৩০ জুলাই ২০১৭, রবিবার, ৯:০৬

বাংলাদেশের আইটি খাতের কাজ চলে যাচ্ছে ভারতীয় কোম্পানি উইপ্রোর কাছে

হঠাৎ করেই বিশ্বের সবচেয়ে বড় আইটি কোম্পানির একটি অ্যাকসেঞ্চার বাংলাদেশ থেকে কার্যক্রম গুটিয়ে চলে যাওয়ায় এদেশের আইটি খাতে অস্থিরতা দেখা দেবে বলে মনে করেন আইটি খাতের সঙ্গে জড়িতরা। আর এই কোম্পানি বাংলাদেশ থেকে চলে যাওয়ার পর কোম্পানির কাজগুলো দেখভাল করবে ভারতীয় কোম্পানি উইপ্রো। এতে একদিকে বাংলাদেশের শত শত আইটি বিশেষজ্ঞ বেকার হয়ে যাচ্ছেন। অন্যদিকে বিশ্বের আইটি খাতে বিনিয়োগকারীদের কাছেও একটা ভুল ম্যাসেজ যাবে। এতে বাংলাদেশে আইটিখাতে এক ধরনের অস্থিরতা দেখা দেবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে গত ১৮ জুলাই থেকে অ্যাকসেঞ্চার সমস্ত কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে। একইসঙ্গে কোম্পানিতে চাকুরী করা বাংলাদেশের ৫শ’ ৫৬ জন কর্মীকে ১২০ দিনের বেতন দেওয়ার কথা বলে অপসারণের ঘোষণা দেয় কোম্পানীটি। এই কোম্পানির ম্যানেজমেন্টের কর্মকর্তারা রাতের অন্ধকারে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে চলে যায়। সেখানে গিয়ে ই- মেইল বার্তায় তাদের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দেয়। এদিকে বাংলাদেশ থেকে অ্যাকসেঞ্চার কার্যক্রম গুটিয়ে নিলেও একাজ পাচ্ছে ভারতের কোম্পানি উইপ্রো।
হঠাৎ করে অ্যাকসেঞ্চারের চলে যাওয়াকে ভাল লক্ষন হিসেবে দেখছেন না বাংলাদেশের আইটি খাত বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, বাংলাদেশে কার্যক্রম পরিচালনা করলে কর্মসংস্থান হতো বাংলাদেশের মানুষের। রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রেও লাভবান হতো বাংলাদেশ। এছাড়া কোন রকম রাখঢাক ছাড়াই হঠাৎ করে অ্যাকসেঞ্চারের মত মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানির চলে যাওয়ায় ভুল ম্যাসেজ যাবে এই অন্যান্য ব্যবসায়ীদের কাছে। কারণ পরবর্তীতে বাংলাদেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে দুইবার ভাববে তারা।
এদিকে সরকার উদ্যোগ নিলে অ্যাকসেঞ্চারের কার্যক্রম ফিরিয়ে আনা যেত বলে মনে করেন এই কোম্পানিতে কাজ করে আসা সবেক কর্মকর্তারা। তারা এও বলেছেন বাংলাদেশ থেকে কার্যক্রম গুটিয়ে নিলেও এই কাজ দেওয়া হচ্ছে ভারতের তৃতীয় বৃহত্তম সফটওয়্যার পরিষেবা রফতানিকারী প্রতিষ্ঠান উইপ্রোকে। যা বাংলাদেশের লোকজন করতে পারতো। অবশ্য অ্যাকসেঞ্চারের চলে যাওয়ায় চিন্তিত নয় সরকার। আইসিটি প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, এতে তেমন কোন প্রভাব পড়বে না।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, উইপ্রোর বাইরে অ্যাকসেঞ্চার থেকে টেলিনর পাকিস্তান হাতছাড়া হয়ে যাওয়া, নতুন ব্যবসা না হওয়া, টেলিনরের অন্যান্য ব্যবসার সাথে সম্পৃক্ত হতে না পারা এবং ইউনিয়ন কর্মীদের নানান ইস্যুতে ক্রমবর্ধমান চাপ ইত্যাদি কারণেও অ্যাকসেঞ্চার বন্ধের ঘটনা ঘটেছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেছেন।
