেয়া হয়েছিল। ঋণ নিয়ে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি করা হয়েছে। অবকাঠামোও নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু গ্যাস সংযোগ না পাওয়ায় ওই শিল্প তিন বছর ধরে চালু হচ্ছে না। আর শিল্প চালু না হওয়ায় সংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তার সাথে বিপাকে পড়েছে ব্যাংকও। একদিকে সংশ্লিষ্ট শিল্প উদ্যোক্তার কাছ থেকে ঋণ আদায় করতে পারছেন না। ফলে এ ঋণ এখন খেলাপি হয়ে গেছে। গত ২০১৪ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রায় ডাউন পেমেন্ট ছাড়াই ঋণ নবায়নের সুযোগ দিয়েছিল। এর পরের বছর ঋণ পুনর্গঠনের নামে ঋণখেলাপিদের বিশেষ ছাড় দেয়ার মাধ্যমে ঋণ নবায়ন করা হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই এমডি জানিয়েছেন, শুধু তার ব্যাংকেই নয়, এ রকম ঘটনা আরো অনেক ব্যাংকেই আছে। এর পাশাপাশি ব্যবসায়-বাণিজ্য মন্দার কারণে কয়েকটি খাতের উদ্যোক্তারা ব্যাংকের কোনো ঋণই পরিশোধ করতে পারছেন না। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো আবাসন খাত। আবাসন খাতে ঋণ দিয়ে অনেক ব্যাংকেরই খেলাপি ঋণ বেড়ে যাচ্ছে। আর্থিক অবস্থার কারণে পুরো তৈরি ফ্ল্যাট বিক্রি হচ্ছে না। এভাবে অনেক উদ্যোক্তাই পথে বসে গেছেন। না পারছেন ব্যবসায় করতে, না পারছেন ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করতে।
গতকাল আরো কয়েকটি ব্যাংকের এমডির সাথে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। তারা বলেন, বিশেষ সুবিধা দিয়ে অর্থাৎ নামমাত্র ডাউন পেমেন্ট নিয়ে যেসব ঋণ গত সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে নবায়ন করা হয়েছিল, পরবর্তী তিন মাসে তা পরিশোধ হয়নি। এর ফলে বেশির ভাগ নবায়কৃত ঋণই এখন খেলাপিতে পরিণত হচ্ছে। এর বাইরে বিশ্বাসের ভিত্তিতে যেসব ঋণ (এলটিআর) বিতরণ করা হয়েছিল ওই সব ঋণও আদায় হচ্ছে না। বিভিন্নভাবে ব্যাংকগুলো এখন তা অনেকটা নিয়ম বহির্ভূতভাবে এসব ঋণ মেয়াদি ঋণে রূপান্তর করে নবায়ন করেছে। কিন্তু পরবর্তীতে আদায় না হওয়ায় ওই সব ঋণও এখন খেলাপি হয়ে গেছে। এভাবেই ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, গত মার্চ শেষে ঋণ অবলোপনসহ ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় সোয়া লাখ কোটি টাকা।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/240835