২ আগস্ট ২০১৭, বুধবার, ৯:৩৭

গরমেও জ্বলছে না চুলা

বাড়ছে দাম, কমছে গ্যাস

রাজধানী ঢাকায় বাসাবাড়িতে গ্যাসের সংকট নতুন কিছু নয়। তবে আগে ছিল শুধু শীতকালে, এখন সারাবছর। গ্যাসের দাম চলতি বছর দেড় গুণ বাড়লেও গৃহিণীদের দুর্ভোগ কমেনি, বরং বেড়েছে। তিতাসের পাইপলাইন গ্যাস সুবিধা থাকা সত্ত্বেও রাজধানীর বহু এলাকায় এখন সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছেন গৃহিণীরা। কারণ তিতাসের গ্যাস সারাদিনই থাকে না। অনেকেই বলছেন, তারা বড় বিপাকে আছেন। কারণ তিতাসের লাইনের গ্যাস না পেলেও প্রতিমাসে তাদের বিল গুনতে হচ্ছে ৯৫০ টাকা। এদিকে সিলিন্ডার গ্যাসের পেছনেও মাসে গুনতে হচ্ছে তিন থেকে চার হাজার টাকা।

উত্তরার দক্ষিণখানের ২৪২ নাহার ভিলার বাসিন্দা তাহেরা বেগম ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বললেন, কখন গ্যাস আসবে সেই চিন্তায় রাতে ঘুমাতে পারেন না। বাচ্চাদের স্কুল টিফিনে বাইরের খাবার দিতে হয়। গ্যাসের অভাবে রান্না করা যায় না। রামপুরার শিমুলবাগের আলী আকবর একই ধরনের দুর্ভোগের কথা জানিয়ে বলেন, রান্না তো চলে মূলত সিলিন্ডারের গ্যাসে। কিন্তু মাস শেষে তিতাসকে ঠিকই বিল দিতে হচ্ছে। এ বছর আবার দুই দফায় গ্যাসের বিল দেড় গুণ বেড়েছে। কিন্তু গ্যাসের সরবরাহ বাড়েনি, বরং কমেছে। আগে শীতকালে গ্যাসের সমস্যা হতো, এখন সারাবছরই একই সমস্যা।

শুধু দক্ষিণখান বা রামপুরাই নয়, রাজধানীর অনেক এলাকায় এখন গ্যাস সংকট স্থায়ী রূপ নিয়েছে। গত দুই বছর ধরে ঢাকার কয়েকটি এলাকায় সারাবছর ধরেই গ্যাসের সংকট দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে মিরপুরের শেওড়াপাড়া, কাজীপাড়া, কাফরুল, পশ্চিম আগারগাঁও, মোহাম্মদপুর, আদাবর, পশ্চিম ধানমণ্ডি, লালবাগ, সোবহানবাগ, পুরান ঢাকার তাঁতীবাজার, শাঁখারীবাজার, কামরাঙ্গীর চর, উত্তরা, দক্ষিণখান, উত্তরখান, যাত্রাবাড়ীর একাংশ, দক্ষিণ বনশ্রী, রামপুরার শিমুলবাগ, আশিষ লেন ও উলন রোড এলাকায় গ্যাসের ভয়াবহ সমস্যার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এসব এলাকায় সারাদিন চুলা জ্বলে না। জ্বললেও মিটমিট করে। কোথাও সকালেই গ্যাসের চাপ কমে যায়। আসে দুপুরে। কোথাও সন্ধ্যায় গ্যাস পাওয়া যায়। গ্যাসের চাপ পাওয়া যায় মূলত রাত ১১টার পর থেকে ভোর পর্যন্ত।

গ্যাস কোম্পানি ও জ্বালানি বিভাগ, সিএনজি স্টেশন মালিক ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মূলত চারটি কারণে বর্তমানে গ্যাসের সংকট প্রকট। এগুলো হলো_ চাহিদার তুলনায় সরবরাহ ঘাটতি, বিতরণ পাইপলাইনে সীমাবদ্ধতা, বসতি বেড়ে যাওয়া ও অবৈধ সংযোগ।