প্রসঙ্গত, জিপি আইটির ৫১ শতাংশ মালিকানা নিয়ে ২০১৩ সালের ৩ আগস্ট বাংলাদেশে কার্যক্রম শুরু করে অ্যাকসেঞ্চার। শুরুর দিকে টেলিনর গ্লোবালের চার প্রতিষ্ঠান গ্রামীণফোন, ডিজি মালায়শিয়া, ডি-ট্যাক থাইল্যান্ড, এবং টেলিনর পাকিস্তানের দায়িত্ব পায় অ্যাকসেঞ্চার। এশিয়ার এই চারটি দেশের সাথে সফল ব্যবসা করার পর টেলিনরের অন্যান্য অঞ্চলের ব্যবসার সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার পরিকল্পনা ছিল অ্যাকসেঞ্চারের। কিন্তু সম্প্রতি অ্যাকসেঞ্চারের পর গ্রামীণফোনের আইটি ডিভিশনের সব কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হচ্ছে ভারতের তৃতীয় বৃহত্তম সফটওয়্যার পরিষেবা রফতানিকারী প্রতিষ্ঠান উইপ্রোকে। ইতোমধ্যেই গ্রামীণফোন উইপ্রোর সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। অ্যাকসেঞ্চার বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রায়হান শামসির পক্ষ থেকে সব কর্মীকে পাঠানো টার্মিনেশন লেটারে উইপ্রোর কথা উল্লেখ করে লিখেছেন, আপনাদের মধ্যে কেউ কেউ উইপ্রো থেকে জব অফার পেতে পারেন, যে প্রতিষ্ঠানটিকে গ্রামীণফোন নিয়োগ দিয়েছে।
এদিকে এরই মধ্যে গত বছর অ্যাকসেঞ্চারের হাতছাড়া হয়েছে টেলিনর পাকিস্তান। টেলিনর গ্লোবাল থেকে দায়িত্ব পাওয়া চারটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দুটির ব্যবসা হাতছাড়া হয়ে যাওয়া এবং নতুন করে কোন ব্যবসা না হওয়াতে বাংলাদেশে ব্যবসার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে অ্যাকসেঞ্চার।
অ্যাকসেঞ্চার বাংলাদেশের হাতে থাকা চারটি প্রতিষ্ঠানের একটি টেলিনর পাকিস্তান চলে গেছে গত বছর। গ্রামীণফোনের অংশ এখন থেকে দেখবে ভারতীয় আইটি প্রতিষ্ঠান উইপ্রো। বাকি দুই প্রতিষ্ঠান ডিজি মালায়শিয়া এবং ডিট্যাক থাইল্যান্ডকে অ্যাকসেঞ্চারের ভারত অফিস থেকে সাপোর্ট দেওয়া হবে।
বাংলাদেশে অ্যাকসেঞ্চার বন্ধ হওয়াতে বৈশ্বিক পর্যায়ে প্রভাব পড়বে উল্লেখ করে অ্যাকসেঞ্চার এমপ্লয়ী ইউনিউয়নের সাধারণ সম্পাদক মো. শাহীন আহমেদ শুক্রবার দৈনিক সংগ্রামকে বলেন, বাংলাদেশে হঠাৎ সিদ্ধান্তে আইটি কোম্পানি বন্ধ হয়ে যাওয়াতে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো আর এ খাতে বিনিয়োগ করতে চাইবে না। তিনি বলেন, অ্যাকসেঞ্চারকে না ফেরানোর মানে হলো বাংলাদেশ ভিশনহীনতার দিকে হাঁটছে। এতে বাংলাদেশ ইমেজ সংকটে পড়বে।
