২ আগস্ট ২০১৭, বুধবার, ৯:৪৩

রাজশাহী পলিটেকনিকে ছাত্রলীগের তাণ্ডব

তালিকা দেওয়ার পরও ৪২ শিক্ষার্থী অকৃতকার্য হওয়ার জের ধরে রাজশাহী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে ব্যাপক ভাঙচুর চালিয়েছে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। গতকাল মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১১টার দিকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির মিলনায়তনে এক অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর এ তাণ্ডব চালানো হয়।

ছাত্রলীগ নেতারা বলছেন, ওই অনুষ্ঠানে তাঁদের বক্তব্য দিতে না দেওয়ায় সংগঠনের কর্মীরা ক্ষুব্ধ হয়ে ভাঙচুর করেছে।
অন্যদিকে ইনস্টিটিউট কর্তৃপক্ষ বলছে, ছাত্রলীগ ৪০০ শিক্ষার্থীর তালিকা দিয়ে তাদের সবাইকে পাস করিয়ে দিতে বলেছিল। এ তালিকার ৪২ জন অকৃতকার্য হওয়ার জের ধরেই সংগঠনটির নেতাকর্মীরা এ তাণ্ডব চালিয়েছে।
ইনস্টিটিউটের প্রথম পর্বের শিক্ষার্থীদের পরিচিতি অনুষ্ঠান ছিল গতকাল সকালে। দুপুরে ছিল দ্বিতীয় পর্বের শিক্ষার্থীদের পরিচিতি অনুষ্ঠান ও অভিভাবকদের সঙ্গে মতবিনিময়সভা। তবে ভাঙচুরের কারণে পরের অনুষ্ঠানটি আর হয়নি।
জানা গেছে, পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মেহেদী হাসান রিমেল (রিগেন) ও রাশেদ রহমানের নেতৃত্বে মিলনায়তনে ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। খবর পেয়ে পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
এ ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে গতকাল রাতেই ইনস্টিটিউট কর্তৃপক্ষের অভিযোগ দায়েরের কথা নগরীর বোয়ালিয়া থানায়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, গতকাল সকাল সাড়ে ৯টায় ইনস্টিটিউটের প্রথম বর্ষে ভর্তি হওয়া নতুন শিক্ষার্থীদের পরিচিতিসভার আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠান চলা অবস্থায় সকাল সাড়ে ১০টার দিকে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মেহেদী হাসান রিমেল (রিগেন) ও রাশেদ রহমান মিলনায়তনে প্রবেশ করেন। তাঁরা ঢুকেই শিক্ষকদের কাছে জানতে চান, কেন তাঁদের ছাড়াই অনুষ্ঠান করা হলো? তাঁরা অনুষ্ঠান দেরিতে শুরু করতে বলার পরেও কেন আগেভাগেই করা হলো? তখন শিক্ষকরা ছাত্রলীগের নেতাদের জানান, অনুষ্ঠান সময়মতোই শুরু হয়েছে। গরমের কারণে সেটা শেষ হতেও চলেছে। তার পরও ছাত্রলীগের নেতারা বক্তব্য দিতে চাইলে তাঁরা দিতে পারেন। এরপর আর কোনো কথা না বলে ছাত্রলীগের ওই দুই নেতা মিলনায়তন ছেড়ে চলে যান।
প্রত্যক্ষদর্শী শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা জানান, ছাত্রলীগ নেতা রিগেন ও রাশেদ চলে যাওয়ার পরপরই মিছিল শুরু করে সংগঠনটির নেতাকর্মীরা। পরিস্থিতি ভালো নয় দেখে অনুষ্ঠান শেষ করে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা মিলনায়তন থেকে বের হয়ে যান। বন্ধ করে দেওয়া হয় মিলনায়তন। সকাল ১১টার দিকে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা মিছিল করে মিলনায়তন কক্ষের তালা ভেঙে ভেতরে ঢুকে ভাঙচুর শুরু করে। তারা মিলনায়তনের মঞ্চ, ভাড়া করে আনা চেয়ার-টেবিল, ফ্যান, জানালার কাচ ও বাল্প ভাঙচুর করে। পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার আগেই অনুষ্ঠানস্থলের সব কিছু ভেঙে তছনছ করে তারা।
জানা গেছে, অনুষ্ঠানের জন্য নগরীর শালবাগান বাজারের শাপলা ডেকোরেটর থেকে ৬৪০টি চেয়ার ও ছয়টি ফ্যান ভাড়া করে আনা হয়। সেই সঙ্গে অনুষ্ঠানের মঞ্চও তৈরি করে শাপলা ডেকোরেটর। এ ছাড়া ইনস্টিটিউটেরও অন্তত ৫০টি চেয়ার ও দুটি ফ্যান ছিল। সব কিছুই ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।
