২ আগস্ট ২০১৭, বুধবার, ৯:৩৩

আওয়ামী লীগে কেন এই আতঙ্ক

ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী

অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী আওয়ামী নেতাদের বক্তব্য শুনলে বা পড়লে বোঝা যায়, তারা ক্ষমতা হারানোর ভয়ে কী মাত্রায় আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের প্রতিদিন যে বক্তব্য দিচ্ছেন, তাতে খুব স্পষ্টই বোঝা যায় যে, এবার ক্ষমতায় যাওয়া আর ২০১৪ সালের মতো তাদের কাছে সহজ নেই। ফলে তারা এমন এমন কথা বলছেন, যাতে মনে হওয়া খুবই স্বাভাবিক যে, আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে আওয়ামী লীগ। মনে হয়, তারা তাল হারিয়ে ফেলেছেন। আর মনে করছেন যে, বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে কুৎসার গীত গাইলে বোধকরি জনগণ তাদের পক্ষাবলম্বন করবে। আর সে কারণেই আওয়ামী নেতারা একেবারে আদা-জল খেয়ে বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে কুৎসা গেয়েই যাচ্ছেন।

এই কুৎসিত কুৎসাকারীদের শীর্ষে আছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সড়ক-সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। সকলেই জানেন যে, বেগম খালেদা জিয়া লন্ডন গেছেন তার চোখের চিকিৎসার জন্য। তাছাড়া তিনি পরিবারের সঙ্গেও কিছু সময় কাটাবেন। তাতে দোষের কিছু থাকবার কথা নয়। কারণ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও তার পরিবারের সদস্যদের বিয়ে-টিয়ের অটুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার জন্য বিদেশে যান। তাতে কেউ প্রশ্ন তোলেনি যে, তিনি কেন পারিবারিক অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার জন্য সরকারি পয়সায় বিদেশ ভ্রমণে গেলেন। কারণ তার ছেলেসহ পরিবারের প্রায় সকল সদস্যই বিদেশিদের সঙ্গে আত্মীয়তার সম্পর্ক স্থাপন করেছেন। এ ছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমিধসে যখন দেড় শতাধিক বাংলাদেশির মৃত্যু ঘটল, তখনও তিনি বিদেশ সফরে ছিলেন। সাধারণত এ রকম পরিস্থিতিতে দেশের রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকার প্রধানরা বিদেশে সফর সংক্ষিপ্ত করে দেশে ফিরে আসেন। কিন্তু শেখ হাসিনা তা করেননি। তিনি নির্ধারিত পূর্ণ সময় বিদেশে কাটিয়ে দেশে ফিরে আসেন। এ নিয়ে মানুষের ভেতরে ক্ষোভ ছিল। এটা উপলব্ধি করে কয়েকদিন পরে আওয়ামী লীগের তরফ থেকে বলা হলো, তিনি বিদেশে বসেই দেশের খোঁজ-খবর রাখছেন। নিজ দেশের জনগণের সঙ্গে এর চেয়ে বড় মশকরা আর কী হতে পারে!
এই আওয়ামী লীগ বেগম খালেদা জিয়ার লন্ডন সফর নিয়ে একেবারে তুলকালাম কা- ঘটিয়ে ফেলছে। ওবায়দুল কাদেরই প্রথমে বললেন যে, আদালতে সাজার ভয়ে বেগম খালেদা জিয়া দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। কী দুর্দান্ত কথা! কিন্তু বেগম খালেদা জিয়ার কি পালাবার ইতিহাস আছে? ঐতিহাসিক সত্য বড় নির্মম। ২০০৭ সালে এক এগারোর পর শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। চলে যাবার জন্য কত যে বাহানার সৃষ্টি করা হয়েছিল তার কোনো ইয়ত্তা নেই। শেষ পর্যন্ত বলা হলো কানের চিকিৎসার জন্য তার বিদেশে যাওয়া একান্ত জরুরি। তারপর তিনি দেশ ছেড়েছিলেন।
কিন্তু বেগম খালেদা জিয়া দেশ ছাড়েননি। তাকে সৌদি আরব পাঠিয়ে দেয়ার জন্য সকল আয়োজন চূড়ান্ত করেছিল আওয়ামী লীগের ‘আন্দোলনের ফসল’ এক এগারোর সরকার। কিন্তু সৌদি আরব তাকে ভিসা দিচ্ছিল না। সৌদি দূতাবাসের বক্তব্য ছিল, তাকে যদি জোর করে পাঠানোর চেষ্টা করা হয়ে থাকে, তবে তারা ভিসা ইস্যু করবেন না।
