৩০ জুলাই ২০১৭, রবিবার, ৯:০৫

যমুনার পানি এনে বুড়িগঙ্গার প্রবাহ বৃদ্ধির প্রকল্প বরাদ্দ বাড়লো

কথা ছিল রাজধানীর প্রাণ বুড়িগঙ্গা নদী আর দূষণের কবলে থাকবে না। এ নদীর পানি যাতে ব্যবহারের উপযোগী করা যায় সে জন্য বুড়িগঙ্গা নদী দখল ও দূষণমুক্ত করতে ২০১০ সালে অনুমোদন দেয়া হয় একটি প্রকল্প। ২০১৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মেয়াদের এ প্রকল্পের ব্যয় ওই সময় ধরা হয় ৯৪৪ কোটি টাকা। কিন্তু গত সাত বছরে প্রকল্পটির অগ্রগতি হয়েছে মাত্র ১৩ শতাংশ। এ প্রকল্পের ব্যয় নতুন করে আরো ১৮১ কোটি টাকা বাড়িয়ে ১ হাজার ১২৫ কোটি টাকা করা হচ্ছে। পাশাপাশি বাস্তবায়নকাল বাড়ানো হয়েছে ২০২০ সাল পর্যন্ত। এ প্রকল্পটি এখন পুরোদমে হাতে নিয়েছে পাউবো। হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে যমুনা নদী থেকে পানি এনে বুড়িগঙ্গার প্রবাহ বাড়াতে চায় পানি উন্নয়ন বোর্ড। এ লক্ষ্যে সমীক্ষা জটিলতায় দীর্ঘদিন ধরে আটকে থাকা 'বুড়িগঙ্গা পুনরুদ্ধার' প্রকল্পের কাজ শিগগিরই শুরু করতে যাচ্ছে তারা।
তথ্যমতে, প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে প্রতিদিন ২৪৫ কিউবিক মিটার পানি আসবে বুড়িগঙ্গায়। এ বছরের সেপ্টেম্বরে কাজ শুরু করে ২০২০ সালে প্রকল্পটি শেষ করার লক্ষ্য রয়েছে পাউবো'র।
কিন্তু অধিক দূরত্ব ও খননের স্থায়িত্ব বিবেচনায় এ প্রকল্পের সফলতা নিয়ে সন্দিহান নদী রক্ষায় গঠিত টাস্কফোর্স। এদিকে, প্রকল্পটি ইতিবাচক হিসেবেই দেখছেন পরিবেশবিদরা। তবে, দূষণ রোধে শক্ত ব্যবস্থা না নিয়ে বিকল্প হিসেবে ব্যয়বহুল এ প্রকল্প গ্রহণের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্নও রয়েছে তাদের।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন ৭০ শতাংশ দূষণ এখনো নিয়ন্ত্রণে না আসায় শুষ্ক মৌসুমে আবারো দেখা দেবে বিপর্যয়। শীতকালেও বুড়িগঙ্গাকে প্রবাহমান রাখতে ২০১০ সালে হাতে নেয়া প্রকল্প এখন সচল করতে চায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান প্রকৌশলী এএইচএম ফখরুল ইসলাম।
এ প্রকল্পের মাধ্যমে প্রায় ১৬৩ কিলোমিটার দীর্ঘ ৪টি নদী খনন করে বুড়িগঙ্গায় পানি আনতে চায় তারা। পরিকল্পনা মতে, টাঙ্গাইলের যমুনা ব্রিজ পয়েন্ট থেকে জোকেরচর পর্যন্ত ২.৩৫ কিলোমিটার নিউ ধলেশ্বরী, জোকেরচর থেকে মির্জাপুর পর্যন্ত ৬১.৫ কিলোমিটার পুংলি, মির্জাপুর থেকে গাজীপুরের কালিয়াকৈর পর্যন্ত ২১ কিলোমিটার বংশী ও কালিয়াকৈর থেকে রাজধানীর বসিলা পর্যন্ত ৭৮ কিলোমিটার তুরাগ নদী হয়ে পানি আসবে বুড়িগঙ্গায়।
কিন্তু ২০১৩ সালে কাজ শুরু হলেও বাস্তবতা যাচাইয়ের সমীক্ষা জটিলতায় ওই বছরই থমকে যায় ১ হাজার ১২৫ কোটি টাকা প্রকল্পটি।
পাউবো প্রধান প্রকৌশলী ড. এএইচএম ফখরুল ইসলাম বলেন, 'ফিজিক্যাল মডেলের জন্য আমরা নদী গবেষণা ইন্সটিটিউটকে যুক্ত করেছি তাদের রিপোর্টের ভিত্তিতে আমরা একটি কর্ম পরিকল্পনা তৈরি করবো যাতে এটি একটা টেকশই ডেজিং কাজ হয়। তবে এমন প্রকল্প বুড়িগঙ্গার দূষণ রোধে দীর্ঘমেয়াদী কোনো সুফল বয়ে আনবে না বলে মনে করেন নদী রক্ষায় গঠিত টাস্কফোর্সের দায়িত্বশীল এই কর্মকর্তা।