চলতি বছর দুই দফায় গ্যাসের দাম বাড়ানোর পরও গ্রাহকরা নিরবচ্ছিন্নভাবে গ্যাস পাচ্ছেন না কেন জানতে চাইলে দাম বৃদ্ধির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের সদস্য আজিজ খান সমকালকে বলেন, মূলত উৎপাদন ও চাহিদার মধ্যে ব্যবধান থাকায় অনেক গ্রাহক বঞ্চিত হচ্ছেন। তিনি মনে করেন, এলএনজি আমদানি শুরু হলে সমস্যার কিছুটা সমাধান হতে পারে।

জানতে চাইলে বুয়েটের অধ্যাপক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম. তামিম সমকালকে বলেন, 'এলএনজি আমদানির পর বর্তমানের মতো সরাসরি গ্যাস দেওয়া সরকার ও গ্রাহক উভয়ের জন্য লোকসান হবে। এ জন্য আবাসিকের সব গ্রাহককে প্রিপেইড মিটারের আওতায় আনতে হবে। তাহলে গ্যাসের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে।' গ্যাস চুরি বন্ধে সরকারকে আরও কঠোর হওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, 'কলকারখানায় জ্বালানি অদক্ষ যন্ত্রপাতির ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ দক্ষতার বয়লার ব্যবহৃত হয়। যেখানে আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ড হলো ৮৫ শতাংশ।' তিনি বলেন, পেট্রোবাংলার উচিত যেসব প্রতিষ্ঠান অদক্ষ যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে তাদের প্রথমে সতর্ক করা তা পাল্টানোর জন্য সময় বেঁধে দেওয়া। এর পরও অবস্থার পরিবর্তন না হলে গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা বা জরিমানার ব্যবস্থা করা।

জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বীরবিক্রম বলছেন, আগামী বছর থেকে এলএনজি আমদানি শুরু হলে গ্যাসের ঘাটতি ৫০ শতাংশ দূর হবে। তখন পরিস্থিতির উন্নতি হবে। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এলএনজি এলে তা শিল্প ও বিদ্যুৎ খাতের ঘাটতি মেটাতে ব্যবহার হবে। বাসাবাড়ির পাইপলাইনের গ্যাস সমস্যার তেমন কোনো উন্নতি হবে না। কারণ সরকার চাইছে, বাসাবাড়িতে সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহার হোক। আবাসিক খাতের পাইপলাইনে নতুন করে কোনো বিনিয়োগ করবে না সরকার। আবাসিক সংযোগ বন্ধ রয়েছে এ কারণেই। পাইপলাইনের গ্যাসের দামও বাড়ানো হচ্ছে ব্যাপকভাবে। যেন গ্রাহক ধীরে ধীরে তিতাসের গ্যাসের পরিবর্তে সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহারে বাধ্য হন।

সংকটের চার কারণ :রাজধানীতে গ্যাস সরবরাহের দায়িত্বে থাকা তিতাস গ্যাস বিতরণ কোম্পানির পরিচালক (অপারেশন) এইচ এম আলী আশরাফ বলেন, ঢাকার আশপাশের মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ এলাকায় গ্যাসের সমস্যা আরও প্রকট। ঢাকার মহানগরে যে সমস্যা আছে, তা মূলত কিছু প্রান্তিক এলাকায়। কিছু নির্দিষ্ট এলাকায় এই দুর্ভোগ ব্যাপক। কারণ এসব এলাকায় দ্রুত জনবসতি বেড়েছে। কিন্তু গ্যাসের বিতরণ লাইন সেভাবে পরিকল্পিত উপায়ে বাড়েনি। ফলে চাহিদা অনুসারে প্রান্তিক এলাকায় গ্যাস পান না অনেক গ্রাহক।

তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মীর মসিউর রহমানও এ সমস্যার কথা স্বীকার করে বলেন, চাহিদার তুলনায় গ্যাসের সরবরাহ ঘাটতিই সমস্যার মূল কারণ। তিনি জানান, তিতাসের এলাকায় গ্যাসের চাহিদা ২২০ কোটি ঘনফুট। সরবরাহ করা হচ্ছে ১৭০ কোটি ঘনফুট। ফলে চাইলেও সবাইকে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস দেওয়া সম্ভব নয়। তিনি আরও বলেন_ পুরান ঢাকা, মিরপুর, দক্ষিণ খান, উত্তর খানের মতো কিছু এলাকায় অপরিকল্পিত উপায়ে বসতি বেড়েছে। এসব এলাকার বিতরণ লাইনগুলো অনেক সরু। ফলে লাইনের শেষ প্রান্তে যারা বাস করেন, তাদের গ্যাস পেতে সমস্যা হবেই।

জ্বালানি বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, রাজধানীতে গ্যাস সমস্যার একটি বড় কারণ চুরি। আবাসিক খাতে গ্যাস সংযোগ বন্ধ থাকায় অবৈধভাবে গ্যাসের ব্যবহার বাড়ছে। তার মতে, প্রতিদিন ৩০ থেকে ৫০ কোটি ঘনফুট গ্যাস চুরি হচ্ছে। মাঝে মাঝে তিতাস অভিযান চালিয়ে এসব সংযোগ বিচ্ছিন্ন করলেও স্থানীয় প্রভাবশালীরা তিতাসের একশ্রেণির দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীর সহায়তায় আবার চালু করে। এতে বৈধ গ্রাহকরা বঞ্চিত হচ্ছেন। ঢাকা ও এর আশপাশে চার থেকে পাঁচ লাখ অবৈধ গ্যাস সংযোগ রয়েছে।

জানতে চাইলে তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জানান, গত এক বছরে তারা ৫০০ কিলোমিটারের বেশি অবৈধ বিতরণ লাইনের অপসারণ করেছেন। দেড় লাখের বেশি অবৈধ চুলার সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেছেন। বিভিন্ন অভিযোগে ১১ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে চাকরিচ্যুত করেছেন। এর পরও কিছু এলাকায় আবার অবৈধ সংযোগ চালু হচ্ছে। এর সঙ্গে স্থানীয় প্রভাবশালীরা জড়িত। প্রতি জেলায় অবৈধ সংযোগ বন্ধে জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে কমিটি আছে। তাদের আরও শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে হবে বলে মন্তব্য করেন মীর মসিউর।

ঘাটতির মধ্যেও উৎপাদিত গ্যাসের একটা বড় অংশ অপচয় হচ্ছে। অদক্ষ ও পুরনো যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তির কারণে বিদ্যুৎকেন্দ্র, সার কারখানা, শিল্প-কারখানা, বাসাবাড়ি ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে প্রয়োজনের অতিরিক্ত গ্যাস পোড়ানো হচ্ছে। কারণ মেশিনগুলো পুরনো হওয়ায় গ্যাস বেশি খায়। গবেষকদের মতে, দেশে মোট ব্যবহৃত গ্যাসের ১৫ শতাংশ অপচয় হচ্ছে। তাদের মতে_ বিদ্যুৎ, সার, শিল্পপ্রতিষ্ঠানে যন্ত্রপাতির দক্ষতা বাড়ানো গেলে এবং আবাসিকে প্রিপেইড মিটার ব্যবহৃত হলে দৈনিক ৩০ থেকে ৪০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের সাশ্রয় হবে।

জানতে চাইলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ সমকালকে বলেন, আগামী বছর এলএনজি আমদানি শুরু হলে গ্যাসের ঘাটতি অনেকটাই দূর হবে। তবে তিনিও জানান, এই গ্যাস শিল্পকারখানায় ব্যবহার হবে। বাসাবাড়িতে নয়। তিনি জানান, সরকার আবাসিকে গ্যাসের ব্যবহারকে নিরুৎসাহিত করতে চায়। আবাসিকের জন্য বিকল্প হিসেবে এলপি গ্যাসকে জনপ্রিয় করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে উল্লেখ করে তিনি জানান, এর দাম কমেছে। আরও কমানোর চেষ্টা চলছে। একসময় বাসাবাড়িতে সবাই এলপি গ্যাস ব্যবহার করবেন বলে আশা প্রকাশ করেন প্রতিমন্ত্রী।

 

http://bangla.samakal.net/2017/08/02/313309