সৌদি রাষ্ট্রদূত সে সময় বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করলে তিনি তাকে জানিয়েছিলেন যে, এক এগারোর সরকার তাকে জোর করে সৌদি আরব পাঠাতে চাইছে। সৌদি দূতাবাস যেন তার ভিসা ইস্যু না করে। তিনি শেষ পর্যন্ত দেশেই থাকতে চান। ফলে সৌদি আরব তার ভিসা ইস্যু করেনি। তিনি দেশেই রয়ে যান এবং এক এগারোর সরকার কর্তৃক কারাবন্দীই থাকেন।
এই ভিত্তি ভূমির ওপর দাঁড়িয়ে ওবায়দুল কাদের কোন আক্কেলে বললেন যে, বেগম খালেদা জিয়া মামলায় সাজার ভয়ে লন্ডনে পালিয়ে গেছেন? বিএনপি নেতারা ঠিকই বলেছেন যে, পালিয়ে যাওয়ার ইতিহাস বিএনপির নেই, আওয়ামী লীগেরই আছে। আওয়ামী লীগ বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে হাজার হাজার মিথ্যা মামলা দিয়ে তাদের বছরের পর বছর নাজেহাল করে যাচ্ছে। বিএনপি জামায়াতের লক্ষ লক্ষ নেতা-কর্মীকে কারাগারে নিক্ষেপ করেছে। এখনও বিশেষ অভিযানের নামে শত শত বিএনপি-জামায়াত কর্মীকে প্রতিদিন আটক করছে সরকার। সরকার সম্ভবত ভেবেছে, এই নির্যাতন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তারা বিরোধী মতকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেবে। এই ধারণা আহাম্মকের স্বর্গবাস ছাড়া আর কিছুই নয়।
বেগম খালেদা জিয়ার পালানোর বাকোয়াজি কিছুদিন চালালেন আওয়ামী নেতারা। কিন্তু দেখা গেল এই প্রচারণা কোনো কাজে দিচ্ছে না। কেউ বিশ্বাস করছে না। বরং আওয়ামী নেতারা হাস্যকর প্রমাণিত হয়েছেন। তখন এক নতুন তত্ত্ব এনে হাজির করা হলো। তা হলো লন্ডনে বসে বেগম খালেদা জিয়া দেশবিরোধী চক্রান্ত করছেন আইএসআই-এর সঙ্গে দেখা করেছেন। আরও কত কী। তার ছেলে বিএনপির সিনিয়র ভাইস-চেয়ারপাসৃন তারেক রহমানের সঙ্গে মিলে তিনি এসব করছেন। সে ষড়যন্ত্রের সরূপ কী, তা কেউ বলছেন না। দেশের ভেতরে থাকতে খালেদা জিয়া কত বৈঠকই তো করেছেন, কিন্তু আওয়ামী চোঙ্গারা তা নিয়ে কখনও প্রশ্ন তোলেন নি। কিন্তু লন্ডনে গিয়ে তারেক রহমানের সঙ্গে তার কথা হচ্ছে, এতেই আওয়ামী নেতারা একেবারে সম্বিত হারিয়ে ফেলেছেন।
তবে তারেক রহমানকে নিয়ে আওয়ামী লীগের এই আতঙ্ক নতুন নয়। যখন থেকে তারেক রহমান বিএনপির তৃণমূল সম্মেলন করতে শুরু করেন, তখন থেকেই আওয়ামী লীগ প্রমাদ গুণতে আরম্ভ করে। কারণ সেসব সম্মেলনে হাজারে হাজারে আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা ভিড় করতে থাকে। তিনি সাধারণ মানুষের মধ্যে বিএনপির পক্ষে এক গণজাগরণের সৃষ্টি করেন। এই সাংগঠনিক শক্তি ও দক্ষতা সজীব ওয়াজেদ জয়ের যেমন নেই, তেমনি নেই কোনো আওয়ামী নেতারও। ফলে আওয়ামী লীগের যাবতীয় আন্দোলন আর প্রপাগান্ডার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে পড়েন তারেক রহমান। সরকারে তারেক রহমানের যখন কোনো পদ ছিল না, তখন আওয়ামী লীগ তাদের রাজনৈতিক কর্মকা- সবটাই নিয়োজিত করেছিল তার বিরুদ্ধে। তারা প্রধানমন্ত্রীর অফিস ঘেরাও করার কোনো কর্মসূচি না দিয়ে গুলশানে তারেক রহমানের অফিস ঘেরাওয়ের কর্মসূচি দেন। রাজনৈতিক দেউলিয়াপনা আর কাকে বলে!