ডেকোরেটর মালিক ফরহাদ হোসেন দাবি করেন, তাঁদের পাঁচ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে।
ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ ফরিদ উদ্দিন বলেন, ‘ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নেতৃত্বেই এ হামলা চালানো হয়। এ ঘটনায় ব্যবস্থা নিতে আমরা কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছি। ’ তিনি জানান, দ্বিতীয় পর্বের পরীক্ষায় পাস করানোর জন্য ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক মিলে অন্তত ৪০০ জন শিক্ষার্থীর তালিকা দেন প্রতিটি বিভাগের প্রধানদের। এর মধ্যে ৪২ জন শিক্ষার্থী অকৃতকার্য হওয়ায় ছাত্রলীগের ওই নেতারা ক্ষুব্ধ হন। গত সোমবার সকালেও এসে তাঁরা হুমকি দিয়ে গেছেন। ছাত্রলীগের দেওয়া পরীক্ষার্থীর তালিকাও কালের কণ্ঠকে দেখান অধ্যক্ষ।
পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট সূত্রে জানা গেছে, গত জুন-জুলাইয়ে দ্বিতীয় পর্বের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এ পরীক্ষায় মোট ৯৪০ জন শিক্ষার্থী অংশ নেয়। গত রবিবার ফল প্রকাশ করা হয়।
একাধিক শিক্ষক বলেছেন, নিয়ম অনুযায়ী পাস করতে হলে শতকরা ৪০ নম্বর পেতে হবে। দ্বিতীয় পর্বে ৯৪০ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে পাস করেছে মাত্র ১৮১ জন। অকৃতকার্য হয় ৪২৫ জন। আর রেফার্ড লাভ করে (এক থেকে দুই বিষয়ে অকৃতকার্য) ৩৩৩ জন। ছাত্রলীগের নেতাদের চাপে যারা ১০ পেয়েছে তাদেরও পাস করিয়ে দিতে বাধ্য হন শিক্ষকরা। এর পরও ৪২ জন শিক্ষার্থী অকৃতকার্য হয়।
একাধিক শিক্ষক-শিক্ষার্থী অভিযোগ করে জানায়, পরীক্ষায় পাস করিয়ে দেওয়ার কথা বলে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ব্যাপক ‘বাণিজ্য’ করে থাকে। এমনকি পরীক্ষার হলে শিক্ষকরা যেন ঠিকমতো দায়িত্ব পালন না করতে পারেন সে জন্য হুমকি দেওয়া হয়।
ছাত্রলীগের দেওয়া তালিকা ধরে এক শিক্ষার্থীকে ফোন করা হলে সে নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলে, পরীক্ষায় পাস করিয়ে দেওয়ার কথা বলে তার কাছ থেকে ছাত্রলীগের এক নেতা দুই হাজার টাকা নিয়েছেন। তবে সে পাস করেনি।
জানা গেছে, পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মেহেদী হাসান রিমেল ওরফে রিগেন ও সাধারণ সম্পাদক রাশেদ রহমানের ছাত্রত্ব দুই বছর আগেই শেষ হয়েছে। কিন্তু তার পরেও তাঁরা পদ ধরে রেখেছেন শুধু চাঁদাবাজি করার জন্য।
ছাত্রত্ব শেষ হওয়ার কথা স্বীকারও করেছেন দুই ছাত্র নেতা। তবে তাঁরা চাঁদাবাজির কথা অস্বীকার করেছেন। তাঁরা কালের কণ্ঠকে বলেন, তাঁরা কারো কাছ থেকে টাকা নেননি। তবে নিজেদের কয়েকজন কর্মীকে পাস করিয়ে দিতে বিভাগীয় প্রধানদের কাছে তালিকা দিয়েছিলেন তাঁরা।
ভাঙচুরের বিষয়ে ইনস্টিটিউট শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ রহমান বলেন, ‘অনুষ্ঠানে আমাদের কোনো বক্তব্য দিতে দেওয়া হয়নি। আবার আগস্ট মাস শোকের মাস হলেও নীরবতা পালন করা হয়নি। সেই সঙ্গে এখানে কোনো রাজনীতি করা যাবে না বলে অধ্যক্ষ ঘোষণা দেন। এসব কারণে ক্ষুব্ধ হয়ে কিছু কর্মী অডিটরিয়ামে প্রবেশ করে কয়েকটি চেয়ার ভাঙচুর করেছে। ’
পরীক্ষার ফলের সঙ্গে ভাঙচুরের ঘটনার সম্পর্ক নেই বলে দাবি করেছেন সংগঠনের সভাপতি মেহেদী হাসান রিমেল।

 

http://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2017/08/02/526771