বিআইডব্লিটিএ চেয়ারম্যান কমোডর এম মোজাম্মেল হক বলেন, 'আমি মনে করি এটা দীর্ঘমেয়াদি কোনো সমাধান না। পানি প্রবাহ বৃদ্ধি করার পাশাপাশি এটার উৎস মানে যেখান থেকে বর্জ্যগুলো উৎপন্ন হচ্ছে সেখানে এটাকে বাধাগ্রস্ত করতে হবে।
জানা গেছে, নতুন নতুন স্থাপনা নির্মাণ, ৬২ ধরনের রাসায়নিক বর্জ্য, আট ফুট পুরু পলিথিনের স্তর, দেড় কোটি মানুষের ফেলা আবর্জনাসহ বিভিন্ন কারণে ঢাকার পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া বুড়িগঙ্গা নদী এখন মৃতপ্রায়। এক সময়ের প্রমত্তা বুড়িগঙ্গা নদীর হারানো জৌলুস ফিরিয়ে আনতে কঠোর নির্দেশনা রয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। একই নির্দেশনা রয়েছে সর্বোচ্চ আদালতের পক্ষ থেকেও। কিন্তু এসব নির্দেশনা কোনো কাজে আসেনি।
সূত্র জানায়, পানি উন্নয়ন বোর্ড ২০০৪ সালে বুড়িগঙ্গা নদী পুনরুদ্ধারের জন্য বিস্তারিত একটি সমীক্ষা চালায়। ওই সমীক্ষার আলোকেই প্রকল্প ব্যয় ও নদী উদ্ধারের কৌশল নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু সমীক্ষাটি ছিল ভুল। পরিকল্পনা কমিশনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নদী খনন করতে গিয়ে দেখা গেছে, বিভিন্ন স্থানে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর, এলজিইডি ও রেলপথ মন্ত্রণালয়ের ২২টি সেতু রয়েছে। কিন্তু সমীক্ষায় এসব সেতুকে বিবেচনায় নেয়া হয়নি।
কমিশনের এক কর্মকর্তা জানান, নদী খনন করলে ওইসব সেতু হুমকির মুখে পড়বে। আর সেতু ভেঙে পড়লে সড়ক, রেল ও এলজিইডির সড়ক দিয়ে যান চলাচলে ব্যাঘাত ঘটবে। এ কারণে নদী খননের কাজ করা যায়নি।
এদিকে বুড়িগঙ্গা দূষণ রোধকে প্রধান চ্যালেঞ্জ মনে করেন পরিবেশবিদরাও। পানির প্রবাহ বাড়ানোর এ প্রকল্পকে ইতিবাচক হিসেবে দেখলেও এর উপযোগিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার তাগিদ দিচ্ছেন তারা।
পরিবেশবিদ ড. আনুন নিশাত বলেন,সারাবছর যদি যমুনা থেকে পানি আসে তাহলে দূষণ কিছুটা কমবে। কিন্তু সবার আগে যে দূষিত পানি আমরা নদীতে ফেলছি সেটা শোধন করতে হবে।
পরিবেশ আইন সমিতি প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, 'নদী রক্ষার কথা বললে সরকার ড্রেজিং-এর কথা প্রথম দিয়ে শুরু করে। এখানে হয়ত অনেক টাকা পয়সার ব্যাপার আছে আমি ঠিক জানি না। যারা দূষণ করছে তাদের বিরুদ্ধে সরকার ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলতে আমরা দেখি না।'
বুড়িগঙ্গা পুনরুদ্ধারে পরিকল্পনা মন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল একনেকের এক বৈঠকে বলেছিলেন, ‘ঢাকার চারপাশে অবস্থিত নদীগুলোর নাব্য ও পানি সরবরাহ ঠিক রাখতে ‘মাস্টার প্লান’ তৈরির নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এজন্য তিনি এলজিআরডি মন্ত্রণালয় ও পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়কে যৌথভাবে কাজ করার নির্দেশ দিয়েছেন।’
তিনি বলেন, ২০১০ সালের এপ্রিল থেকে ২০১৩ সালের ডিসেম্বর মেয়াদে বুড়িগঙ্গা নদী পুনরুদ্ধার প্রকল্পটির ব্যয় ছিল ৯৪৪ কোটি টাকা। প্রকল্পটির মেয়াদ ২০২০ সালের এপ্রিল পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। এতে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ১২৫ কোটি ৫৯ লাখ টাকা।

 

http://www.dailysangram.com/post/293950-