একই সংগঠনের সভাপতি ইব্রাহীম হোসেন মনে করেন, অ্যাকসেঞ্চার রাতের অন্ধকারে এভাবে চলে যেতে পারে না। এতে অন্য মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলোও এই সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করবে। আর তাতে বাংলাদেশের মানুষ সামাজিক নিরাপত্তাহীনতায় পড়বে।
তবে তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক সাংবাদিকদের বলেছেন, অ্যাকসেঞ্চার বন্ধ হওয়াতে আমাদের আইটি খাতে তেমন কোন প্রভাব পড়বে না। এখন বাংলাদেশে আইটি খাত মোটামুটি দাঁড়িয়ে গেছে। আমরা এখন বিলিয়ন ডলার এক্সপোর্টের কাছাকাছি আছি। অ্যাকসেঞ্চারের ১০ মিলিয়ন ডলারের মতো এক্সপোর্ট ছিল। আমাদের এই সাড়ে পাঁচশত ইঞ্জিনিয়ার তৈরি হয়েছে এবং তাদের অভিজ্ঞতা হয়েছে। এখন আমাদের লিডিং যেসব আইটি কোম্পানিতে আছে এখন তারা সেখানে যাবে এবং তারা নিজেরাও উদ্যোক্তা হবে।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ অ্যাসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সভাপতি মোস্তাফা জব্বার বলেন, অ্যাকসেঞ্চার বাংলাদেশ থেকে চলে গেলে ইমেজের বড় ধরনের একটা সংকট তৈরি হবে। আরও যেসব প্রতিষ্ঠান বা বিনিয়োগকারী বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে চায় বা সরাসরি আসতে চায়, তারা দ্বিতীয়বার ভাববে। আমরা যতই সফটওয়্যার ও সেবাপণ্য রফতানি করি না কেন, এই ঘাটতি পুষিয়ে নেওয়া কঠিন হবে।
জিপি আইটির সাথে প্রথম থেকে কাজ করেছেন তথ্যপ্রযুক্তিবিদ সৈয়দ আলমাস কবির বলেন, আমরা যে ফরেন ইনভেস্টমেন্ট আশা করি এবং এখানে যে আমরা হাইটেক পার্ক বানিয়ে আশা করছি বিদেশি বড় কোম্পানি এখানে এসে অফিস সেট আপ করবে; সেটাতে একটা বড় প্রভাব পড়বে। অ্যাকসেঞ্চারের মতো বড় প্রতিষ্ঠান চলে যাওয়াতে অন্যরা এখানে বিনিয়োগ করতে ভয় পাবে।
এ ব্যাপারে অ্যাকসেঞ্চারের মার্কেটিং অ্যান্ড কমিউনিকেশনের টিম লিড শবনম খান এক অফিসিয়াল স্টেটমেন্টে লিখেছেন, এশিয়া ও ইউরোপে বিভিন্ন কার্যক্রম পুনরায় জোরদার করতে একসঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে টেলিনর গ্রুপ ও অ্যাকসেঞ্চার। আর এ কারণে অ্যাকসেঞ্চার কমিউনিকেশনস ইনফ্রাস্ট্রাকচার সলিউশনস লিমিটেডের (এসিআইএসএল) নিজ কার্যালয়ে চলমান কিছু কার্যক্রমে (সেবায়) রদবদল আনা হচ্ছে। আরও কিছু কার্যক্রম তৃতীয় পক্ষের হাতে স্থানান্তর করা হবে। এসিআইএসএল কর্মীদের মধ্যে কেউ কেউ পরিবর্তিত অবস্থায় তৃতীয় পক্ষের দেওয়া নিয়ম অনুযায়ী কাজের সুবিধা পাবেন। প্রতিষ্ঠান সব র্কমীর এই পরিবর্তন কালীন সময়ে সব ধরনের যথার্থ সহযোগিতা করবে।

http://www.dailysangram.com/post/293943-