আর সে কারণেই আওয়ামী লীগের ‘আন্দোলনের ফসল’ এক এগারোর সরকারও তাকে ওপর থেকে ফেলে দিয়ে তার মেরুদ- ভেঙে দিয়েছিল। তারেক রহমান আতঙ্ক এখনও আওয়ামী লীগকে ছাড়েনি । সে আতঙ্কে তারা ভুগেই যাচ্ছেন। আর সে কারণেই তার সম্পর্কে নানা আবোল-তাবোল বলা এখনও অব্যাহত আছে। আসলে আওয়ামী লীগের পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেছে অনেক আগেই। আওয়ামী লীগ উপলব্ধি করেছে যে, ২০১৮ সালের নির্বাচন ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মতো একতরফা কিছুতেই হবে না। এবার নাম ঘোষণা করে এমপি হওয়া যাবে না। প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেই জিতে আসতে হবে। আর আওয়ামী লীগ গত ৯ বছরে যে পরিমাণ গুম খুন লুণ্ঠন দুর্নীতি দখলবাজি চালিয়েছে তাতে জনগণের ভোট পাওয়া তাদের জন্য অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তাছাড়া নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সব সময় ভারতের আশির্বাদের ওপর নির্ভরশীল। সে আশির্বাদের পথও এখন সীলগালা হয়ে গেছে। কংগ্রেস সরকার ক্ষমতায় থাকার সময় তারা যেভাবেই হোক আওয়ামী লীগকে বাংলাদেশে ক্ষমতায় রাখার নির্লজ্জ প্রয়াস চালিয়েছে। ২০১৪ সালের নির্বাচনে কংগ্রেসের যে ভরাডুবি হয়েছে, সেখান থেকে উঠে দাঁড়াতে তাদের দু চার দশক সময় লাগবে। সর্বশেষ আওয়ামী সমর্থক শিখ-ি ছিলেন ভারতের প্রায় ক্ষমতাহীন রাষ্ট্রপতি কংগ্রেসের প্রণব মুখার্জি। সে প্রণবও ভারতের রাজনীতি থেকে চিরতরে বিদায় হয়ে গেছেন।
অতএব আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসিয়ে দেওয়ার জন্য ভারতে এখন কেউ নেই। শেখ হাসিনা নরেন্দ্র মোদির বিজেপি সরকারকে সব কিছু উজাড় করে দিয়েছিলেন মোদির সহযোগিতার আশায়। সড়ক পথ, রেল পথ, নৌ পথ, বন্দর সব কিছু ভারতের ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছে আওয়ামী লীগ সরকার। কিন্তু এখন বৈশ্বিক দৃশ্যপটই বদলে গেছে। ভারত-চীন যুদ্ধ যুদ্ধ পরিস্থিতিতে বদলে গেছে রাজনৈতিক সমীকরণ। চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্শ এখন সর্বোচ্চ পর্যায়ে। কিন্তু ভুটানের উত্তরাঞ্চলে চীনা ভূখ- ডোকলাম মালভূমিতে রাস্তা সম্প্রসারণ করতে গিয়েছিল চীন। তাতে ভারতীয় সৈন্যরা বাধা দেয়। ভুটানের পররাষ্ট্রনীতির দেখভাল করা আর তার সীমান্ত রক্ষা করার দায়িত্ব এক সময় ভারতের হাতে ছিল। কিন্তু ২০০৭ সালে সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী সে অবস্থা আর নেই। সুতরাং ঐ সড়ক নির্মাণে ভারত বাধা দিতে পারে না। দিল্লীর এই কাজকে ভারতীয় গণমাধ্যগুলোও ‘দাদাগিরি’ বলে অভিহিত করেছে। সে ক্ষেত্রে চীন বলেছে, যে যুক্তিতে ভারত ডোকলামে প্রবেশ করেছে, একই যুক্তিতে চীনও তবে কাশ্মীরে প্রবেশ করবে। তার চেয়েও বড় কথা, যুদ্ধ যদি বেঁধেই যায়, তবে চীন এক ধাক্কায় পশ্চিমবঙ্গ পর্যন্ত নেমে এসে শিলিগুড়ি কোরিডোর বন্ধ করে দিয়ে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাত রাজ্যে ভারতের প্রবেশ বন্ধ করে দেবে। তখন বাংলাদেশের স্থল-রেল-নৌপথ ব্যবহার করতে চাইবে ভারত। আর সে পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে চীন। শেখ হাসিনার পক্ষে এই নিশ্চয়তা দেওয়া সম্ভব নয় যে, তারা চীনকে বাধা দিতে পারবে। অতএব ভারতের কাছে আওয়ামী সরকারের প্রয়োজন শেষ।
আর তাই সরকার আমলাতন্ত্র আর বিচারবিভাগ নিয়ন্ত্রণের জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। সে জন্য শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি বিকৃত করার এক ইউএনও’র ২ ঘণ্টার সাজায় সরকার একবারে তোলপাড় করে ফেললো। আর প্রলাপ বকতে শুরু করেছেন, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তিনি তার নেতাকর্মীদের বলছেন, আওয়ামী লীগকে যেভাবেই হোক ক্ষমতায় আনতে হবে। নইলে তারা দুর্নীতির মাধ্যমে যে অর্থ কামিয়েছেন, সেসব নিয়ে বিদেশে পালাতে হবে, ভোগ করতে পারবেন না।

 

http://www.dailysangram.com/post/294378-